Quantcast
Channel: QuranerAlo.com – কুরআনের আলো ইসলামিক ওয়েবসাইট
Viewing all 452 articles
Browse latest View live

একজন ঈমানদার দা‘ঈর বর্জিত গুণাবলি পর্ব ৪

$
0
0

DawahMission_Gloucester_FB-01

লেখক:মুহাম্মদ শাহিদুল ইসলাম

পর্ব ১ | পর্ব ২ | পর্ব ৩ | পর্ব ৪| পর্ব ৫ | পর্ব ৬ | পর্ব ৭| পর্ব ৮ | পর্ব ৯ | পর্ব ১০

ক্রোধ

ক্রোধ পরিচিতি

গজব (غضب) শব্দটি আরবী। যার আভিধানিক অর্থ রাগ, ক্রোধ, রোষ, কোজ, ক্রুদ্ধ ইত্যদি। রাগ বা গোস্সা হওয়াকে গজব বলে। এটি লেনফসিহী মাজমুম (নিন্দনীয়) কিন্তু লি-অজহিল্লাহ মাজমুম নয় বরং মাহমূদ তথা প্রশংসনীয়।

ক্রোধের কারণ ও শ্রেণীবিভাগ

ক্রোধের কারণসমূহ

মানবীয় গুণে রাগের উদয় কয়েকটি কারণে হতে পারে। যেমন :

(ক) স্বভাবগত ক্রোধ

(খ) অহংকারের ফলে উদ্ভূত ক্রোধ

(গ) ব্যক্তিত্ব ও নেতৃত্বের লালসা জনিত ক্রোধ

(ঘ) অনর্থক কলহ বশত: ক্রোধ

(ঙ) অত্যধিক হাসি মজাক ও ঠাট্টা বিদ্রুপ

জনিত ক্রোধ

ক্রোধের শ্রেণীবিণ্যাস

ক্রোধ বিভিন্ন প্রকার। নিম্নে তার সার বর্ণনা করা হল।

(ক) প্রশংসনীয় ক্রোধঃ যেমন আল্লাহর প্রতি মহব্বত পোষণকারী কোন মুসলিম যখন আল্লাহদ্রোহী কোন কাজ হতে দেখে, তখন সে ক্রুদ্ধ হয়। এই ক্রোধ প্রশংসনীয়। এমন ব্যক্তি আল্লাহর নিকট পুরস্কৃত হবে।

আল্লাহ তাআলা বলেন:

ذَلِكَ وَمَنْ يُعَظِّمْ حُرُمَاتِ اللَّهِ فَهُوَ خَيْر لَهُ عِنْدَ رَبِّهِ 

এটাই বিধান। আর কেউ আল্লাহর সম্মানযোগ্য বিধানাবলীর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করলে পালনকর্তার নিকট তা তার জন্য উত্তম।৩৭

(খ) নিন্দনীয় ক্রোধঃ এ এমন ক্রোধ যা হতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিষেধ করেছেন। যেমন নিজের অন্যায় দাবী প্রতিষ্ঠা করার জন্য ক্রুদ্ধ হওয়া। এ প্রকারের ক্রোধান্ধ ব্যক্তি আল্লাহর নিকট ঘৃণিত।

(গ) স্বভাবগত ক্রোধঃ যেমন কারো স্ত্রী তার কথা অমান্য করলে সে ক্রুদ্ধ হয়, এই প্রকারের ক্রোধ হালাল, কিন্তু এর কু-পরিণামের কারণে এই ক্রোধ থেকেও বারণ করা হয়েছে। একে রাসূলের নিষিদ্ধ ক্রোধের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।৩৮

ক্রোধের পরিণতি

  • ক্রোধ বুদ্ধিমান ব্যক্তির বুদ্ধি নির্ভুলভাবে প্রয়োগে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে, ফলে উত্তেজনার বশীভূত হয়ে অন্যায়ের নির্দেশ প্রদান করে। অত:পর যখন ক্রোধ থেমে যায়, তখন এর জন্য লজ্জিত হয়। যেমন কেউ ক্রোধে অস্থির হয়ে স্ত্রীকে তালাক দিয়ে ফেলল। বা নিজ সন্তানকে অথবা আপনজনকে এমন প্রহার করল যে, সে রক্তাক্ত হয়ে গেল। এহেন ক্রোধের কারণে নিশ্চয় পরবর্তীতে সে লজ্জিত হবে।
  • ক্রোধান্ধ ব্যক্তি থেকে মানুষ পলায়ন করে, বর্জন করে তার আশপাশ। ফলে সে কখনো মানুষের শ্রদ্ধা ও আন্তরিকতা লাভ করতে পারে না, বঞ্চিত হয় মানুষের সু-দৃষ্টি হতে। বরং সব সময় মানুষের নিকট সে ঘৃণিত হয়ে থাকে।
  • ক্রোধ হল মানুষের মাঝে শয়তানের প্রবেশদ্বার। এ পথে প্রবেশ করে মানুষের জ্ঞান বুদ্ধি নিয়ে সে খেলা করে।
  • ক্রোধ পাপ কাজের দ্বার উন্মুক্তকারী।
  • ক্রোধ সমাজে বিরাজমান পারস্পরিক আন্তরিকতা ও সৌহার্দ্যকে ভেঙে দিয়ে বিশৃঙ্খলা ও অমানবিকতা সৃষ্টি করে।
  • ক্রোধ স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ক্ষতিকর। কেননা অত্যধিক ক্রোধ মস্তিষ্ক যা সম্পূর্ণ শরীরের নিয়ন্ত্রক-এর উপর আঘাত হানে। ফলে তা বহু মূত্র, রক্তের বায়ুচাপ, ও হার্টের দুর্বলতাসহ অনেক রোগের কারণ হয়।
  • ক্রোধের পরিণামফল হল, নিজের সম্পদ ধ্বংস করা ও মানুষের রোষানলে পতিত হওয়া।
  • ক্রোধ নিবারণ করার সুফল

রাগান্বিত হলে তা সাথে সাথে দমন করা একটি বুদ্ধিমান ও বিবেকবান ব্যক্তির পরিচয়। শুধ তাই নয়, এ মহৎগুণ অর্জন করার পেছনে ইসলামের উৎসাহও বিদ্যমান। এ প্রসঙ্গে হাদীসের এক বর্ণনায় এসেছে :

عن أبي هريرة- رَضِيَ اللهُ عَنْهُ- أَنَّ رَجُلاً قَالَ لِلنَّبِيُّ- صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَ سَلَّمَ: أوْصِنِيْ قَالَ : لَا تَغْضَبْ، فَرَدَّدَ مِرَارًا، قَالَ : لَا تَغْضَبْ

“আবু হুরাইরা রা. বর্ণনা করেন, জনৈক ব্যক্তি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দরবারে এসে বললেন, আমাকে কিছু উপদেশ দিন। রাসূল বললেন, ক্রুদ্ধ হয়ো না। সে ব্যক্তি বারংবার উপদেশ চাইলে রাসূল (একই উত্তর দিয়ে) তাকে বললেন, ক্রদ্ধ হয়ো না।”৩৯

ক্রোধান্বিত হওয়ার মতো কোন ঘটনা ঘটলে তা থেকে নিস্কৃতি লাভের জন্য পবিত্র কুর’আন ও হাদীসে ক্রোধ সংবরণের মর্যাদা সংক্রান্ত উক্তির কথা স্মরণ করতে হবে। তাহলে ক্রোধের সার্বিক পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া বা অনিষ্টতা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। মহান আল্লাহ তায়ালা মুত্তাকী বা পরহেযগারদের চরিত্র উল্লেখ করতে গিয়ে বলেন :

“আর যারা নিজেদের রাগকে সংবরণ করে এবং মানুষের প্রতি ক্ষমা প্রদর্শন করে।”৪০ 

হাদীসের এক বর্ণনায় এসেছে :

من كظم غيظا و هو قادر على أن ينفذه دعاه الله على رءوس الخلائق حتى يخيره من الحور العين يزوجه منها ما شاء

“যে ব্যক্তি ক্রোধ প্রকাশ ও তদনুযায়ী কাজ করার সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও তা দমন করল আল্লাহ তা‘আলা তাকে (কিয়ামত দিবসে) সৃষ্টিকূলের সামনে ডেকে পাঠাবেন এবং তার পছন্দমতো হুরের সাথে তাকে বিয়ে দিবেন।”৪১

ক্রোধ থেকে বাঁচার উপায়

এ ভয়ানক ক্ষতিকর পরিণতির বিষয়টি থেকে পরিত্রাণের কয়েকটি উপায় রয়েছে। যেমন :

(ক) যে সমস্ত কারণে মানুষ ক্রুদ্ধ হয় সেগুলো থেকে দূরে থাকা।

(খ) মুখ ও অন্তর দ্বারা আল্লাহর যিকির করা। কেননা, ক্রোধ হল শয়তানের কু-প্রভাবের বিষক্রিয়া।  তাই যখন মানুষ আল্লাহর যিকির করে তখন শয়তানের প্রভাব মুক্ত হয়ে যায়।

(গ) ক্রোধ পরিত্যাগ ও মানুষকে ক্ষমার সওয়াবের কথা স্মরণ করা। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন :

তোমরা তোমাদের পালনকর্তার ক্ষমা ও জান্নাতের দিকে ছুটে যাও, যার সীমানা হচ্ছে, আসমান জমিন, যা তৈরি করা হয়েছে মুত্তাকীদের জন্য। যারা সচ্ছলতায় ও অভাবের সময় ব্যয় করে, যারা নিজেদের রাগকে সম্বরণ করে, আর মানুষের প্রতি ক্ষমা প্রদর্শন করে, বস্তুত: আল্লাহ সৎকর্মশীলদেরকেই ভালোবাসেন।৪২

(ঘ) ক্রোধের মন্দ পরিণতির কথা স্মরণ করা। ক্রোধান্ধ ব্যক্তি যদি ক্রুদ্ধ অবস্থায় নিজ অশোভণীয় বিকৃত আকৃতি দেখতে পেত তাহলে লজ্জায় তখনি ক্ষান্ত হয়ে যেত।

(চ) ক্রুদ্ধ ব্যক্তির অবস্থার পরিবর্তন করা, যে অবস্থায় ছিল তার পরিবর্তে অন্য অবস্থা গ্রহণ করা।

(ছ) ওজু করা, তা এই জন্য যে, ক্রোধ হল শয়তানের পক্ষ থেকে। আর শয়তান আগুনের তৈরি। আর আগুন পানি দ্বারা নির্বাপিত হয়ে যায়। এ প্রসঙ্গে রাসূলের সুস্পষ্ট বাণী রয়েছে।

(জ) যখন ক্রোধ আসবে, তখন أعوذ بالله من الشيطان الرجيم পড়ে নিতে হবে।

মু‘মিনের বিশেষ গুণ হল সে সব সময় উভয় জগতের মঙ্গলজনক কাজে সচেষ্ট থাকে, যেমন হাদিসে বর্ণিত ব্যক্তি উপদেশের জন্য রাসূলের উপস্থিতিকে সুবর্ণ সুযোগ মনে করে রাসূল থেকে বারংবার উপদেশ চাচ্ছিলেন, যা তার জীবনের পাথেয় হবে। বর্তমান যুগে আল্লাহর পথে আহ্বায়ক ও আলেম সম্প্রদায়ের উপস্থিতি আল্লাহর অনুগ্রহ মনে করে তাদের শিক্ষা, আদেশ ও উপদেশ থেকে উপকৃত হওয়া উচিত।

পর্ব ১ | পর্ব ২ | পর্ব ৩ | পর্ব ৪| পর্ব ৫ | পর্ব ৬ | পর্ব ৭| পর্ব ৮ | পর্ব ৯ | পর্ব ১০


৩৭. সূরা আল-হজ্জ, আয়াত : ৩০
৩৮. ইমাম আল-গাজ্জালী, কিমিয়ায়ে সা‘আদাত, খণ্ড ১, পৃ. ৪
৩৯. বুখারী, হাদীস নং-৫৬৫১
৪০. সূরা আলে ইমরান, আয়াত : ১৩৪
৪১. আলবানী, সহীহুল জামে, ২য় খণ্ড, পৃ. ১১১২, হাদীস নং- ৬৫২২
৪২.সূরা আলে ইমরান, আয়াত : ১৩৩, ১৩৪


মুসলিম জীবনের আদব-কায়দা পর্ব -১

$
0
0

Adab in Muslim Life QA

লেখক: ড. মো: আমিনুল ইসলাম | সম্পাদনা: ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া

আদব-কায়দা’র পরিচয়, গুরুত্ব ও তাৎপর্য

১. আদব-কায়দা’র পরিচয়:

আদব শব্দটি আরবি  ” أدب “শব্দ থেকে বাংলা ভাষায় বহুল ব্যবহৃত ও প্রচলিত শব্দ; যার অর্থ হলো: বিনয়, নম্রতা, ভদ্রতা, সভ্যতা, কৃষ্টি, সুশিক্ষা, নৈতিকতা, মানবিকতা, শোভনতা, শিষ্টাচার।[1] আবার  ” أدب “শব্দের অর্থ: নিয়মনীতি, পদ্ধতি ইত্যাদি।  আর আদব-কায়দা মানে— ভদ্র সমাজের রীতি-পদ্ধতি; ভদ্র ব্যবহার। অন্যভাবে বলা যায়: আদব-কায়দা মানে কাঙ্খিত শিক্ষা, সভ্যতা ও মার্জিত সংস্কৃতির দ্বারা আত্মগঠনের অনুশীলন করা।[2]

ইবনু হাজার ‘আসকালানী রহ. বলেন:

« الأدب: استعمال ما يحمد قولاً وفعلاً » .

“কথায় ও কাজে প্রশংসনীয় ব্যবহারকে আদব বলে।”[3]

আবার কেউ বলেন:

« الأخذ بمكارم الأخلاق » .

“উত্তম চরিত্র লালন করাকে আদব বলে।”[4]

আবার কেউ কেউ বলেন:

« هو تعظيم من فوقك والرفق بمن دونك » .

“আদব হলো ঊর্ধ্বতন ব্যক্তিকে সম্মান করা এবং অধস্তনকে স্নেহ করা।”[5]

কেউ কেউ বলেন:

« الأدب هو حسن الأخلاق وفعل المكارم » .

“আদব মানে উত্তম চরিত্র এবং ভালো কাজ।”[6]

আর ইবনুল কায়্যিম রহ. বলেন:

« الأدب اجتماع خصال الخير في العبد » .

“বান্দার মধ্যে উত্তম বৈশিষ্ট্যের সমাবেশ ঘটানোকে আদব বলে।”[7]

আবার কেউ কেউ বলেন:

« والأدب هو الخصال الحميدة » .

“প্রশংসনীয় বৈশিষ্ট্যসমূহকেই আদব বলে।”[8]

আর আমাদের দেশীয় ভাষায় বিনয়, নম্রতা, ভদ্রতা, সভ্যতা, কৃষ্টি, সুশিক্ষা, নৈতিকতা, মানবিকতা, শোভনতা ইত্যাদি গুণাবলী যে ব্যক্তির মধ্যে বিদ্যমান থাকে, তাকে ‘মুয়াদ্দাব’ (শালীন, ভদ্র ও সুশিক্ষিত) বলে। আর এসব গুণাবলী যার মধ্যে বিদ্যমান নেই, তাকে ‘বেয়াদব’ (অশালীন, অভদ্র, অসভ্য) বলে।

২. আদব-কায়দা’র গুরুত্ব ও তাৎপর্য:

মানবজীবন তথা মুসলিম ব্যক্তির জীবনে আদব-কায়দার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যবহুল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

« إِنَّ الْهَدْىَ الصَّالِحَ ، وَالسَّمْتَ الصَّالِحَ ، وَالاِقْتِصَادَ جُزْءٌ مِنْ خَمْسَةٍ وَعِشْرِينَ جُزْءًا مِنَ النُّبُوَّةِ » . (رواه أبو داود).

“নিশ্চয়ই উত্তম চরিত্র, ভালো ব্যবহার ও পরিমিত ব্যয় বা মধ্যপন্থা অবলম্বন করা নবুয়্যাতের পঁচিশ ভাগের এক ভাগ সমতুল্য।”[9]

আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা বলেন:

« اُطْلُبْ الْأَدَبَ فَإِنَّهُ زِيَادَةٌ فِي الْعَقْلِ ، وَدَلِيلٌ عَلَى الْمُرُوءَةِ ، مُؤْنِسٌ فِي الْوَحْدَةِ ، وَصَاحِبٌ فِي الْغُرْبَةِ ، وَمَالٌ عِنْدَ الْقِلَّةِ » . (ذَكَرَهُ الْحَاكِمُ فِي تَارِيخِهِ).

“তুমি আদব অন্বেষণ কর; কারণ, আদব হলো বুদ্ধির পরিপুরক, ব্যক্তিত্বের দলীল, নিঃসঙ্গতায় ঘনিষ্ঠ বন্ধু, প্রবাসজীবনের সাথী এবং অভাবের সময়ে সম্পদ।”[10]

আর আদব বা শিষ্টাচার এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যার দ্বারা ব্যক্তির জীবন পরিশুদ্ধ ও পরিপাটি হয়; আর এ আদব হলো দীন ইসলামের সারবস্তু; সুতরাং মুসলিম ব্যক্তির জন্য জরুরি হলো আল্লাহ তা‘আলার সাথে, তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে এবং সাধরণ মানুষসহ সকল সৃষ্টির সাথে আদব রক্ষা করে চলা; আর এ আদবের মাধ্যমেই একজন মুসলিম জানতে পারবে তার খাবার ও পানীয় গ্রহণের সময় তার অবস্থা কেমন হওয়া উচিৎ; কিভাবে তার সালাম প্রদান, অনুমতি গ্রহণ, বসা, কথা বলা, আনন্দ ও শোক প্রকাশ করা, হাঁচি দেওয়া ও হাই তোলার মত বিবিধ কাজ সম্পন্ন হবে; আর কেমন ব্যবহার হবে তার পিতামাতা, ভাইবোন, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী ও বন্ধু-বান্ধবদের সাথে। এক কথায় এ আদব-কায়দা রক্ষা করে চলার মাধ্যমেই একজন মুসলিম কাঙ্খিত মানের ভদ্র ও সভ্য মানুষ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে এবং নিজেকে অন্যান্য জাতির চেয়ে ভিন্ন বৈশিষ্ট্যে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হবে; ফলে দীন ইসলামের সৌন্দর্য ছড়িয়ে যাবে সমাজ, রাষ্ট্র ও দুনিয়ার দিক দিগন্তে। তাইতো কেউ কেউ শিক্ষার চেয়ে আদব বা শিষ্টাচারের বিষয়টিকে অধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকেন; ওমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন:

« تَأَدَّبُوا ثُمَّ تَعَلَّمُوا » .

“তোমরা আগে সুসভ্য হও, তারপর জ্ঞান অর্জন কর।”[11]

আল-কারাফী তাঁর ‘আল-ফারুক’ গ্রন্থে বলেন:

«وَاعْلَمْ أَنَّ قَلِيلَ الْأَدَبِ خَيْرٌ مِنْ كَثِيرٍ مِنْ الْعَمَلِ » .

“আর জেনে রাখবে, অনেক বেশি কাজের চেয়ে অল্প আদব অনেক বেশি উত্তম।”[12]

আবদুল্লাহ ইবনুল মুবারক বলেন:

« لَا يَنْبُلُ الرَّجُلُ بِنَوْعٍ مِنْ الْعِلْمِ مَا لَمْ يُزَيِّنْ عِلْمَهُ بِالْأَدَبِ » .

“ব্যক্তি কোনো প্রকার জ্ঞান দ্বারা মহৎ হতে পারবে না, যতক্ষণ না সে তার জ্ঞানকে আদব দ্বারা সৌন্দর্যমণ্ডিত করবে।”[13]

তিনি আরও বলেন:

« نَحْنُ إلَى قَلِيلٍ مِنْ الْأَدَبِ أَحْوَجُ مِنَّا إلَى كَثِيرٍ مِنْ الْعِلْمِ » .

“আমরা অনেক বেশি জ্ঞানের চেয়ে কম আদবকে অনেক বেশি জরুরি বা প্রয়োজন মনে করতাম।”[14]

কোনো কোনো দার্শনিক বলেন:

« لَا أَدَبَ إلَّا بِعَقْلٍ ، وَلَا عَقْلَ إلَّا بِأَدَبٍ » .

“আকল (বুদ্ধি) ছাড়া আদব হয় না; আবার আদব ছাড়া আকলও হয় না।”[15]

অর্থাৎ একটি আরেকটির পূরিপূরক। আর জনৈক সৎব্যক্তি তার ছেলেকে উদ্দেশ্য করে বললেন:

« اجْعَلْ عَمَلَك مِلْحًا وَأَدَبَك دَقِيقًا » .

“তুমি তোমার আমলকে মনে করবে লবণ, আর তোমার আদবকে মনে করবে ময়দা।”[16]

অর্থাৎ তুমি আমলের চেয়ে আদবকে এত বেশি গুরুত্ব দিবে, লবণ ও ময়দার স্বাভাবিক মিশ্রণে উভয়ের অনুপাত যেভাবে কম বেশি হয়।

[1] ড. মুহাম্মদ মুস্তাফিজুর রহমান, আল মুনীর আরবী-বাংলা অভিধান, দারুল হিকমা বাংলাদেশ, প্রকাশকাল: জুলাই ২০১০ খ্রি., পৃ. ১৫; বাংলা একাডেমী ব্যবহারিক বাংলা অভিধান, পরিমার্জিত সংষ্করণ: ডিসেম্বর ২০০০, পৃ. ১০৩
[2] আল-মু‘জাম আল-অসীত, দ্র: ” أدب ”
[3] ‘মাউসু‘য়াতুল বাহুছ ওয়াল মাকালাতুল ‘ইলমিয়্যা’ ( موسوعة البحوث و المقالات العلمية ), পৃ. ১ (আল-মাকতাবা আশ-শামেলা, আল-ইসদার আস-সানী)। ”
[4] প্রাগুক্ত।
[5] প্রাগুক্ত।
[6] প্রাগুক্ত।
[7] প্রাগুক্ত।
[8] প্রাগুক্ত।
[9] আবূ দাউদ, হাদিস নং- ৪৭৭৮; আলবানী হাদিসটিকে ‘হাসান’ বলেছেন।
[10] হাকেম রহ. তাঁর ‘আত-তারীখ’ গ্রন্থে বর্ণনটি উল্লেখ করেছেন।
[11] উদ্ধৃত, গিযাউল আলবাব (غذاء الألباب ), ১ম খণ্ড, পৃ. ৪৫ (আল-মাকতাবা আশ-শামেলা, আল-ইসদার আস-সানী)। ”
[12] উদ্ধৃত, ‘মাউসু‘য়াতুল বাহুছ ওয়াল মাকালাতুল ‘ইলমিয়্যা’ ( موسوعة البحوث و المقالات العلمية ), পৃ. ১ (আল-মাকতাবা আশ-শামেলা, আল-ইসদার আস-সানী)। ”
[13] উদ্ধৃত, গিযাউল আলবাব (غذاء الألباب ), ১ম খণ্ড, পৃ. ৪৫ (আল-মাকতাবা আশ-শামেলা, আল-ইসদার আস-সানী)। ”
[14] উদ্ধৃত, ‘মাউসু‘য়াতুল বাহুছ ওয়াল মাকালাতুল ‘ইলমিয়্যা’ ( موسوعة البحوث و المقالات العلمية ), পৃ. ১ (আল-মাকতাবা আশ-শামেলা, আল-ইসদার আস-সানী)। ”
[15] উদ্ধৃত, গিযাউল আলবাব (غذاء الألباب ), ১ম খণ্ড, পৃ. ৪৫ (আল-মাকতাবা আশ-শামেলা, আল-ইসদার আস-সানী)। ”
[16] উদ্ধৃত, ‘মাউসু‘য়াতুল বাহুছ ওয়াল মাকালাতুল ‘ইলমিয়্যা’ ( موسوعة البحوث و المقالات العلمية ), পৃ. ১ (আল-মাকতাবা আশ-শামেলা, আল-ইসদার আস-সানী)। “

মুসলিম জীবনের আদব-কায়দা পর্ব -২

$
0
0

Adab in Muslim Life QAলেখক: ড. মো: আমিনুল ইসলাম | সম্পাদনা: ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া

নিয়তের আদবসমূহ

মুসলিম ব্যক্তি নিয়তের মর্যাদা ও প্রভাবের প্রতি বিশ্বাস করে এবং আরও বিশ্বাস করে তার ধর্মীয় ও জাগতিক জীবনের সকল কর্মকাণ্ডের জন্য নিয়তের গুরুত্বকে। কারণ, নিয়তের দ্বারাই সকল কাজের অস্তিত্ব লাভ করে এবং নিয়ত অনুযায়ীই তার রূপ-প্রকৃতি তৈরি হয়; ফলে সে অনুসারে তা শক্তিশালী হয়, দুর্বল হয়, শুদ্ধ হয় এবং নষ্ট হয়; আর মুসলিম ব্যক্তি প্রত্যেক কাজে নিয়তের প্রয়োজনীয়তা ও তা বিশুদ্ধকরণের আবশ্যকতার বিষয়টিকেও বিশ্বাস করে। এ ব্যাপারে সে প্রথমত আল্লাহর বাণী থেকে দলীল গ্রহণ করে; আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

[وَمَآ أُمِرُوٓاْ إِلَّا لِيَعۡبُدُواْ ٱللَّهَ مُخۡلِصِينَ لَهُ ٱلدِّينَ [البينة: ٥

“আর তাদেরকে কেবল এ নির্দেশই প্রদান করা হয়েছিল যে, তারা যেন আল্লাহর ইবাদত করে তাঁরই জন্য দ্বীনকে একনিষ্ঠ করে।”[1]

আল্লাহ সুবহানহু ওয়া তা‘আলা আরও বলেন:

[قُلۡ إِنِّيٓ أُمِرۡتُ أَنۡ أَعۡبُدَ ٱللَّهَ مُخۡلِصٗا لَّهُ ٱلدِّينَ  [الزمر: ١١

“বলুন, ‘আমি তো আদেশপ্রাপ্ত হয়েছি, আল্লাহ‌র আনুগত্যে একনিষ্ঠ হয়ে তাঁর ‘ইবাদাত করতে।”[2]

আর দ্বিতীয়ত দলীল গ্রহণ করে মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী থেকে, তিনি বলেন:

( إنَّمَا الأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِ ، وَإِنَّمَا لِكُلِّ امْرِئٍ مَا نَوَى  . (متفق عليه

“প্রত্যেক কাজ নিয়তের সাথে সম্পর্কিত; আর প্রত্যেক ব্যক্তি তার নিয়ত অনুযায়ী ফল পাবে।”[3]

তিনি আরও বলেন:

إِنَّ اللَّهَ لاَ يَنْظُرُ إِلَى صُوَرِكُمْ وَأَمْوَالِكُمْ ، وَلَكِنْ يَنْظُرُ إِلَى قُلُوبِكُمْ وَأَعْمَالِكُمْ   (رواه مسلم

“নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের চেহারা ও সম্পদের দিকে তাকান না, বরং তিনি তোমাদের অন্তর ও কর্মের দিকে লক্ষ্য করেন।”[4]

আর অন্তরের দিকে লক্ষ্য করা মানে নিয়তের দিকে লক্ষ্য করা; কেননা, নিয়ত হলো কাজের উদ্দেশ্য ও প্রতিরক্ষক। অপর এক হাদিসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

( مَنْ هَمَّ بِحَسَنَةٍ فَلَمْ يَعْمَلْهَا كُتِبَتْ لَهُ حَسَنَةٌ  (رواه مسلم

“যে ব্যক্তি ভালোকাজের পরিকল্পনা করল, কিন্তু বাস্তবে সে কাজ করতে পারল না, সে ব্যক্তির জন্য সাওয়াব লেখা হবে।”[5]

সুতরাং শুধু ভালোকাজের পরিকল্পনা করার দ্বারাই কাজটি ভালোকাজ হিসেবে গণ্য হয়ে যায়, প্রতিদান সাব্যস্ত হয়, সাওয়াব অর্জন হয়; আর এটা শুধু ভালো নিয়তের ফযীলতের করণেই সম্ভব হয়। অপর এক হাদিসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

 مَثَلُ هَذِهِ الْأُمَّةِ كَمَثَلِ أَرْبَعَةِ نَفَرٍ : رَجُلٌ آتَاهُ اللَّهُ مَالًا وَعِلْمًا ، فَهُوَ يَعْمَلُ بِعِلْمِهِ فِي مَالِهِ يُنْفِقُهُ فِي حَقِّهِ ، وَرَجُلٌ آتَاهُ اللَّهُ عِلْمًا وَلَمْ يُؤْتِهِ مَالًا ، فَهُوَ يَقُولُ : لَوْ كَانَ لِي مِثْلُ هَذَا عَمِلْتُ فِيهِ مِثْلَ الَّذِي يَعْمَلُ ، قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : فَهُمَا فِي الْأَجْرِ سَوَاءٌ . وَرَجُلٌ آتَاهُ اللَّهُ مَالًا وَلَمْ يُؤْتِهِ عِلْمًا ، فَهُوَ يَخْبِطُ فِي مَالِهِ يُنْفِقُهُ فِي غَيْرِ حَقِّهِ ، وَرَجُلٌ لَمْ يُؤْتِهِ اللَّهُ عِلْمًا وَلَا مَالًا ، فَهُوَ يَقُولُ : لَوْ كَانَ لِي مِثْلُ هَذَا عَمِلْتُ فِيهِ مِثْلَ الَّذِي يَعْمَلُ ، قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى  اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : فَهُمَا فِي الْوِزْرِ سَوَاءٌ  (رواه ابن ماجه

“এ উম্মতের দৃষ্টান্ত চার ব্যক্তির দৃষ্টান্তের মত: ১. এক ব্যক্তি হলো আল্লাহ তাকে সম্পদ ও ‘ইলম (জ্ঞান) দান করেছেন, অতঃপর সে তার জ্ঞান দ্বারা আমল করে তার সম্পদকে হক পথে খরচ করে; ২. আরেক ব্যক্তি হলো আল্লাহ তাকে ‘ইলম দান করেছেন, কিন্তু তাকে সম্পদ দেননি, অতঃপর সে বলে: আমার যদি এ ব্যক্তির মত সম্পদ থাকত, তাহলে আমি সে ক্ষেত্রে সে ব্যক্তির মতই কাজ করতাম; রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: সাওয়াবের ক্ষেত্রে তারা উভয়ে সমান। ৩. অপর আরেক ব্যক্তি হলো আল্লাহ তাকে সম্পদ দান করেছেন, কিন্তু তাকে ‘ইলম দেননি, অতঃপর সে তার সম্পদের ক্ষেত্রে এলোমেলোভাবে কাজ করে তা অন্যায় পথে খরচ করে; ৪. অপর আরেক ব্যক্তি হলো আল্লাহ তাকে সম্পদ ও ‘ইলম কোনটিই দান করেননি, অতঃপর সে বলে: আমার যদি এ ব্যক্তির মত সম্পদ থাকত, তাহলে আমি সে ক্ষেত্রে সে ব্যক্তির মতই কাজ করতাম; রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: গুনাহের ক্ষেত্রে তারা উভয়ে সমান।”[6]

সুতরাং ভালো নিয়তকারী ব্যক্তিকে ভালোকাজের সাওয়াব দেওয়া হয়; আর মন্দ নিয়তকারী ব্যক্তিকে মন্দকাজের মন্দ প্রতিদান দেওয়া হয়; আর এর একমাত্র কারণ হল নিয়ত।

আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাবুক যুদ্ধের সময় তাবুকে অবস্থান কালে বলেন:

 لَقَدْ تَرَكْتُمْ بِالْمَدِينَةِ أَقْوَامًا مَا سِرْتُمْ مَسِيرًا ، وَلاَ أَنْفَقْتُمْ مِنْ نَفَقَةٍ ، وَلاَ قَطَعْتُمْ مِنْ وَادٍ إِلاَّ وَهُمْ مَعَكُمْ فِيهِ ». قَالُوا : يَا رَسُولَ اللَّهِ وَكَيْفَ يَكُونُونَ مَعَنَا وَهُمْ بِالْمَدِينَةِ ؟ فَقَالَ : حَبَسَهُمُ الْعُذْرُ  فَشَرَكُوا بِحُسْنِ النيةِ – رواه أبو داود و البخاري

“তোমরা মদীনাতে এমন সম্প্রদায়কে রেখে এসেছ, যারা কোনো দূরপথ ভ্রমণ করেনি, কোনো অর্থ-সম্পদ খরচ করেনি এবং কোনো উপত্যকাও অতিক্রম করেনি, তবুও তারা তোমাদের সাথে (সাওয়াবে) শরীক রয়েছে। সাহাবায়ে কিরাম রা. নিবেদন করলেন: তারা কিভাবে আমাদের সাথে সাওয়াবের অংশীদার হবে, অথচ তারা মদীনাতেই ছিল? তখন তিনি বললেন: ‘ওযর’ তাদেরকে আটকিয়ে রেখেছিল। (তারা ভালো নিয়তের মাধ্যেমে আমাদের সাথে শরীক হয়েছে)।”[7]

সুতরাং ভালো নিয়তের কারণে গাযী না হয়েও গাযীর মত সাওয়াবে অংশীদার হবে, আর মুজাহিদ না হয়েও মুজাহিদের মত সাওয়াব পাবে। অপর এক হাদিসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

 إِذَا التَقَى الْمُسْلِمَانِ بِسَيْفَيْهِمَا فَالْقَاتِلُ وَالْمَقْتُولُ فِى النَّارِ فَقِيلَ : يَا رَسُولَ اللَّهِ ! هَذَا الْقَاتِلُ ، فَمَا بَالُ الْمَقْتُولِ ؟ فَقَالَ :  إِنَّهُ قَدْ أَرَادَ قَتْلَ صَاحِبِهِ  (متفق عليه

“যখন দু’জন মুসলিম তাদের তরবারি নিয়ে মুখোমুখি হবে, তখন হত্যাকারী ও নিহত ব্যক্তি উভয়ে জাহান্নামে যাবে। প্রশ্ন করা হল: হে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম! এ হত্যাকারী (তো অপরাধী), কিন্তু নিহত ব্যক্তির কী অপরাধ? তখন তিনি বললেন: কারণ, সে তার সঙ্গীকে হত্যা করার ইচ্ছা (নিয়ত) করেছিল।”[8]

সুতরাং হত্যাকারী ও নিহত ব্যক্তির মাঝে জাহান্নাম আবশ্যক হওয়ার বিষয়টিকে সমান করে দিল তাদের উভয়ের মন্দ নিয়ত ও খারাপ উদ্দেশ্য। তার নিয়ত যদি খারাপ না হত, তাহলে সে জান্নাতের অধিবাসী হত। অন্য এক হাদিসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

( من تَزوَّج بصدَاقٍ لا يَنْوِي أداءَهُ فهو زَانٍ , و من أدَانَ دَيْناً و هو لا يَنْوِي قَضَاءَهُ فهو سارقٌ  (رواه أحمد و ابن ماجه

“যে ব্যক্তি এমন পরিমাণ মোহরের বিনিময়ে বিয়ে করেছে, যা সে পরিশোধ করার নিয়ত নেই, সে ব্যক্তি ব্যভিচারী; আর যে ব্যক্তি এমন ঋণ গ্রহণ করেছে, যা তার পরিশোধ করার ইচ্ছা নেই, সে ব্যক্তি চোর।”[9]

সুতরাং মন্দ নিয়ত বৈধ জিনিসকে হারামে রূপান্তরিত করল এবং জায়েয বিষয়কে নিষিদ্ধ বস্তুতে পরিণত করল; আর যা সমস্যামুক্ত ছিল, তা সমস্যাযুক্ত হয়ে গেল।

এ সব কিছুই মুসলিম ব্যক্তি যে নিয়তের মর্যাদা ও প্রভাব এবং তার বড় ধরনের গুরুত্বের প্রতি গভীর বিশ্বাস ও নিবিড় আস্থা পোষণ করে, সে বিষয়টিকে আরও মজবুত করে; ফলে সে বিশুদ্ধ নিয়তের উপর তার সকল কর্মকাণ্ডের ভিত রচনা করে; ঠিক অনুরূপভাবে সে সর্বাত্মক চেষ্টা সাধনা করে যাতে তার একটি কাজও নিয়ত ছাড়া বা বিশুদ্ধ নিয়ত ছাড়া সংঘটিত না হয়; কারণ, নিয়ত হলো কর্মের প্রাণ ও ভিত্তি; সুতরাং নিয়ত সঠিক তো কাজও সঠিক, আর নিয়ত শুদ্ধ নয় তো কাজও শুদ্ধ নয়; আর কর্তার বিশুদ্ধ নিয়ত ব্যতীত কাজ হলো মোনাফেকী, কৃত্রিম, নিন্দিত ও ঘৃণিত।

আর অনুরূপভাবে মুসলিম ব্যক্তি বিশ্বাস করে যে, আমলসমূহ বিশুদ্ধ হওয়ার অন্যতম রুকন ও শর্ত হলো নিয়ত; তারপর সে মনে করে যে, নিয়ত শুধু মুখে (হে আল্লাহ! আমি এরূপ নিয়ত করেছি) উচ্চারণ করার নাম নয়, আবার নিয়ত বলতে শুধু মনের ভাবকেই বুঝায় না, বরং নিয়ত হলো সঠিক উদ্দেশ্যে— উপকার হাসিল বা ক্ষতি থেকে বাঁচার জন্য যথাযথ কাজের প্রতি মনের ঝোঁক বা জাগরণ এবং অনুরূপভাবে আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য অথবা তাঁর নির্দেশ পালনের উদ্দেশ্যে কাজের প্রতি মনোযোগ দেওয়া।

আর মুসলিম ব্যক্তি যখন বিশ্বাস করে যে, ভালো নিয়তের কারণে বৈধ কাজ প্রতিদান ও সাওয়াবের উপযুক্ত আনুগত্যে পরিণত হয় এবং বিশুদ্ধ নিয়তের অভাবে সাওয়াবের কাজও গুনাহ্ ও শাস্তির উপযুক্ত অন্যায় ও অবাধ্যতায় পরিণত হয়, তখন সে মনে করে না যে, অন্যায় ও অবাধ্যতার ক্ষেত্রে ভালো নিয়তের ফলে তা সাওয়াবের কাজে পরিণত হয়; সুতরাং যিনি কোনো ব্যক্তির গিবত করবেন অপর কোনো ব্যক্তির মন ভালো করার জন্য, তিনি এ ক্ষেত্রে আল্লাহ তা‘আলার অবাধ্য ও পাপী বলে বিবেচিত হবেন, তার তথা কথিত ভালো নিয়ত এখানে তার কোনো উপকারে আসবে না; আর যে ব্যক্তি হারাম অর্থ দ্বারা মাসজিদ নির্মাণ করবে, তাকে এ কাজের জন্য সাওয়াব দেয়া হবে না; আর যে ব্যক্তি নাচ-গান ও রঙ্গ-তামাশার অনুষ্ঠানে হাজির হয় জিহাদ ও অনুরূপ কোনো কাজে উৎসাহ পাওয়ার জন্য অথবা লটারীর টিকেট ক্রয় করে কল্যাণমূলক কাজে উৎসাহিত করার নিয়তে, সে ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলার অবাধ্য ও পাপী বলে বিবেচিত হবে এবং সাওয়াব পাওয়ার পরিবর্তে গুনাহগার হবে; আর যে ব্যক্তি সৎ ব্যক্তিগণের প্রতি ভালোবাসার নিয়তে তাদের কবরের উপর গম্বুজ তৈরি করবে অথবা তাদের উদ্দেশ্যে পশু যবাই করবে অথবা তাদের জন্য মানত করবে, সে ব্যক্তিও তার এ কাজের জন্য আল্লাহ তা‘আলার অবাধ্য ও পাপী বলে বিবেচিত হবে, যদিও তার ধারণা মতে তার নিয়তটি ভালো হয়ে থাকে; কারণ, অনুমোদিত ‘মুবাহ’ (বৈধ) কাজের ক্ষেত্রে ছাড়া অন্য কোনো কাজই সৎ নিয়তের কারণে সাওয়াবের কাজ বলে গণ্য হবে না; আর হারাম কাজ তো কোনো অবস্থাতেই সাওয়াবের কাজে রূপান্তরিত হবে না।[10]


[1] সূরা আল-বায়্যেনা, আয়াত: ৫

[2] সূরা আয-যুমার, আয়াত: ১১

[3] বুখারী, হাদিস নং- ১; মুসলিম, হাদিস নং- ৫০৩৬

[4] মুসলিম, হাদিস নং- ৬৭০৮

[5] মুসলিম, হাদিস নং- ৩৫৪

[6] ইবনু মাজাহ, হাদিস নং- ৪২২৮; তিনি হাদিসটি উত্তম সনদে বর্ণনা করেছেন।

[7] আবূ দাউদ, হাদিস নং- ২৫১০; বুখারী, হাদিস নং- ৪১৬১

[8] বুখারী, হাদিস নং- ৩১ ও ৬৬৭২; মুসলিম, হাদিস নং- ৭৪৩৪

[9] হাদসটি ইমাম আহমাদ ও ইবনু মাজাহ রহ. বর্ণনা করেছেন এবং ইবনু মাজাহ রহ. ‘মোহর’-এর বিষয়টিকে বাদ দিয়ে শুধু ‘ঋণ’-এর বিষয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখে বর্ণনা করেছেন।

[10] আবূ বকর আল-জাযায়েরী, মিনহাজুল মুসলিম, দারুশ্ শুরুক, জেদ্দা, চতুর্থ সংস্করণ, দশম মুদ্রণ: ১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দ, পৃ. ১০৩

একজন ঈমানদার দা‘ঈর বর্জিত গুণাবলি পর্ব ৫

$
0
0

DawahMission_Gloucester_FB-01

লেখক:মুহাম্মদ শাহিদুল ইসলাম

পর্ব ১ | পর্ব ২ | পর্ব ৩ | পর্ব ৪| পর্ব ৫ | পর্ব ৬ | পর্ব ৭| পর্ব ৮ | পর্ব ৯ | পর্ব ১০

পরনিন্দা (গীবত)

গীবত পরিচিতি

গীবত(غيبة) আরবী শব্দ। আভিধানিক অর্থ-কুৎসা, পরনিন্দা, পরচর্চা, পরোক্ষে নিন্দা ইত্যাদি। কারো অগোচরে তার পোশাক-পরিচ্ছদ, বংশ, চরিত্র, দেহাকৃতি, কর্ম, দ্বীন, চলাফেরা, ইত্যাদি যে কোনো বিষয়ে কোন দোষ অপরের কাছে প্রকাশ করা।

ইবনুল আছীর রহ. বলেছেন :

গীবত হলো কোন মানুষের অগোচরে তার মন্দ বিষয় উল্লেখ করা, যদিও সে ত্রুটি তার মধ্যে বিদ্যমান থাকে।৪৩

এ প্রসঙ্গে হাসান বসরী (রহ.) বলেন :

পরচর্চায় তিন ধরণের পাপ হতে পারে। অপরের মধ্যে যে দোষ বিদ্যমান তা আলোচনা করা গীবত; যে ত্রুটি তার মধ্যে নেই তা আলোচনা করা অপবাদ; আর তার সম্বন্ধে যা কিছু শ্রুত তা আলোচনা করা মিথ্যা বলার শামিল।৪৪

গীবতের পরিচয় সম্পর্কে হাদীসের এক বর্ণনায় এসেছে,

“মুত্তালিব ইবনু আব্দিল্লাহ রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন : রাসূলুল্লাহ  বলেছেন :

عن المطلب بن عبد الله قال : قال رسول الله صلي الله عليه وسلم: الغيبة أن تذكر الرجل بما فيه من خلفه

গিবত হলো কোনো ব্যক্তি সম্বন্ধে তার অগোচরে এমন কিছু বলা যা তার মধ্যে বিদ্যমান।”৪৫

হাদীসের অপর এক বর্ণনায় এসেছে,

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ أَتَدْرُونَ مَا الْغِيبَةُ قَالُوا اللَّهُ وَرَسُولُهُ أَعْلَمُ قَالَ ذِكْرُكَ أَخَاكَ بِمَا يَكْرَهُ قِيلَ أَفَرَأَيْتَ إِنْ كَانَ فِي أَخِي مَا أَقُولُ قَالَ إِنْ كَانَ فِيهِ مَا تَقُولُ فَقَدْ اغْتَبْتَهُ وَإِنْ لَمْ يَكُنْ فِيهِ فَقَدْ بَهَتَّهُ

“আবূ হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন : একদা রাসূলুল্লাহ () জিজ্ঞেস করলেন : তোমরা কি জান গীবত কাকে বলে? সাহাবায়েকিরাম রা. উত্তর করলেন : আল্লাহ ও তদীয় রাসূলই সম্যক জ্ঞাত। তিনি বললেন : গীবত হলো তোমার ভাই সম্পর্কে এমন কিছু বলা যা তাকে নাখোশ করবে। জানতে চাওয়া হলো : যদি আমার ভাইয়ের মধ্যে তা বিদ্যমান থাকে তাহলেও কি? তিনি জবাবে বললেন : তোমার ভাইয়ের মধ্যে যা কিছু বিদ্যমান তা বললেই গীবত হবে; অন্যথায় তুমি তাকে অপবাদ দিলে।”৪৬ 

অন্য এক বর্ণনায় এসেছে,

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ الْغِيبَةُ ذِكْرُكَ أَخَاكَ بِمَا يَكْرَه 

আবূ হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন : রাসূলুল্লাহ  বলেছেন : গিবত হলো তোমার ভাই সম্বন্ধে এমন কিছু বলা যা সে অপছন্দ করে।৪৭

গিবত সংঘটিত হওয়ার উদাহরণ

গিবত সাধারণত মুখ দ্বারাই সংঘটিত হয়ে থাকে। কারণ গিবত হলো অপরের অগোচরে তার সম্বন্ধে অপছন্দনীয়। তবে মুখ ছাড়া মানব দেহের যে সকল অঙ্গ ব্যবহার করে অন্যের দোষ-ত্রুটি উল্লেখ করা হয় তাও গিবতের পর্যায়ভূক্ত। যেমন হাতের ইঙ্গিত ও লেখনি; চোখের ইঙ্গিত; পা দ্বারা অভিনয় করে অন্যকে হেয় করা গিবতের শামিল। এ ছাড়া কান দ্বারা গিবত শ্রবণ করা বা অন্তরে অন্তরে অপরের দোষক্রুতি চর্চা করা বা তাকে তুচ্ছ জ্ঞান করা সহ তার মর্যাদাহানিকর সকল চর্চাই মুখের গিবতের সমপর্যায়ের।

হাদীসে এসেছে, আয়েশা (রা.) বলেন : জনৈকা মহিলা আমাদের কাছে এসেছিল। তার চলে যাওয়ার পর আমি হাতের ইশারায় তার খর্বতার কথা উল্লেখ করলাম। তখন রাসূলুল্লাহ () বললেন : তুমি ঐ মহিলার গিবত করলে।

  • এমনিভাবে খঞ্জ বা টেরা চক্ষু বিশিষ্ট কোন ব্যক্তির চলন ও চাহনি অনুসরণে কেউ খুড়িয়ে চললে বা টেরা চক্ষে তাকালে উক্ত ব্যক্তির গিবত করা হয়। তবে ব্যক্তি বিশেষের নামোল্লেখ না করে যদি কেউ সাধারণভাবে বলে যে, খঞ্জ ব্যক্তি এভাবে হাটে, টেরা চক্ষু বিশিষ্ট ব্যক্তি এভাবে তাকায় এবং তাতে দর্শকগণ বিশেষ কারো চলন ও চাহনি বুঝতে না পারে তাহলে তা গিবত হবে না। অর্থাৎ আকার-ইঙ্গিতে নিন্দিত ব্যক্তিকে চেনা গেলে তা গিবত হবে; অন্যথায় গিবত হবে না।
  • লেখনির মাধ্যমে গিবত : কলম মানুষের মনের অনুভূতি প্রকাশের একটি মাধ্যম। তাই মুখের দ্বারা যেমন গিবত সংঘটিত হয় তেমনি লেখনির মাধ্যমেও গিবত হয়ে থাকে। যেমন  শরয়ী উপকার বা সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় স্বার্থ সংরক্ষণ ব্যতীত বেহুদা অন্যের দোষ-ত্রুটি লেখনির মাধ্যমে প্রচার করা গিবতের শামিল। তবে বিশেষ কাউকে নির্দিষ্ট না করে কোন দল বা গোষ্ঠির গঠনমূলক সমালোচনা করায় কোন দোষ নেই। বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (স.) কোন জাতি বা গোষ্ঠীর কোন কাজকে অপছন্দ করলে বলতেন : ঐ লোকগুলোর কি হলো যে তারা এসব কাজ করছে।
  • অন্তর দ্বারা গিবত: অন্তরের গিবত হলো মনে মনে কারো সম্বন্ধে কু-ধারণা পোষণ করা। পবিত্র কুর’আন ও হাদীসে এ কু-ধারণা থেকে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় নিষেধ করা হয়েছে।

মহান আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

اجْتَنِبُوا كَثِيرًا مِنَ الظَّنِّ إِنَّ بَعْضَ الظَّنِّ إِثْمٌ

“তোমরা অধিকাংশ ধারণা থেকে বিরত থাকো। নিশ্চয়ই কতক ধারণা পাপের কাজ।”[সূরা হুজুরাত ১২]

হাদীসের এক বর্ণনায় এসেছে,

عَن ْأبي هريرة رضي الله عنه قال قال رسول الله ِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : إِيَّاكُمْ وَالظَّنَّ فَإِنَّ الظَّنَّ أَكْذَبُ الْحَدِيثِ

আবূ হুরাইরা রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন; রাসূল  বলেছেন : তোমরা ধারণা পোষণ থেকে দূরে থাকো। নিশ্চয়ই ধারণা করা কঠিনতম মিথ্যা।৪৮

এছাড়া কখনও এমন হয় যে, গিবতকারী কারো নাম উল্লেখ না করে এভাবে বলে, আজ আমার নিকট যে লোকটি এসেছিল সে এরূপ বা একজন মানুষের এরকম ত্রুটি রয়েছে আমি তার নাম বলবো না তবে আপনারা বুঝে থাকলে বুঝতে পারেন। এক্ষেত্রে গিবতকারী এ ধরণের উক্তিকে গিবত বহির্ভূত মনে করে; কিন্তু বাস্তবে তা গিবতের অন্তর্ভূক্ত।

  • কৌশলগত গিবত : এ ধরণের গিবত অধিকাংশ ক্ষেত্রে অপরিপক্ক আলিম ও দ্বীনদার লোকদের দ্বারা সংঘটিত হয়ে থাকে। বাহ্যিক দৃষ্টিতে তারা মনে করে যে, এতে কোন দোষ নেই বা এটা গিবতের অন্তর্ভূক্ত নয়; প্রকৃত পক্ষে তা মারাত্মক ও জঘন্য গিবত। যেমন তাদের সামনে কোন ব্যক্তির উল্লেখ করা হলে বলে : সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি আমারেদকে রাজা-বাদশাহদের দ্বারস্থ হওয়া ও তুচ্ছ জিনিসের জন্য নিজেদেরকে বিলিয়ে দেয়ার মতো পরীক্ষায় ফেলেন নাই। অথবা এভাবে বলে : আল্লাহ তায়ালার কাছে নির্লজ্জতা বা লজ্জাহীনতা থেকে পানাহ চাই; আল্লাহ তায়ালার কাছে দোয়া করি তিনি যেন আমাদেরকে তা থেকে রক্ষা করেন।

এসকল উক্তির দ্বারা দু’ধরণের অপরাধ হয়। একটি গিবত, অপরটি রিয়া বা লৌকিকতা। অর্থাৎ অপরের ত্রুটি বর্ণনার পাশাপাশি নিজের প্রশংসা নিহিত থাকে এ ধরণের উক্তির মধ্যে।

আবার কখনো এমন হয় যে, তাদের সামনে কারো গিবত করা হলে তারা বলে: সুবহানাল্লাহ ! কি আশ্চর্য! লোকটিকে তো আমরা ভাল বলেই জানতাম, তার দ্বারা এসব অপকর্ম সংঘটিত হয়েছে ! আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে রক্ষা করুন। এ সকল উক্তির দ্বারা একদিকে গিবতকারীকে সত্যায়ন করা হয় এবং তাকে উৎসাহ দেয়া হয়। অপরদিকে যারা এখনো নিন্দিত ব্যক্তির অপকর্ম জানতে পারেনি তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয় এবং তাদেরকে তা অবগত হওয়ার সুযোগ করে দেয়া হয়। এমনিভাবে তাদের সামনে কারো গিবত করা হলে তারা বলে : আল্লাহ আমাদিগকে তাওবা করার তাওফীক দিন। এসকল উক্তি দ্বারা নিজেদের জন্য বা গিবতকৃত ব্যক্তির জন্য দোয়া করা প্রকৃত উদ্দেশ্য নয়; বরং অন্যের গিবত প্রসার ও নিজের প্রশংসার জন্যই এমনটি বলা হয়ে থাকে যা বাস্তবতার আলোকে অনুমেয়। কারণ কারো কল্যাণের জন্য দোয়া করার উদ্দেশ্য থাকলে তা জনসমক্ষে উক্ত ব্যক্তির নিন্দা করার সময় না করে নির্জনে করাই শ্রেয়।৪৯

এছাড়া উপরোক্ত শ্রেণীর গিবতকারীদের গিবতের সাথে কপটতাও বিদ্যমান। কারণ বাহ্যত তার প্রতিক্রিয়া নিন্দিত ব্যক্তির স্বপক্ষে মনে হলেও বাস্তবে তার বিপরীত। এধরণের লোকদের সামনে কারো গিবত করা হলে তারা গিবতকারীকে বলে “ চুপ কর, গিবত করিওনা” এ উক্তির দ্বারা প্রকৃতপক্ষে গিবতের প্রতি অবজ্ঞা বা প্রতিবাদ উদ্দেশ্য হলে ভাল কথা; অন্যথায় তা নিফাকী বা কপটতা হিসেবে বিবেচিত হবে। কারণ শ্রোতা মণ্ডলী এই তিরষ্কারের কারণ অন্বেষণে প্রবৃত্ত হলে নিন্দিত ব্যক্তির দোষ আরো অধিক প্রকাশিত হয়ে পড়বে এবং তাতে সে নিজেও গিবতকারীর সমপর্যায়ের অপরাধী হবে।৫০

বুহতান পরিচিতি

বুহতান (بهتان) আরবী শব্দ। আভিধানিক অর্থ-অপবাদ, দুর্নাম, মিথ্যা, রটনা ইত্যাদি। ইসলামের চিরস্থায়ী বিধান হলো, কারো প্রশংসা করতে হলে তার অসাক্ষাতে আর সমালোচনা করতে হলে সাক্ষাতে করতে হয়। এ বিধান লংঘন করে যখনই কারো অসাক্ষাতে নিন্দা, সমালোচনা বা কুৎসা রটানো হয়, তখন তা শরীয়াত বিরোধী কাজে পরিণত হয়। এ ধরনের কাজ তিন রকমের হতে পারে এবং তিনটিই কবীরা গুনাহ। প্রথমত: সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে যে অভিযোগ বা দোষ আরোপ করা হয়, তা যদি মিথ্যা, বা প্রয়োজনীয় সাক্ষ্যপ্রমাণহীন হয়, তবে তা নিছক অপবাদ। আরবীতে একে বুহতান বা কাযাফ বলা হয়।

এ প্রসঙ্গে হাদীসের এক বর্ণনায় এসেছে :

আবূ হুরায়রা রা. বলেন : একদা রাসূলুল্লাহ () জিজ্ঞেস করলেন : তোমরা কি জান গীবত কী? সাহাবায়েকিরাম বললেন : আল্লাহ ও তার রাসূলই অধিক জ্ঞাত। তিনি বললেন : গীবত হলো তোমার ভাই সম্পর্কে এমন কিছু বলা যা শুনলে সে অসন্তুষ্ট হবে। বলা হলো : যদি আমার ভাইয়ের মধ্যে তা বিদ্যমান থাকে তাহলেও কি গীবত হবে? তিনি জবাবে বললেন : তোমার ভাইয়ের মধ্যে যা কিছু বিদ্যমান তা বললে গীবত হবে; আর তা না থাকলে বুহতান তথা মিথ্যা অপবাদ হবে।৫১

গীবতের শরয়ী বিধান

ইসলামী শরীয়াতে গীবত হারাম। এ প্রসেঙ্গ মহান আল্লাহ বলেন :

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا اجْتَنِبُوا كَثِيرًا مِنَ الظَّنِّ إِنَّ بَعْضَ الظَّنِّ إِثْمٌ وَلَا تَجَسَّسُوا وَلَا يَغْتَبْ بَعْضُكُمْ بَعْضًا أَيُحِبُّ أَحَدُكُمْ أَنْ يَأْكُلَ لَحْمَ أَخِيهِ مَيْتًا فَكَرِهْتُمُوهُ وَاتَّقُوا اللَّهَ إِنَّ اللَّهَ تَوَّابٌ رَحِيمٌ .

“ওহে যারা ঈমান এনেছ! তোমরা অনেক অনুমান বর্জন কর। নিশ্চয় কোন কোন অনুমান পাপ।  আর তোমরা কারও দোষ অনুসন্ধান কর না এবং একে অপরের গীবত কর না। তোমাদের মধ্যে কেউ কি তার মৃত ভাইয়ের মাংস ভক্ষণ করতে পছন্দ করবে? তোমরা তো অবশ্যই তা ঘৃণা কর। তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় আল্লাহ বড়ই তওবা কবুলকারী, পরম দয়ালু।”৫২

এ প্রসঙ্গে হাদীসের অনেক বর্ণনা রয়েছে। এক বর্ণনায় এসেছে :

عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَمَّا عُرِجَ بِي مَرَرْتُ بِقَوْمٍ لَهُمْ أَظْفَارٌ مِنْ نُحَاسٍ يَخْمُشُونَ وُجُوهَهُمْ وَصُدُورَهُمْ فَقُلْتُ مَنْ هَؤُلَاءِ يَا جِبْرِيلُ قَالَ هَؤُلَاءِ الَّذِينَ يَأْكُلُونَ لُحُومَ النَّاسِ وَيَقَعُونَ فِي أَعْرَاضِهِمْ

আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত; তিনি বলেন : রাসূলুল্লাহ () ইরশাদ করেছেন : মি’রাজের রাত্রিতে আমি একদল লোকের পাশ দিয়ে গমনের সময় দেখলাম তারা স্বীয় মুখমণ্ডল ও বক্ষের গোশ্ত পিতল বা তামার নখ দ্বারা ছিন্ন করছে। আমি জিব্রাঈলের কাছে জানতে চাইলাম এরা কারা? তিনি বললেন : ওরা মানুষের গোশত ভক্ষণ করতো ও তাদের সম্মান হরণ করতো।৫৩ 

হাদীসের অপর এক বর্ণনায় এসেছে :

عَنْ أَبِي بَرْزَةَ الْأَسْلَمِيِّ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَا مَعْشَرَ مَنْ آمَنَ بِلِسَانِهِ وَلَمْ يَدْخُلْ الْإِيمَانُ قَلْبَهُ لَا تَغْتَابُوا الْمُسْلِمِينَ وَلَا تَتَّبِعُوا عَوْرَاتِهِمْ فَإِنَّهُ مَنْ اتَّبَعَ عَوْرَاتِهِمْ يَتَّبِعُ اللَّهُ عَوْرَتَهُ وَمَنْ يَتَّبِعْ اللَّهُ عَوْرَتَهُ  َفْضَحْهُ فِي بَيْتِهِ

আবু বারযা আসলামী ও বারা ইবনে আযেব (রা.) থেকে বর্ণিত, তারা বলেন : রাসূলুল্লাহ () ইরশাদ করেছেন : হে মু’মিন সম্প্রদায়! যারা মুখে ঈমানের অঙ্গীকার করেছো; কিন্তু এখনো তা অন্তরে প্রবেশ করেনি। তোমরা মুসলমানদের অগোচরে তাদের নিন্দা করো না এবং তাদের দোষ অন্বেষণ করো না। যে ব্যক্তি তার মুসলিম ভাইয়ের দোষ অন্বেষণ করে আল্লাহ তা‘আলা তার দোষ অন্বেষণ করেন। আর আল্লাহ তা‘আলা যার দোষ অন্বেষণ করেন তাকে স্বীয় গৃহে লাঞ্ছিত করেন।৫৪

আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক (রা.) থেকে বর্ণিত; তিনি বলেছেন :

আমি যদি কারো গিবত করতে চাই তাহলে আমি আমার পিতা-মাতার গিবত করবো। কারণ তারা আমার পুণ্য পাওয়ার ব্যাপারে অধিক হক্বদার।

ইমাম গাজ্জালী (রহ.) বলেছেন :

আমরা আমাদের পূর্বসূরীদেরকে দেখেছি যে, তাঁরা নামায ও রোযার মত মহৎ ইবাদাতের চাইতেও পরনিন্দা গিবত পরিত্যাগ করাকে বড় ইবাদাত মনে করতেন। জনৈক ব্যক্তিকে বলা হলো যে, অমুক আপনার গিবত করেছেন। বিনিময়ে তিনি গিবতকারীর জন্য একঝুঁড়ি খেজুর পাঠালেন এবং বললেন : আমার কাছে এ সংবাদ পৌঁছেছে যে, আপনি আপনার পুণ্য আমার কাছে হাদিয়া পাঠিয়েছেন, তাই আমি এই খেজুরের মাধ্যমে প্রতিদান দিতে ইচ্ছা পোষণ করছি। তবে পূর্ণ বিনিময় না দিতে পারার কারণে আমি ওজরখাহি করছি।

হযরত হাসান বসরী (রহ.) বলেছেন :

আল্লাহর কসম! মু’মিন ব্যক্তির দ্বীনের মধ্যে পরনিন্দার প্রচলনের কুপ্রভাব মানব দেহে বসন্তের ফোস্কার চাইতেও দ্রুত প্রসার লাভকারী। তিনি আরো বলেছেন : হে আদম সন্তান! তুমি ততক্ষণ পর্যন্ত প্রকৃত ঈমানের সন্ধান পাবে না যতক্ষণ না তুমি নিজে যে দোষে দুষ্ট সে দোষের কারণে অপরের গিবত পরিত্যাগ না করো এবং নিজের দোষ সংশোধনের চেষ্টা না করো। আর যখন তুমি নিজের দোষ সংশোধনের চেষ্টায় লিপ্ত হবে তখন তাতেই তুমি ব্যস্ত থাকবে। এবং এ জাতীয় ব্যক্তিই আল্লাহ তা‘আলার কাছে অধিক প্রিয়। এক ব্যক্তি তাকে বললো : আপনি আমার গিবত করছেন। উত্তরে তিনি বললেন : তোমার মর্যাদা আমার কাছে এ পর্যন্ত পৌঁছায়নি যে, আমার পুণ্যের মধ্যে তোমাকে অংশীদার বানাব।

একদল লোক খাবার মজলিসে বসে খাদ্য গ্রহণ করছেন। এমতাবস্থায় একজনের গিবত করা হলো। তখন এক ব্যক্তি বলে উঠল যে, ‘‘আমাদের পূর্বপুরুষরা গোশত ভক্ষণের পূর্বে রুটি খেত, আর তোমরা রুটি খাওয়ার পূর্বেই গোশত ভক্ষণ করছো’’। এখানে গিবতকে গোশত খাওয়ার সাথে তুলনা করা হয়েছে। একব্যক্তি তার বন্ধুর সামনে অপরের মন্দ বিষয় উল্লেখ করলে বন্ধু তাকে জিজ্ঞেসা করলো : তুমি কি রোমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছ? তিনি উত্তরে বললেন : না। বন্ধু আবার প্রশ্ন করলো : তুমি কি তুর্কীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছো? উত্তরে তিনি বললেন : না। অতঃপর বন্ধু বললো : তোমার আক্রমণ থেকে রোমান ও তুর্কীরা রেহাই পেলো; কিন্তু তোমার মুসলিম ভ্রাতা রেহাই পেলো না।

বিভিন্ন মনীষীগণ বলেছেন : তিনটি কাজ করতে তুমি অপারগ হলে অন্য তিনটি কাজ তোমাকে করতে হবে। তুমি কল্যাণমূলক কিছু করতে অক্ষম হলে অকল্যাণমূলক কাজ থেকে বিরত থাকবে। মানুষের উপকার করতে অপারগ হলে তোমার অনিষ্টতা থেকে তাদেরকে মুক্তি দিবে। আর তুমি রোযা পালন করতে অক্ষম হলেও মানুষের গোশত ভক্ষণ করবে না।

মালেক ইবনে দীনার বলেছেন : একদা ঈসা (আ.) স্বীয় সহচরদের নিয়ে একটি মৃত কুকুরের পাশ দিয়ে হেটে যাচ্ছিলেন। সহচরগণ বললেন : কুকুরটি কতই না দুর্গন্ধময়! ঈসা (আ.) বললেন: কিন্তু উহার দাঁতের শুভ্রতা খুবই চমৎকার। এখানে কোন মানুষের মন্দ দিক নিয়ে আলোচনার চাইতে তার ভাল দিকটি তুলে ধরার প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে।

গীবতের কারণ

যে সকল কারণে গীবত তথা পরনিন্দা সংঘটিত হয়ে থাকে সেগুলো হলো :

১. গিবত বা পরনিন্দার প্রধান বা অন্যতম কারণ হলো ক্রোধ। কেউ কারো প্রতি ক্রুদ্ধ হলে সে অবলীলায় তার দোষ-ত্রুটি বর্ণনা করতে থাকে। সত্য-মিথ্যা, বাস্তব-অবাস্তবের তোয়াক্কা না করে মনে যা আসে তাই ব্যক্ত করতে থাকে ঐ ব্যক্তির বিরুদ্ধে। এ ক্ষেত্রে গিবতের মাধ্যমেই ক্রোধ নিবারণ করে থাকে সাধারণ লোকেরা। অবশ্য যারা দ্বীনদার, পরহেযগার ও আলিম এবং গিবতের ভয়াবহতা সম্বন্ধে ওয়াকিফহাল তারা অন্যভাবে ক্রোধ সংবরণ করার চেষ্টা করে থাকেন।

২. গিবতের আরেকটি কারণ বন্ধু-বান্ধব ও সঙ্গী-সাথীদের সাথে তাল মিলানো এবং তাদের সন্তুষ্টি অর্জন। অর্থাৎ সাথীরা যখন পরনিন্দায় লিপ্ত হয় তখন তাদের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে গিবতে জড়িয়ে পড়ে অনেকে। কারণ সে মনে করে যে, এ ব্যাপারে বন্ধুদের সাথে দ্বিমত করলে তাদের সাথে সম্পর্কের অবনতি হতে পারে বা অসন্তোষ জন্মাতে পারে। এভাবে আল্লাহকে অসন্তুষ্ট করে ও অপরের পাপের বোঝা মাথায় নিয়ে কেবলমাত্র বন্ধুদের মনতুষ্টির জন্য গিবত করা কতটা অযৌক্তিক বা অগ্রাহ্য তা সকলকে ভাবা উচিত।

৩. নিজের দোষত্রুটি লুকানোর উদ্দেশ্যে অন্যের গিবত করা হয় কখনো কখনো। যেমন কোন ব্যক্তি জানতে পারলো যে, কেউ তার অপকর্মের বিরুদ্ধে কোন বিচারালয়ে বা আদালতে সাক্ষ্য দেবে বা বিবৃতি দেবে তখন সে ঐ ব্যক্তির গিবত বা নিন্দা করতে থাকে যাতে তার সাক্ষ্যের গুরুত্ব লাঘব হয়ে যায় এবং তার বক্তব্য অগ্রহণযোগ্য ও পরিত্যাহ্য হয়।

৪. নিজের অপকর্মকে যৌক্তিক প্রমাণ করা বা নিজেকে দোষমুক্ত করার জন্য গিবত বা পরনিন্দার মতো পাপে লিপ্ত হয় অনেকে। যেমন কোন ব্যক্তি নিজে অপরাধ করে এবং তা থেকে নিস্কৃতি লাভের জন্য বলে, অমুক ব্যক্তি ওতো এ অন্যায় করেছে। উপরন্তু আমার এ কাজ করার পিছনে বিশেষ কারণ ছিল; কিন্তু তার তো তাও ছিলনা। মনে রাখতে হবে যে, এ ধরনের পরনিন্দাকারী দু’টি পাপের কাজ সংঘটিত করলো। প্রথমত : সে পাপ কাজে লিপ্ত হলো; দ্বিতীয়ত : নিজেকে দোষ মুক্ত করার জন্য অন্যের গিবত করলো। এতদোভয়ের মধ্যে দ্বিতীয় পাপটি অধিকতর জঘন্য।

৫. গিবত করার আরেকটি কারণ হলো নিজেকে বড় করে জাহির করা। নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ করতে কেউ কেউ অন্যকে হেয় ও তুচ্ছ হিসেবে উপস্থাপন করে। যেমন তারা বলে : অমুক ব্যক্তি মূর্খ বা স্বল্পবুদ্ধি। অমুক দুর্বল চিত্তের লোক, অমুকের কথায় কী যায় আসে ? অমুকের কী মূল্য আছে? এ সকল উক্তির মাধ্যমে পরোক্ষভাবে নিজের প্রশংসা করা হয় এবং প্রত্যক্ষভাবে অন্যের নিন্দা করা হয়, যা অত্যন্ত গর্হিত ও নিন্দিত কাজ।

৬. গিবতের অন্যতম আরেকটি কারণ হলো ঈর্ষা ও পরশ্রিকাতরতা। কতক লোকের স্বভাব এরকম যে, অন্যের সুনাম, সুখ্যাতি এবং সুযশ মোটেই সহ্য হয়না। কোন লোকের উন্নতি সাধিত হলে বা স্বীয় কীর্তির জন্য অভিনন্দিত হতে দেখলে হিংসার দাবানলে জ্বলে উঠে তার অন্তর। তখন ঐ নন্দিত ব্যক্তিকে খাটো করার জন্য তার দোষ অন্বেষণ ও জনসম্মুখে তা প্রচারে লিপ্ত হয় সে। এ ক্ষেত্রে তার লক্ষ্য থাকে কীর্তিমান লোকটিকে হেয় ও তুচ্ছ করে উপস্থাপন করা এবং তার সুখ্যাতিকে ম্লান করে দেয়া। প্রকৃতপক্ষে নিন্দুক নিজেই গিবত ও হিংসার মতো দু’টি জঘন্য পাপে লিপ্ত হলো; কিন্তু এতে নিন্দিত ব্যক্তির কোন ক্ষতি হবে না।

৭. হাসি-তামাশা, কৌতুক ও রসিকতার মাধ্যমে কখনো কখনো গিবত করা হয়ে থাকে। যেমন লোকদেরকে হাসানোর জন্য ব্যাঙ্গাত্মক ভঙ্গিতে অন্যের ত্রুটি প্রকাশ করা। এ ধরণের গিবতের মূল কারণ হলো অহংকার ও আত্মগরিমা।

৮. গিবত বা পরনিন্দার প্রত্যক্ষ কারণ সমূহের আরেকটি হলো মানুষের প্রতি অবজ্ঞা ও তাচ্ছিল্য প্রদর্শন এবং ঠাট্টা-বিদ্রুপ করা। অনেক সময় মানুষ অন্যকে কলঙ্কিত ও অপদস্থ করার উদ্দেশ্য তার ক্রিয়াকলাপ নিয়ে উপহাস ও ঠাট্টা-বিদ্রুপে মত্ত হয়। এখানে স্মর্তব্য যে, উপহাসক উপহাসের মাধ্যমে অপরকে লোকের নিকট যতটুকু অপদস্থ করছে সে নিজে আল্লাহর নিকট তদপেক্ষা বেশী অপদস্থ হচ্ছে।

৯. গিবত সংঘটিত হওয়ার আরেকটি কারণ হলো বেকারত্ব। মানুষ যখন কর্মহীন থাকে তখন তার সময় কাটে না। সময় অতিবাহিত হয় না বলে বিরক্তির উদ্রেক হয়। শয়তানের প্ররোচনায় পড়ে তখন অন্যের দোষ-ত্রুটি নিয়ে আলোচনায় মেতে উঠে এবং গিবত করতে থাকে।

১০. প্রশাসনের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নৈকট্য লাভের জন্য সহকর্মীদের সমালোচনা করা। এতে নিজেকে দায়িত্বশীল কর্মকর্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা ও বড় পদে আসীন হওয়ার আকাঙ্খা লুকায়িত থাকে।

১১. গিবতের আরেকটি কারণ হলো দাম্ভিকতা, অহমিকা ও আত্ম তৃপ্তি এবং স্বীয় ভুল-ত্রুটি নিয়ে ভাবনাহীনতা। এক ধরণের মানুষ আছে যারা নিজেদের শত অপরাধ সত্ত্বেও সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করে না; বরং সর্বদা অন্যের দোষ তালাশ করে বেড়ায়।

১২. ধর্মীয় অনুভূতি থেকে কোন মানুষ অন্যের অন্যায়ের প্রতিবাদ ও ভুল সংশোধনের জন্য আশ্চার্যন্বিত হয়ে বলতে থাকে : অমুক এ কাজ করতে পারলো!  তার একাজ করা উচিত হয়নি। তার একাজ পরিত্যাগ করা উচিত। এক্ষেত্রে তার এ প্রতিবাদ প্রশংসার্হ; কিন্তু অপরাধীর নামোল্লেখ করার কারণে সে অনিচ্ছাকৃতভাবে গিবত করার অপরাধে অপরাধী হবে এবং গুণাহগার হবে।

১৩. কারো প্রতি করুণা প্রদর্শন বা দয়ার্দ হওয়া। যেমন কারো পাপ দেখে চিন্তাগ্রস্থ হওয়া ও দুঃখ প্রকাশ করা। এতে গিবত করা বা পাপীকে হেয় করা উদ্দেশ্য থাকে না। কাজটি শরী‘আতের দৃষ্টিতে প্রশংসনীয়। কিন্তু শয়তান বিদ্বেষবশত : পাপী ব্যক্তির নামোল্লেখ করতে প্ররোচিত করে এবং অসতর্কতাবশত লোকটি ভাল নিয়ত থাকা সত্ত্বেও গিবতের  অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। ফলে পুণ্য লাভের আশায় তিনি যে অপর মু’মিন ভাইয়ের পাপাচারের জন্য দুঃখ ও সহমর্মিতা প্রকাশ করলেন তা গিবতের পাপে ধ্বংস হয়ে গেল।

১৪. পাপকাজে লিপ্ত হওয়ার অপরাধে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় কারো প্রতি ক্রোধান্বিত হওয়া। এটা নিঃসন্দেহে খুব সাওয়াবের কাজ। কিন্তু এখানে পাপীর নামোল্লেখ করলে গিবতের অন্তর্ভূক্ত হবে এবং পুণ্যের পরিবর্তে পাপ হবে; বরং করণীয় হলো পাপীকে সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করা এবং তার পাপ গোপন রাখা ও তা অন্যের সামনে প্রকাশ না করা। এ শেষোক্ত  তিনটি কারণ এত সুক্ষ্ম যে, সাধারণ লোকতো দূরের কথা আলিম সমাজ ও তা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া দুস্কর। কারণ তারা মনে করে যে, কারো পাপে আশ্চার্যন্বিত হওয়া, করুণা প্রদর্শন করা বা ক্রোধান্বিত হওয়া যদি আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় হয় তাহলে পাপীর নামোল্লেখে দোষ নেই; অথচ নামোল্লেখের কারণেই পুণ্য লাভের প্রত্যাশা গিবতের পাপে ব্যর্থ হয়ে গেল।৫৫

এ ছাড়া নিম্নোক্ত কারণেও মানুষের পরস্পরের মধ্যে গীবত সংঘটিত হয়ে থাকে। যেমন :

১. রাগ

২. অপরের সন্তুষ্টি অর্জন

৩. দোষ-ত্রুটি লুকানো

৪. নিজেকে দোষমুক্ত করার

৫. নিজেকে বড় বলে দাবি করা

৬. হিংসা :

৭. দাম্ভিকতা, অহমিকা ও আত্মতৃপ্তি এবং স্বীয় ভুল-ত্রুটি নিয়ে ভাবনাহীনতা

৮. কারো প্রতি করুণা প্রদর্শন বা দয়ার্দ হওয়া

পরনিন্দার কুফল

গীবত একটি ভাইরাসের মত, যা একজন থেকে আরেকজনের মধ্যে সংক্রামকের মত বাহিত হয়। অর্থাৎ একজনের দোষ অপর একজনের নিকট বললে সে আবার ঐ দোষ অন্য আরেকজনের নিকট প্রকাশ করে থাকে। আর এতে সমাজে অনেক কুফল পরিলক্ষিত হয়ে থাকে। গীবতের কুফল সম্পর্কে আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন :

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا اجْتَنِبُوا كَثِيرًا مِنَ الظَّنِّ إِنَّ بَعْضَ الظَّنِّ إِثْمٌ وَلَا تَجَسَّسُوا وَلَا يَغْتَبْ بَعْضُكُمْ بَعْضًا أَيُحِبُّ أَحَدُكُمْ أَنْ يَأْكُلَ لَحْمَ أَخِيهِ مَيْتًا فَكَرِهْتُمُوهُ وَاتَّقُوا اللَّهَ إِنَّ اللَّهَ تَوَّابٌ رَحِيمٌ

“ ওহে যারা ঈমান এনেছ! তোমরা অনেক অনুমান বর্জন কর। নিশ্চয় কোন কোন অনুমান পাপ।  আর তোমরা কারও দোষ অনুসন্ধান কর না এবং একে অপরের গীবত কর না। তোমাদের মধ্যে কেউ কি তার মৃত ভাইয়ের মাংস ভক্ষণ করতে পছন্দ করবে? তোমরা তো অবশ্যই তা ঘৃণা কর। তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় আল্লাহ বড়ই তওবা কবুলকারী, পরম দয়ালু।”৫৬

আবূ হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন :

মায়েজ আল-আসলামী (রা.) রাসূলুল্লাহ () এর কাছে এসে চার চার বার নিজের ব্যভিচারের কথা বললেন। প্রত্যেকবারই আল্লার রাসূল () তাঁর কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। সর্বশেষে রাসূল () তার উদ্দেশ্য জানতে চাইলেন। তিনি বললেন : আমি চাই আপনি আমার উপর হদ প্রয়োগ করে আমাকে পবিত্র করুন। অতঃপর তাকে প্রস্তর নিক্ষেপ করে হদ প্রয়োগের নির্দেশ দিলেন রাসূলুল্লাহ () এবং তা বাস্তবায়িত হলো। এরপর রাসূলুল্লাহ () দু’জন আনসারীকে বলাবলি করতে শুনলেন যে, অমুক ব্যক্তির অপরাধ আল্লাহ তা‘আলা লুকিয়ে রাখলেন অথচ সে নিজে তা প্রকাশ করার কারণে তাকে কুকুরের মতো প্রস্তর নিক্ষেপে হত্যা করা হলো। বর্ণনাকারী বলেন : এ কথা শ্রবণ করার পর তিনি নিশ্চুপ রইলেন। অতঃপর কিছু সময় পথ চললেন। পথিমধ্যে একটি মৃত গাধার পাশ দিয়ে অতিক্রম করার সময় তিনি ঐ ব্যক্তিদ্বয়ের খোঁজ করলেন। তারা বললেন : আমরা উপস্থিত আছি। তিনি বললেন : তোমরা দু’জনে এ মৃত গাধার মাংস ভক্ষণ করো। তারা বললেন : হে আল্লাহর রাসূল ! আল্লাহ আপনাকে ক্ষমা করুন। কেউ কি এই জিনিস ভক্ষণ করে নাকি? জবাবে রাসূলুল্লাহ () বললেন : কিছুক্ষণ পূর্বে তোমরা যে ব্যক্তির সম্মান হরণ করলে তা এই মৃত গাধার মাংস ভক্ষণের চাইতেও কঠিন ও ভয়াবহ। যার হাতে আমার জীবন তার শপথ করে বলছি, সেতো (মায়েজ আসলামী) এখন বেহেশতের নহর সমূহে সাতরিয়ে বেড়াচ্ছে।৫৭

গীবতের কূফল সম্পর্কে হাদীসের এক বর্ণনায় জানা যায় যে,

عَنْ أَبِي بَرْزَةَ الْأَسْلَمِيِّ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَا مَعْشَرَ مَنْ آمَنَ بِلِسَانِهِ وَلَمْ يَدْخُلْ الْإِيمَانُ قَلْبَهُ لَا تَغْتَابُوا الْمُسْلِمِينَ وَلَا تَتَّبِعُوا عَوْرَاتِهِمْ فَإِنَّهُ مَنْ اتَّبَعَ عَوْرَاتِهِمْ يَتَّبِعُ اللَّهُ عَوْرَتَهُ وَمَنْ يَتَّبِعْ اللَّهُ عَوْرَتَهُ  َفْضَحْهُ فِي بَيْتِهِ

“বারা ইবনে আযিব (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন : রাসূলুল্লাহ () ইরশাদ করেছেন : হে মু’মিন সম্প্রদায়! যারা মুখে ঈমানের অঙ্গিকার করেছো; কিন্তু এখনো তা অন্তরে প্রবেশ করেনি। তোমরা মুসলমানদের অগোচরে তাদের নিন্দা করো না এবং তাদের দোষ খোঁজ করে বেড়াইও না। যে ব্যক্তি তার মুসলিম ভাইয়ের দোষ অন্বেষণ করে আল্লাহ তা‘আলা তার দোষ তালাশ করেন। আর আল্লাহ তা‘আলা যার ছিদ্রান্বেষণ করেন তাকে স্বীয় গৃহে লাঞ্ছিত করেন।” ৫৮

অপর এক হাদীসে এসেছে :

عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَمَّا عُرِجَ بِي مَرَرْتُ بِقَوْمٍ لَهُمْ أَظْفَارٌ مِنْ نُحَاسٍ يَخْمُشُونَ وُجُوهَهُمْ وَصُدُورَهُمْ فَقُلْتُ مَنْ هَؤُلَاءِ يَا جِبْرِيلُ قَالَ هَؤُلَاءِ الَّذِينَ يَأْكُلُونَ لُحُومَ النَّاسِ وَيَقَعُونَ فِي أَعْرَاضِهِمْ.

“আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত; তিনি বলেন : রাসূলুল্লাহ () ইরশাদ করেছেন : মি’রাজের রাত্রিতে আমি একদল লোকের পাশ দিয়ে গমনের সময় দেখলাম তারা স্বীয় মুখমণ্ডল ও বক্ষের গোশ্ত পিতল বা তামার নখ দ্বারা ছিন্ন করছে। আমি জিব্রাঈলের কাছে জানতে চাইলাম এরা কারা? তিনি বললেন : ওরা মানুষের গোশ্ত ভক্ষণ করতো ও তাদের সম্মান হরণ করতো।”৫৯

উপরোক্ত বর্ণনার ভিত্তিতে এ কথা বলা যায় যে, গিবত একটি জঘন্য কবীরা গুনাহ, যা বান্দার হকের সাথে জড়িত। আর আল্লাহর হকের চাইতে বান্দার হক্ব নষ্ট করা অধিক ভয়াবহ যা আল্লাহ ক্ষমা করেন না।

গীবত শ্রবণ করার বিধান ও শাস্তি

গিবত করা সর্বসম্মতভাবে হারাম বা নিষিদ্ধ কাজ। অনুরূপভাবে গিবত শ্রবণ করাও হারাম ও নিষিদ্ধ কর্ম। কারণ মানুষের চক্ষু, কর্ণ ও অন্তর সবকিছুই স্বীয় কৃতকর্মের জন্য আল্লাহ তা‘আলার কাছে জবাবদিহি করতে হবে। মহান আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

إِنَّ السَّمْعَ وَالْبَصَرَ وَالْفُؤَادَ كُلُّ أُولَئِكَ كَانَ عَنْهُ مَسْئُولًا .

“নিশ্চয় কান, চক্ষু ও অন্তঃকরণ এদের প্রত্যেকটিই জিজ্ঞাসিত হবে।”৬০

আল্লামা মুফতী মুহাম্মদ শফী (রহ.) বলেন :

ক্বিয়ামতের দিন কান, চক্ষু ও অন্তঃ করণকে প্রশ্ন করা হবে। কানকে প্রশ্ন করা হবে : তুমি সারা জীবন কি কি শুনেছ? চক্ষুকে প্রশ্ন করা হবে : তুমি সারা জীবন কি কি দেখেছ? অন্তঃকরণকে প্রশ্ন করা হবে : তুমি সারা জীবন মনে কি কি কল্পনা করেছ এবং কি কি বিষয়ে বিশ্বাস স্থাপন করেছ? যদি কান দ্বারা শরীয়ত বিরোধী কথাবার্তা শুনে থাকে; যেমন কারও গিবত এবং হারাম গানবাদ্য কিংবা চক্ষু দ্বারা শরীয়ত বিরোধী বস্তু দেখে থাকে; যেমন বেগানা স্ত্রীলোক বা শুশ্রী বালকের প্রতি কু-দৃষ্টি করা কিংবা অন্তরে কুর’আন ও সুন্নাহ বিরোধী বিশ্বাসকে স্থান দিয়ে থাকে অথবা কারো সম্পর্কে প্রমাণ ছাড়া কোন অভিযোগ মনে কায়েম করে থাকে, তবে এ প্রশ্নের ফলে আযাব ভোগ করতে হবে।

এছাড়া আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মু’মিনগনের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন :

وَإِذَا سَمِعُوا اللَّغْوَ أَعْرَضُوا عَنْهُ

“তারা (মু’মিনরা) যখন অবাঞ্ছিত বাজে কথাবার্তা শ্রবণ করে, তখন তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়।”৬১

এখানে আয়াতটি বর্ণনামূলক হলেও তা দ্বারা মু’মিনদেরকে অনর্থক ও বাজে কথা শ্রবণ থেকে নিষেধ করার নির্দেশতুল্য।

অন্য একটি আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা মু’মিনগণের বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করে ইরশাদ করেন :

وَالَّذِينَ هُمْ عَنِ اللَّغْوِ مُعْرِضُونَ

“এবং যারা অনর্থক কথাবার্তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় বা নির্লিপ্ত থাকে।”৬২

অধিকন্তু হাদীসে গিবতকারী ও গিবত শ্রবণকারী উভয়কে সমভাবে অপরাধী সাব্যস্ত করা হয়েছে এবং তা থেকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। পুর্বোল্লেখিত আনাস (রা.) কর্তৃক বর্ণিত হাদীসে আবূ বকর ও উমার (রা.) একে অপরে খাদেমের অতি নিদ্রার কথা বলাবলি করার কারণে রাসূলুল্লাহ () তাঁদের উভয়কেই বলেছিলেন : আমি তোমাদের দাঁতের সাথে তার (খাদেমের) গোশত দেখতে পাচ্ছি।

এমনিভাবে মায়েজ আসলামীর রজম বা প্রস্তর নিক্ষেপে হদ কায়েম সংক্রান্ত হাদীসে উল্লেখ রয়েছে যে, তাঁকে রজম করার পর একজন আনসারী অন্য আনসারী সাহাবীর সাথে এতদবিষয়ে সমালোচনা করে গিবতের অপরাধ করেছেন। অতঃপর রাসূলুল্লাহ () গিবতকারী ও গিবত শ্রবণকারী উভয়কে ডেকে পাঠালেন এবং মৃত গাধার মাংস ভক্ষণের আহ্বান জানালেন।

গীবত শ্রবণকারীর কর্তব্য

গিবত করা ও কোন প্রতিবাদ বা প্রতিক্রিয়া ব্যতিরেকে গিবত শ্রবণ করা একই ধরণের অপরাধ; এবং উভয় অপরাধের শাস্তিও একই রকম। তাই এই অপরাধ থেকে মুক্তি পেতে হলে অন্য যে কোন অন্যায় বা শরীয়াত বিরোধী কর্মের সাথে যে আচরণ একজন মু’মিনের কাছে কাম্য গিবত শ্রবণকারীকেও ঠিক সেই ভূমিকা রাখা উচিত। হাদীসের এক বর্ণনায় এসেছে,

عن أبي سَعِيدٍ قال سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ مَنْ رَأَى مِنْكُمْ مُنْكَرًا فَلْيُغَيِّرْهُ بِيَدِهِ فَإِنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَبِلِسَانِهِ فَإِنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَبِقَلْبِهِ وَذَلِكَ أَضْعَفُ الْإِيمَانِ.

“আবূ সাঈদ খুদরী (রা.) বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ  ইরশাদ করেছেন : তোমাদের কেউ যদি কোন অন্যায় কাজ অবলোকন করে সে হাত (শক্তি) দ্বারা তা প্রতিহত করবে। তাতে সে সক্ষম না হলে মুখ দ্বারা প্রতিবাদ করবে। তাতেও সক্ষম না হলে অন্তর দ্বারা ঘৃণা করবে। এবং এটা হলো ঈমানের সর্বনিম্ন স্তর।”৬৩

গিবতকারীর গিবতের প্রতিবাদ করার প্রথম পদক্ষেপ হলো তাকে হিকমত ও প্রজ্ঞার সাথে নিষেধ করা। তাতে কাজ না হলে গিবতের মজলিস পরিত্যাগ করা। মহান আল্লাহ ঘোষণা করেন :

وَإِذَا رَأَيْتَ الَّذِينَ يَخُوضُونَ فِي آَيَاتِنَا فَأَعْرِضْ عَنْهُمْ حَتَّى يَخُوضُوا فِي حَدِيثٍ غَيْرِهِ وَإِمَّا يُنْسِيَنَّكَ الشَّيْطَانُ فَلَا تَقْعُدْ بَعْدَ الذِّكْرَى مَعَ الْقَوْمِ الظَّالِمِينَ.

“যখন আপনি তাদেরকে দেখেন, যারা আমার আয়াতসমূহে ছিদ্রান্বেষণ করে, তখন তাদের কাছ থেকে সরে যান যে পর্যন্ত না তারা অন্য কথায় প্রবৃত্ত হয়। যদি শয়তান আপনাকে ভুলিয়ে দেয়, তবে স্মরণ হওয়ার পর জালেমদের সাথে উপবেশন করবেন না।”৬৪

উপরোক্ত আয়াতে শরীয়ত গর্হিত যে কোন কাজ বা কথা চর্চা হয় এমন মজলিস পরিত্যাগ করা এবং তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সেই মতে যে স্থানে কোন মু’মিনের অগোচরে তার দোষ-ক্রটি চর্চা হয় এবং তার সম্মান হানি করা হয় সেই স্থান ত্যাগ করা অন্য মু’মিনের জন্য অবশ্য কর্তব্য।

এখানে স্মর্তব্য যে, নিন্দিত ব্যক্তি অনুপস্থিত থাকায় গিবতের মাধ্যমে মর্যাদা বিনষ্ট করার যে নগ্ন পায়তারা চালানো হচ্ছে তা থেকে উদ্ধার প্রচেষ্টা বা তার মর্যাদা অক্ষুণ রাখার ব্যবস্থা গ্রহণ করা একজন  মু’মিনের কাছে কাম্য। এবং এ জন্য অনেক পুণ্যের অঙ্গীকার রয়েছে হাদীস শরীফে।

আবূ দারদা (রা.) থেকে বর্ণিত; রাসূলুল্লাহ () ইরশাদ করেছেন :

যে ব্যক্তি স্বীয় ভ্রাতার মর্যাদা হানির প্রতিবাদ করবে দোযখের আগুন থেকে তাকে রক্ষা করা হবে।

আসমা বিনতে ইয়াযিদ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন : রাসূলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেছেন:

যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের অগোচরে তাকে সম্মান হানি থেকে বাঁচাবে আল্লাহ তা‘আলা তাকে জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্ত করার দায়িত্ব নিবেন।

অন্য একটি হাদীসে রয়েছে, রাসূলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেছেন :

যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের মর্যাদা রক্ষা করবে আল্লাহ তা‘আলা ক্বিয়ামতের দিন তার মুখমণ্ডলকে আগুন থেকে রক্ষা করবেন।

মুয়াজ ইবনে আনাস রা. থেকে বর্ণিত অন্য একটি হাদীসে রাসূলুল্লাহ () ইরশাদ করেছেন :

যে ব্যক্তি মুনাফিকের অনিষ্টতা থেকে কোন মু’মিন ব্যক্তিকে রক্ষা করবে (আমার মনে হয় তিনি বলেছেন) ক্বিয়ামতের দিন জাহান্নামের অগ্নি থেকে তাকে রক্ষা করার জন্য আল্লাহ তা‘আলা ফেরেশতা প্রেরণ করবেন।

জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন :

যে ব্যক্তি তার মুসলমান ভাইয়ের অনুপস্থিতিতে তাকে সাহায্য করবে আল্লাহ তা‘আলা দুনিয়া ও আখিরাতে তাকে সাহায্য করবেন।

কোন কোন ক্ষেত্রে গীবত বৈধ

গীবত একটি নিষিদ্ধকর্ম। কারণ গীবতের মাধ্যমে অনুপস্থিত ব্যক্তির সম্মান বিনষ্ট করা ও তাকে হেয় বা তুচ্ছ করার অপচেষ্টা বৈ আর কোন কাজ হয় না। এতে ইহলৌকিক বা পারলৌকিক কোন সুনিশ্চিত কল্যাণ নিহিত নেই। তবে কোন ব্যক্তির অগোচরে তার দোষ-ক্রটি বর্ণনার মধ্যে যদি অন্য কোন মঙ্গল লুক্বায়িত থাকে; কিংবা কোন দুস্কৃতিকারী, চরিত্রহীন, বদমেজাজী, সীমালঙ্ঘনকারী ব্যক্তির অনিষ্টতা থেকে অন্যকে রক্ষা করার কোন মন্ত্র লুক্বায়িত থাকে সেই ক্ষেত্রে ঐ দোষী ব্যক্তির দোষ উল্লেখ করাতে কোন বাঁধা নেই।

অবশ্য এই ক্ষেত্রে যাতে শরীয়াতের সীমা লঙ্ঘিত না হয় সেই দিকে লক্ষ্য রাখা একান্ত আবশ্যক। নিম্নে গীবত বৈধ হওয়ার ক্ষেত্রসমূহ আলোকপাত করা হলো:

১. বাদশাহ বা বিচারকের নিকট বিচার প্রার্থীরূপে উৎপীড়কের উৎপীড়নের বিষয় বলা বৈধ। এমনিভাবে যার কাছে উৎপীড়নের বিষয় বললে তিনি তার কর্তৃত্ব বা ক্ষমতা দ্বারা তা থেকে পরিত্রাণ দিতে বা লাঘব করতে সক্ষম তার কাছেও অভিযোগ পেশ করা যেতে পারে।

২. এই প্রসঙ্গে পবিত্র কুর’আনে মহান আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন :

لَا يُحِبُّ اللَّهُ الْجَهْرَ بِالسُّوءِ مِنَ الْقَوْلِ إِلَّا مَنْ ظُلِمَ وَكَانَ اللَّهُ سَمِيعًا عَلِيمًا

“আল্লাহ কোন মন্দ বিষয় প্রকাশ করা পছন্দ করেন না। তবে কারো প্রতি জুলুম হয়ে থাকলে সে কথা আলাদা। আল্লাহ শ্রবণকারী, বিজ্ঞ।”৬৫

এখানে অত্যাচারিত বা উৎপীড়িত ব্যক্তিকে নিজের আত্মরক্ষা বা জুলুম-নিপীড়ন থেকে পরিত্রাণ লাভের স্বার্থে অত্যাচারীর বিরুদ্ধে অভিযোগ করার অনুমতি দেয়া হয়েছে। এ হাদীসে আবূ সুফিয়ানের দোষ-বা বদ স্বভাব উল্লেখ করাতে রাসূল () হিন্দাকে বাধা দেন নাই বা তিরষ্কার করেন নাই। যা এই কর্মের বৈধতার দলীল। আবূ হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত অন্য একটি হাদীসে রাসূলুল্লাহ () ইরশাদ করেন :

যার অধিকার বিনষ্ট হয় তার কথা বলার অধিকার রয়েছে।

এতে বোঝা গেল উৎপীড়িত, অত্যাচারিত বা অধিকার বঞ্চিত ব্যক্তি স্বীয় অধিকার আদায়ের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে উৎপীড়ক বা অত্যাচারীর বিরুদ্ধে অভিযোগ পেশ করতে পারবে। তবে যার কাছে অভিযোগ করলে জুলুম বা উৎপীড়ন থেকে মুক্তি পাওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই এমন ব্যক্তির কাছে অভিযোগ পেশ না করাই সঙ্গত।

তাবেয়ী আউফ (রহ.) বলেন : আমি মুহাম্মদ ইবনু সীরীনের কাছে হাজ্জাজ ইবনু ইউসুফের বিরুদ্ধে অভিযোগ করলাম। তিনি বললেন : আল্লাহ তা‘আলা ন্যায় বিচারক। তিনি হাজ্জাজ থেকে যেরূপ প্রজা নিপীড়নের নিমিত্তে প্রতিশোধ গ্রহণ করবেন, তদ্রুপ তিনি তার নিন্দুক থেকেও তার নিন্দার প্রতিশোধ গ্রহণ করবেন।৬৬

৩. কোন অন্যায় ও অসঙ্গত কাজের মূলোৎপাটন কল্পে বা কোন পাপাচারী ব্যক্তিকে তার পাপকর্ম থেকে ফিরিয়ে আনার উদ্দেশ্যে এমন ব্যক্তির কাছে অভিযোগ করা যার দ্বারা এই উদ্দেশ্য সাধিত হবে। যেমন : অভিযোগকারী সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বলবে : অমুক ব্যক্তি এই অন্যায় কাজে লিপ্ত, তাকে উক্ত কাজ থেকে নিবৃত্ত রাখুন। তবে এই ক্ষেত্রে অন্যায় বা অপকর্মের অবসান বৈ-অন্য কোন উদ্দেশ্য থাকলে তা বৈধ হবে না।

৪. ফতোয়া বা শরীয়াতের বিধান প্রার্থনাকল্পে মুফতীর নিকট অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ করলে বা তার দোষ-বর্ণনা করলে গীবত হয় না। যেমন : কোন ব্যক্তি মুফতীকে বললো : আমার পিতা বা ভাই বা স্বামী বা অমুক ব্যক্তি আমার সাথে এ ধরণের আচরণ করছে। শরীয়াতের দৃষ্টিতে এর বিধান কি? আমি কিভাবে তাদের বা তার এই আচরণ বা অনিষ্টতা থেকে মুক্তি পাবো? বা কিভাবে আমার অধিকার বুঝে নেব এবং তাদের অত্যাচার থেকে নিস্কৃতি পাব? এই সব ক্ষেত্রে অন্যায়কারীর বিরুদ্ধে তার অগোচারে অভিযোগ পেশ করলে গিবত হয় না। তবে অভিযুক্ত ব্যক্তির নামোল্লেখ না করে কার্যসিদ্ধি সম্ভব হলে সেটাই উত্তম। যেমন : বাদী এসে মুফতীকে এইভাবে জিজ্ঞেসা করবে : অমুক ব্যক্তি তার ছেলে বা ভাই বা স্ত্রী বা সন্তানের সাথে এইরূপ আচরণ করছে তার ব্যাপারে শরীয়াতের বিধান কি? তাবে নামোল্লেখে কোন দেষ নেই। যেমনটি আমরা পূর্বোক্ত হযরত আয়শা (রা.) বর্ণিত আবূ সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দের হাদীসে লক্ষ্য করেছি।

৫. অনিষ্টকর ব্যক্তির ক্ষতি থেকে কোন লোককে বিশেষত কোন মুসলমানকে রক্ষার উদ্দেশ্যে তার দোষ উল্লেখ করা বৈধ। কারণ এটা ঈমানের দাবীর আওতায় পড়ে। কেননা সম্ভাব্য বিপদ থেকে কোন মুসলিম ভাইকে সতর্ক করে দেয়া তাকে বিপদ থেকে উদ্ধারের শামিল। এই বিষয়ে হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে : যে ব্যক্তি কোন মুসলিমকে পৃথিবীর কোন বিপদ থেকে রক্ষা করবে আল্লাহ তা‘আলা কিয়ামতের দিনের বিপদ থেকে তাকে মুক্ত করবেন।

গীবতের কাফফারা

গীবতের পাপ থেকে পরিত্রাণ লাভের জন্য গীবতকারীকে তার কৃতকর্মের জন্য লজ্জিত ও অনুতপ্ত হতে হবে এবং তাওবার মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে ক্ষমা অর্জনের চেষ্টা করবে। এরপর নিন্দিত ব্যক্তির সাথে আলোচনা করে তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবে অত্যন্ত লজ্জিত ও ব্যথিত চিত্তে। আর যদি লৌকিকতার খাতিরে প্রকাশ্যে লজ্জিত হওয়ার ভান করলো; কিন্তু প্রকৃত পক্ষে লজ্জিত হল না, তহলে সে আরেকটি পাপ কাজ করলো।

হাসান বসরী (রহ.) বলেন : নিন্দিত ব্যক্তির নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করলেই যথেষ্ট হবে; তার কাছ থেকে দায় মুক্ত হওয়ার আবশ্যকতা নেই।

মুজাহিদ (রহ.) বলেন : তোমর ভ্রাতার গোশত ভক্ষণের (গীবত) কাফ্ফারা হলো তুমি তার প্রশংসা করবে এবং তার কল্যাণের জন্য দু‘আ করবে।

গীবতের তাওবা সম্পর্কে আতা ইবনে আবী রাবাহ এর দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন : গীবতের পাপ থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে তুমি নিন্দিত ব্যক্তির কাছে গিয়ে তাকে বলবে, আমি যা বলেছি মিথ্যা বলেছি এবং তোমার উপর যুলুম করেছি ও অসদাচরণ করেছি। এখন তুমি চাইলে তোমার হক বুঝে নিয়ে আমাকে দায়মুক্ত করতে পারো; নতুবা ক্ষমা করে দিতে পারো। উপরোক্ত অভিমতসমূহ উল্লেখ করার পর ইমাম গাযযালী (রহ.) এই শেষোক্তটিকে অধিক বিশুদ্ধ বলে মন্তব্য করেছেন।৬৭

কোন কোন মনীষী বলেছেন যে, মান-সম্মান নষ্টের কোন বিনিময় নেই। তাই সম্পদ নষ্ট করলে যেমন তা ফিরিয়ে দিয়ে দায়মুক্ত হতে হবে সম্মান নষ্টের ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য নয়। ইমাম গাযযালী (রহ.) এ মতকে দুর্বল হিসেবে আখ্যা দিয়ে বলেন : সম্মান নষ্টের ক্ষেত্রেও জবাবদিহিতার বিধান রয়েছে। যেমন : মিথ্যা অপবাদের শাস্তি ইত্যাদি। এ প্রসঙ্গে একটি বিশুদ্ধ হাদীসের দিক নির্দেশনা রয়েছে। আবূ হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন : রাসূলুল্লাহ () ইরশাদ করেছেন : যে ব্যক্তি তার মুসলিম ভাইয়ের ধন-সম্পদ বা সম্মানের ক্ষতি করে তার উপর যুলুম করেছে ক্বিয়ামতের দিবস আসার পূর্বেই যেন তা শুধরিয়ে নিয়ে দায়মুক্ত হয়ে যায়। কারণ সেদিন দিনার ও দিরহামের কোন লেনদেন থাকবে না। আর যদি সে তা না করে তাহলে তার পুণ্যসমূহ তার সঙ্গীকে দিয়ে দেয়া হবে। আর যদি তার কোন পুণ্য না থাকে তাহলে তার সঙ্গীর পাপসমূহ তার পাপের সাথে যুক্ত করে দেয়া হবে।

যদি নিন্দিত ব্যক্তি জীবিত থাকে এবং তার কাছে নিন্দুক নিজের অপরাধ স্বীকার করে ক্ষমা প্রার্থনার পরিবেশ থাকে ও অন্য কোন সংকট বা ফেৎনা ফ্যাসাদ সৃষ্টি হওয়ার আশংকা না থাকে সে ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির কাছে যেয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করাই উত্তম। আর যদি নিন্দিত ব্যক্তি জীবিত না থাকে বা তার কাছে গিয়ে ক্ষমা প্রার্থনার পরিবেশ নিশ্চিত না হয়, তাহলে ঐ ব্যক্তির জন্য দু‘আ করবে, তার পাপ মোচনের জন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করবে এবং নিজে বেশী বেশী করে পুণ্য অর্জনের চেষ্টা করবে। এ ছাড়া নিন্দিত ব্যক্তির কাছ থেকে ক্ষমা লাভের পরিবেশ তৈরী করার জন্য বেশী বেশী করে তার প্রশংসা করবে। তার প্রতি প্রীতি এবং অধিক ভক্তি ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন করবে এবং তাকে সন্তষ্ট করার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাবে। আর যদি কোন ক্রমেই এ সব চেষ্টা সফল না হয় অর্থাৎ নিন্দিত ব্যক্তির হৃদয় না গলে তাহলে তার এ প্রচেষ্টার জন্য পুণ্য লাভ করবে যা ক্বিয়ামতের দিন গীবতের পাপের মোকাবিলায় কাজে আসবে।

এবার প্রশ্ন হলো গীবতকারী ক্ষমা প্রার্থনা করার প্রর নিন্দিত ব্যক্তির পক্ষ থেকে তাকে মাফ করে দেয়ার বিধান কি? নিন্দিত ব্যক্তির পক্ষ থেকে নিন্দাকারীকে ক্ষমা করা ওয়াজিব না হলেও অতি উত্তম ও মহৎ কাজ।৬৮

আল্লাহ তা‘আলা তাঁর প্রিয় রাসূল () কে ক্ষমা প্রদর্শনের আহবান জানিয়েছেন এবং ক্ষমাশীলতাকে মু’মিনদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হিসেবে উল্লেখ করেছেন। আল-কুর’আনে বলা হয়েছে :

خُذِ الْعَفْوَ وَأْمُرْ بِالْعُرْفِ وَأَعْرِضْ عَنِ الْجَاهِلِينَ 

“ক্ষমার অভ্যাস গড়ে তোল, সৎকাজের নির্দেশ দাও এবং জাহেলদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নাও।”৬৯

অন্য এক আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

وَالْكَاظِمِينَ الْغَيْظَ وَالْعَافِينَ عَنِ النَّاسِ

“তারাই মুত্তাকী যারা নিজেদের রাগ সংবরণ করে এবং মানুষের প্রতি ক্ষমা প্রদর্শন করে।”[সূরা আলে ইমরান ১৩৪]

তাছাড়া নিন্দিত ব্যক্তি নিন্দাকারীকে ক্ষমা করা বা দায়মুক্ত করার নিমিত্তে নিজেকে এ ভাবে প্রস্তুত করতে পারে যে, যা ঘটার ঘটে গেছে, এর প্রতিশোধ নেয়াও সম্ভব নয়। তাই একজন মু’মিন ভাইকে দায়মুক্ত করে পুণ্য লাভের প্রত্যাশায় থাকাই শ্রেয়। মহান আল্লাহ বলেন :

وَلَمَنْ صَبَرَ وَغَفَرَ إِنَّ ذَلِكَ لَمِنْ عَزْمِ الْأُمُورِ

“অবশ্যই যে সবর করে ও ক্ষমা করে নিশ্চয় এটা সাহসিকতার কাজ।”[সূরা আশ শুরা ৪৩]

মহাগ্রন্থ আল-কুর’আনের পাশাপাশি রাসূলুল্লাহ () ও এ বিষয়ে উৎসাহ দিয়েছেন। সাহাবী আব্দুর রহমান ইবনু আউফ (রা.) বর্ণিত হাদীসে তিঁনি বলেছেন: তিনটি বিষয়ে আমি শপথ করছি। আর তাহলো : সাদক্বা  সম্পদকে হ্রাস করে না। অতএব তোমরা দান করো। কোন ব্যক্তি অত্যাচারিত হয়ে অত্যাচারীকে ক্ষমা করে দিলে আল্লাহ তার সম্মান বাড়িয়ে দেন। অতএব তোমরা ক্ষমা প্রদর্শন করো; আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের সম্মান বৃদ্ধি করবেন। আর কোন ব্যক্তি অন্যের কাছে কিছু চাওয়ার অভ্যাস করলে আল্লাহ তা‘আলা তার দরিদ্রতার পথ উন্মুক্ত করে দিবেন।

অন্য একটি হাদীসে রাসূলূল্লাহ () বলেছেন : তোমরা দয়া করো; তোমাদের প্রতি দয়া প্রদর্শন করা হবে এবং তোমরা ক্ষমা করো; তোমাদেরকেও ক্ষমা করা হবে।

তিনি আরো বলেছেন : যে দয়া করে না, তার প্রতি দয়া প্রদর্শন করা হয় না। যিনি ক্ষমা করেন না, তাকে ক্ষমা করা হয় না। আর যিনি তাওবা করেন না, আল্লাহ তা‘আলা তাকে ক্ষমা করেন না।

উকবা ইবনু আমের (রা). বলেন : আমি রাসূলুল্লাহ () এর সাথে সাক্ষাত করতে গেলে তিনি আমাকে বললেন : হে উকবা ইবনু আমের! যে তোমার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে তুমি তার সাথে সম্পর্ক স্থাপন করো। যিনি তোমাকে বঞ্চিত করে, তুমি তাকে দান করো। যে তোমার উপর অত্যাচার করে তুমি তাকে ক্ষমা করো।

হাসান ইবনু আলী (রা). বলেন : কোন ব্যক্তি যদি আমার এক কানে গালি দেয় আর অন্য কানে এসে ওযরখাহী করে, আমি তার ওযর গ্রহণ করবো।

হাসান থেকে আরো বর্ণিত আছে যে, মু’মিনের চরিত্রের সর্বোত্তম বৈশিষ্ট্য হলো ক্ষমা প্রদর্শন করা।

আব্দুল্লাহ ইবনু মুহাম্মদ ইবনু  যিয়াদ বলেন : আমি ইমাম আহমদ ইবনু হাম্বলের কাছে ছিলাম, এমন সময় এক ব্যক্তি তাকে লক্ষ্য করে বললেন : হে আবূ আব্দুল্লাহ ! আমি আপনার গীবত করেছি, আমাকে দায়মুক্ত করুন। তিনি বললেন : গীবতের পুনরাবৃত্তি না করার শর্তে তোমাকে দায়মুক্ত করা হলো। আমি বললাম : হে আবূ আব্দুল্লাহ! লোকটি আপনার গীবত করলো আর আপনি তাকে দায়মুক্ত করে দিলেন? তিনি বললেন : তুমি দেখনি যে, আমি শর্ত আরোপ করেছি?৭০ 

আল্লামা মুনাবী ইবনু আব্দুস সালামের বরাতে একটি উক্তি উল্লেখ করেছেন, তাহলো : লজ্জিত ও অনুতপ্ত ব্যক্তিকে ক্ষমা করা বা দায়মুক্ত করা মহাগ্রন্থ আল-কুর’আনে নির্দেশিত ইহসানের অন্তর্ভূক্ত।

গীবত থেকে বাঁচার উপায়

এক. গীবতের কূফল সম্পর্কে সম্যক অবগত হওয়া :

গিবতের মতো জঘন্য পাপ থেকে নিজেকে নিবৃত্ত রাখার জন্য কুর’আন ও হাদীসে বর্ণিত গিবতের ক্ষতিকারক দিক- যেমন : পুণ্য লাঘব; নিন্দিত ব্যক্তির পাপের বোঝা বহন ও পরকালীন শাস্তি ইত্যাদি বিষয়গুলোকে বিশেষ মনযোগের সাথে পাঠ করত এর মর্ম সম্যকরূপে উপলব্ধি করা এবং তদনুযায়ী নিজের করণীয় নির্ধারণ করা।

দুই. পরের দোষ নয় নিজের দোষ আগে অনুসন্ধান করা

স্বীয় দোষ অনুসন্ধান করা। যদি নিজের মধ্যে দোষ পাওয়া যায় তাহলে মনে করতে হবে অপরের দোষ থাকাও অসম্ভব নয়। তাছাড়া নিজে কোন দোষে দুষ্ট হয়ে অপরের দোষের নিন্দা করাও এক ধরণের নির্লজ্জতা বৈ কিছু নয়। আর প্রকৃত পক্ষেই যদি নিজে নির্দোষ হওয়ার সৌভাগ্য লাভ হয়ে থাকে তাহলে যিনি এ তাওফীক দান করলেন সে মহান বিধাতার শুকরিয়া ও কৃতজ্ঞতায় মস্তক অবনত রাখতে হবে। নিজেকে নির্দোষ মনে করার অজুহাতে অন্যের দোষ অন্বেষণ বা চর্চা করে মৃত ভ্রাতার মাংস ভক্ষণ করার মতো পাপে লিপ্ত হওয়া আদৌ ঠিক নয়। মনে রাখতে হবে যে, অন্যের দ্বারা নিজের সমালোচনা হলে যেমন কষ্ট পাওয়া যায় তেমনি অন্য ব্যক্তিও অনুরূপ কষ্ট পেয়ে থাকে। সর্বোপরি নিজেকে নির্দোষ মনে করা ও অপরকে দোষী সাব্যস্ত করাও এক প্রকার শয়তানী প্ররোচনা। কারণ কোন মানুষই সম্পূর্ণ নির্দোষ ও নিষ্পাপ থাকতে পারে না। আর জন্মগতভাবে মানুষের মধ্যে যে সব ত্র“টি বিদ্যমান যা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব নয় যেমন খঞ্জ, অন্ধ, বধির ইত্যাদি- এগুলোর সমালোচনা করা বা তা উল্লেখ করে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে হেয় করা প্রকৃত পক্ষে মহান স্রষ্টার নিন্দা করার শামিল।৭১

তিন. ক্রোধ দমন করা

যেহেতু গীবতের যতগুলো কারণ রয়েছে তন্মধ্যে ক্রোধও একটি উল্লেখ্যযোগ্য কারণ। তাই ক্রোধ সংবরণ গিবত থেকে পরিত্রাণ লাভের একটি উপায়। ক্রোধের বশবতী হয়ে অন্যের নিন্দায় লিপ্ত হওয়া এবং তজ্জন্য আল্লাহ ও রাসূলের ক্রোধের পাত্র হওয়া কোন সুবিবেচক ব্যক্তির জন্য শোভনীয় নয়। ক্রোধান্বিত হওয়ার মতো কোন ঘটনা ঘটলে তা থেকে নিস্কৃতি লাভের জন্য পবিত্র কুর’আন ও হাদীসে ক্রোধ সংবরণের মর্যাদা সংক্রান্ত উক্তির কথা স্মরণ করতে হবে। তাহলে ক্রোধের সার্বিক পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া বা অনিষ্টতা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। মহান আল্লাহ তায়ালা মুত্তাকী বা পরহেযগারদের চরিত্র উল্লেখ করতে গিয়ে বলেন :

وَالْكَاظِمِينَ الْغَيْظَ وَالْعَافِينَ عَنِ النَّاسِ

আর যারা নিজেদের রাগকে সংবরণ করে এবং মানুষের প্রতি ক্ষমা প্রদর্শন করে।৭২ 

হাদীসের এক বর্ণনায় এসেছে,

من كظم غيظا و هو قادر على أن ينفذه دعاه الله على رءوس الخلائق حتى يخيره من الحور العين يزوجه منها ما شاء 

যে ব্যক্তি ক্রোধ প্রকাশ ও তদনুযায়ী কাজ করার সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও তা দমন করল আল্লাহ তা‘আলা তাকে ( কিয়ামত দিবসে) সৃষ্টিকূলের সামনে ডেকে পাঠাবেন এবং তার পছন্দমতো হুরের সাথে তাকে বিয়ে দিবেন।৭৩

চার. অসৎ সঙ্গ ত্যাগ করা

আল্লাহ তা‘আলার অসন্তুষ্টির তোয়াক্কা না করে মানুষের সন্তুষ্টি অর্জন বা বন্ধু-বান্ধবের মন জোগানোর বাসনা পরিত্যাগ করা। মনে রাখতে হবে যে, মানুষের মনতুষ্টির চেষ্টায় আল্লাহ তা‘আলার বিরাগ ভাজন হওয়া নিতান্তই নির্বুদ্ধিতা ও মুর্খতার কাজ। অথচ ঈমানের দাবী হলো এর বিপরীত, অর্থাৎ মানুষের অসন্তুষ্টির তোয়াক্কা না করে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য সচেষ্ট হওয়া।

রাসূলুল্লাহ () ইরশাদ করেছেন :

যে ব্যক্তি মানুষের অসন্তুষ্টি সত্ত্বেও আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি অন্বেষণ করে আল্লাহ তা‘আলা তাকে মানুষের মুখাপেক্ষি করেন না; পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি আল্লাহকে অসন্তুষ্ট করে মানুষের সন্তুষ্টি অর্জন করতে চায় তাকে মানুষের দায়িত্বে ছেড়ে দেন।৭৪

পাঁচ. সর্বদা আল্লাহকে ভয় করা

নিজেকে পবিত্র প্রমাণ করার জন্য অন্যের গিবত করে তার মর্যাদাহানির উদ্যোগ নেয়ার সময় স্মরণ করা উচিত যে, সৃষ্টিজগতের বিরাগভাজন হওয়ার চাইতে মহান স্রষ্টার বিরাগভাজন হওয়া অধিক ভয়ঙ্কর। মানুষের কাছে নিজের চরিত্রকে কলুষমুক্ত করতে অন্যের গিবতে লিপ্ত হয়ে আল্লাহ তা‘আলার অসন্তুষ্টির পাত্র হওয়া নির্বুদ্ধিতা ও বোকামির নামান্তর। উপরন্তু যে উদ্দেশ্য এ অপকর্ম করা হলো তারও কোন নিশ্চয়তা নেই অর্থাৎ অপরের গিবত করে নিজেকে পুতপবিত্র প্রমাণ করা ও জনরোষ বা জন অসন্তুষ্টি থেকে নিজেকে হেফাযত করার যে উদ্দেশ্য তা হাসিল নাও হতে পারে।

ছয়. সর্বদা নিজের অপরাধ স্বীকার করা

নিজের অপরাধকে হালকা প্রমাণ করা বা অপরাধ সংঘটনের খোড়া যুক্তি হিসেবে অন্যের দ্বারা উক্ত অপরাধ সংঘটিত হয়েছে মর্মে গিবত করার যে প্রবণতা তা থেকে মুক্তি লাভের জন্য স্মরণ করা উচিত যে, অন্য লোক হারাম ভক্ষণ করলেও তোমার জন্য তা ভক্ষণের বৈধতা অর্জিত হয় না। যেহেতু তুমি এমন ব্যক্তির অনুসরণের যুক্তি পেশ করলে যার অনুসরণ বৈধ নয়। কারণ যে ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলার নির্দেশ লঙ্ঘন করে সে যেই হোক না কেন তার অনুসরণ অবৈধ। যদি কোন ব্যক্তি স্বেচ্ছায় আগুনে ঝাপ দেয় তুমি তো জ্ঞান থাকা অবস্থায় তা অনুসরণ করবে না, তাহলে অন্য ব্যক্তি কর্তৃক সংঘটিত পাপকে দলিল হিসেবে দাঁড় করিয়ে সে পাপে লিপ্ত হওয়ার স্পর্ধা তুমি কোথায় পেলে? সর্বোপরি এতে দু’ধরণের পাপাচারে লিপ্ত হওয়ার পথ সুগম করলে তুমি। প্রথমত : গুনাহের কাজে লিপ্ত হওয়া; দ্বিতীয়ত: উক্ত কাজকে বৈধতা প্রদান বা তাকে লঘু সাব্যস্ত করার জন্য অন্য ব্যক্তির গিবত করা যার দ্বারা একই গুণাহর কাজ সংঘটিত হয়েছে।

সাত. কাউকে তুচ্ছ মনে না করা

নিজের ব্যক্তিত্ব প্রতিষ্ঠা ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ করার জন্য যারা অন্যকে হেয় ও তুচ্ছ হিসেবে উপস্থাপন করে এবং গিবতের মতো জঘন্য পাপে লিপ্ত হয় তাদের মনে রাখা দরকার যে, যে উদ্দেশ্যে সে অন্যের গিবত করলো, তার মর্যাদা হানি ঘটালো সে উদ্দেশ্য-অর্থাৎ নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ-সাময়িকভাবে অজ্ঞ ও নিম্ন শ্রেণীর লোকদের কাছে সাধিত হলেও তা দীর্ঘস্থায়ী হয় না। এছাড়া জ্ঞানী ও উচ্চ শ্রেণীর লোকদের সামনে কেউ অন্যের নিন্দা করলে তারা নিন্দাকারীকে কখনোই মহৎ মনে করে না। ফলে তার উদ্দেশ্য ব্যর্থই রয়ে গেল। উপরন্তু অপরের নিন্দা ও পরোক্ষভাবে আত্ম প্রশংসা করার মাধ্যমে সে মহান আল্লাহর বিরাগ ভাজন ও তাঁর অসন্তুষ্টির পাত্রে পরিণত হলো। তার পরও যদি ধওে নেয়া হয় যে, এ কাজের মাধ্যমে মানুষের কাছে নিজেকে মহৎ ও নিষ্কলঙ্ক প্রমাণ করা সম্ভব, কিন্তু তাও তো একজন মু’মিনের জন্য আল্লাহ তা‘আলার অসন্তুষ্টির মোকাবিলায় মূল্যহীন ও তুচ্ছ ব্যাপার মাত্র।

আট. অন্যের ভাল দেখে হিংসা না করা

আর যে ব্যক্তি অন্যের ভাল দেখে ঈর্ষান্বিত হয় এবং হিংসার দাবানলে জ্বলে  উঠে তার অন্তর সেতো ইহকাল ও পরকাল দু’টিই নষ্ট করল। এ বিষয়টি ভাল করে চিন্তা করলেই গিবত থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। অন্যের মঙ্গলে ঈর্ষান্বিত হয়ে গিবত করার মাধ্যমে হিংসুক তিনটি শাস্তির সমন্বয় ঘটালো। একটি ইহলোকে; অপর দু’টি পরলোকে। ইহলৌকিক শাস্তি বলতে এখানে কারো ধন-সম্পদ এবং মান-সম্মান দেখে ঈর্ষান্বিত হয়ে ঈর্ষার আনলে দগ্ধীভূত হওয়াকে বুঝানো হয়েছে। আর পরলৌকিক শাস্তি বলতে প্রথমত : হিংসার শাস্তি, দ্বিতীয়ত: গিবতের শাস্তিকে বুঝানো হয়েছে। হিংসার শাস্তি হাদীস শরীফে এবাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে, অগ্নি যেভাবে কাষ্ঠকে ভষ্মিভূত করে তেমনি হিংসা মানুষের পুণ্যকে নিঃশেষ করে দেয়।

নয়. জিহ্বাকে সংযত করা

খেল-তামাশা, কৌতুক-রসিকতা ও ব্যাঙ্গাত্মক ভঙ্গিতে মানুষের দোষ-ক্রটি বর্ণনা করে উপস্থিত জনতাকে মাতিয়ে তোলা বা হাসির বন্যা বইয়ে দেয়ার জন্য যারা গিবত করে তাদেরকে এ কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া দরকার যে, ইসলামে অনর্থক কথা ও কাজের কোন স্থান নেই। উপরন্ত উক্ত কাজের মাধ্যমে যেমন মূল্যবান সময় নষ্ট হচ্ছে তেমন গিবত ও মানুষের সম্মান বিনষ্ট করার মতো অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। ফলে এতেও দু’ধরণের পাপে পড়ছে নিন্দুক। এ প্রসঙ্গে হাদীসের এক বর্ণনায় মহানবী স. ইরশাদ করেছেন :

عن أبي هريرة قال قال رسول الله صلي الله عليه وسلم: من حسن إسلام المرء تركه ما لا يعنيه

আবূ হুরাইরা রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন; রাসূল সা. বলেছেন : অনর্থক কথা ও কাজ ছেড়ে দেয়া ইসলামের অন্যতম শোভাবর্ধক স্বভাব।৭৫

অপর এক হাদীসে এসেছে :

যে ব্যক্তি মিথ্যা কথার মাধ্যমে মানুষদেরকে হাসায় তার জন্য অভিসম্পাত, তার জন্য অভিসম্পাত, তার জন্য অভিসম্পাত।৭৬

দশ. কলঙ্কিত বা নিন্দিত ব্যক্তিকে নিয়ে উপহাস না করা

অপর ব্যক্তিকে কলঙ্কিত ও অপদস্থ করার জন্য তাকে নিয়ে উপহাস ও ঠাট্টা-বিদ্রপের মাধ্যমে যে গিবত করা হয় তা থেকে পরিত্রানের জন্য নিন্দুককে জানা উচিত যে সে দুনিয়ার মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের কাছে নিন্দিত ব্যক্তিকে অপদস্থ করার বিনিময়ে ক্বিয়ামতের দিন বিশাল জনসমষ্টির সম্মুখে তাকে অপদস্থ, লাঞ্ছিত ও অপমানিত করা হবে। এ ছাড়া এ অপকর্মের কারণে সে আল্লাহ, ফিরিশতা ও নবীগণের কাছে হেয় ও তুচ্ছ হিসেবে বিবেচিত হবে। নিন্দুক যদি ক্বিয়ামতের সে দিনের কথা চিন্তা করে যে দিন উপহাসকৃত ব্যক্তির পাপের বোঝা তাকে বহন করতে হবে এবং জাহান্নামের দিকে তাকে তাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হবে তাহলে সে নিজেই নিজকে নিয়ে উপহাস করত এবং অপর ব্যক্তির উপহাস থেকে বিরত থাকত।৭৭

এগার. অবসর সময় আল্লাহকে বেশি বেশি করে স্মরণ করা

বেকারত্ব ও অবসরের বিরক্তির কারণে কর্মহীন লোকেরা যে গিবত করে থাকে তা থেকে পরিত্রাণ লাভের জন্য গিবতকারীকে তার অবসর সময়ে আল্লাহ তা‘আলার আনুগত্য, ইবাদত ও উপাসনার মধ্যে অতিবাহিত করা উচিত। তাতে সময়ের সদ্ব্যবহার ও গিবতের পাপ থেকে মুক্তি নিশ্চিত হবে। এ হাদীসের এক বর্ণনায় এসেছে,

” لا تزول قدما ابن آدم يوم القيامة من عند ربه حتى يسأل عن خمس : عن عمره فيما أفناه و عن شبابه فيما أبلاه و ماله من أين اكتسبه و فيما أنفقه و ماذا عمل فيما علم ” 

রাসূল  বলেছেন : ক্বিয়ামতের দিন বনি আদমকে পাঁচটি প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে এক কদমও অতিক্রম করতে দেয়া হবে না। তার জীবন কী কাজে নিঃশেষ করেছে। তার যৌবন কীভাবে অতিবাহিত হয়েছে। সম্পদ কোন পথে উপার্জন করেছে এবং কী কাজে ব্যয় করেছে। নিজের ইলম বা বিদ্যা অনুযায়ী আমল করেছে কিনা?৭৮

বার. কাউকে খুশি করতে যেয়ে অন্যকে হেয় না করা

প্রশাসনের উর্ধ্বতন কর্মকর্তার নৈকট্য লাভ ও সহকর্মীদের উপর নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য যে গিবত করা হয় তা থেকে নিষ্কৃতি লাভের জন্য প্রত্যেক মুসলমানকে কুর’আন ও হাদীসে উল্লেখিত রিযিক সংক্রান্ত আয়াত ও রাসূলের বাণী স্মরণ করা দরকার এবং তাকদীরের প্রতি বিশ্বাসকে সুর্দঢ় করা উচিত। মনে রাখতে হবে যে, পৃথিবীর সকল শক্তি একত্রিত হলেও আল্লাহ তা‘য়ালার ইচ্ছা ব্যতিরেকে কেউ তাকে উপকার করতে পারবে না এবং ক্ষতিসাধনও করতে পারবে না। অতএব কোন মানুষকে খুশি করার জন্য অন্যের গিবত করে আল্লাহ তা‘আলার অসন্তষ্টির পাত্র হওয়া ও নিজের পরকালকে বিপদসংকুল করা বোকামি ও নির্বুদ্ধিতার নামান্তর।৭৯

তের. সর্বদা অন্যের দোষ-ত্রুটির দিকেই খেয়াল না করা

দাম্ভিকতা, অহমিকা ও আত্মতৃপ্তির জন্য যে নিজের ক্রটির প্রতি লক্ষ্য করে না; বরং সর্বদাই মানুষের দোষ অন্বেষণে ব্যস্ত থাকে তার স্মরণ করা উচিত যে, নিজে পাপী হয়ে অন্যের পাপ নিয়ে ভাবনা করা কতইনা লজ্জাকর ও নির্বোধসুলভ কাজ। অথচ তার উচিত নিজের দোষ খুঁজে বের করে তা সংশোধনের চেষ্টা করা। আর যদি সে নিজেকে দোষমুক্ত মনে করে তাহলে সেজন্য আল্লাহ তা‘আলার শুকরিয়া আদায় করবে এবং তার প্রশংসা করবে। রাসূলুল্লাহ () পাপকর্মের চাইতে দম্ভ ও অহমকে অধিক নিন্দা করে ইরশাদ করেন : তোমরা যদি পাপ না কর তাহলে আমি এর চাইতেও অধিক ভয়ঙ্কর জিনিস তোমাদের ব্যাপারে আশঙ্কা করছি, আর তা হলো দাম্ভিকতা, অহমিকা ও আত্ম তৃপ্তি।

পর্ব ১ | পর্ব ২ | পর্ব ৩ | পর্ব ৪| পর্ব ৫ | পর্ব ৬ | পর্ব ৭| পর্ব ৮ | পর্ব ৯ | পর্ব ১০


৪৩. ইবনুল আছীর, আন-নিহায়া ফী গারীবিল হাদীছ, ৩য় খ., পৃ. ৩৯৯।
৪৪. গাযযালী, ইহইয়াউ ‘উলূমিদ্দীন, ৩য় খ., পৃ. ১৪৪।
৪৫ ইমাম মালিক, মুয়াত্তা, ৩য় খ., পৃ. ১৫০।
৪৬. মুসলিম, আস-সহীহ, কিতাবুল বিররি ওয়াচ্ছিলা, বাবু তাহরীমিল গিবা, (কায়রো, দার আররাইয়্যান লিততুরাছ, ১ম সংস্কারণ, ১৪০৭হি./১৯৮৭খ্রী.), ১৬শ খ., পৃ. ১৪২; আবূ দাউদ, আস-সুনান, কিতাবুল আদব, বাবুন ফিল গিবা, (সিরিয়া, দারুল হাদীছ, তাবি.), ৫ম খ., পৃ. ১৯১-১৯২।
৪৭. আলবানী, সহীহুল জামি‘, ২য় খ., পৃ. ৭৭০, হাদীস নং-৪১৮৭।
৪৮. বুখারী, আল-জামে‘ আস-সহীহ, কিতাবুন নিকাহ, বাবু লা ইয়াখতুবু আলা খিতবাতি আখীহি, ৯ম খ., পৃ. ১০৬, হাদীস নং-৫১৪৩।
৪৯. গাজ্জালী, ইহইয়াউ উলূমিদ্দীন, ৩য় খ., পৃ. ১৪৬।
৫০. গাজ্জালী, সৌভাগ্যের পরশমনি, অনু: আব্দুল খালেক, (ঢাকা , ইফাবা প্রকাশনা, ৫ম সংস্করণ, ডিসেম্বর, ২০০৪), ৩য় খ., পৃ. ১০৩।
৫১. আলী ইব্ন হিশামুদ্দীন, কানযুল উম্মাল, খ. ৩, পৃ. ৫৮৪, হাদীস নং-৮০১২।
৫২. আল-কুরআন, সূরা আল-হুজুরাত, আয়াত : ১২।
৫৩. আবূ দাউদ, আস-সুনান, কিতাবুল আদব, ৫ম খ., পৃ. ১৯৪, হাদীস নং- ৪৮৪৭।
৫৪. আবূ দাউদ, আস-সুনান, কিতাবুল আদব, ৫ম খ., পৃ. ১৯৪-১৯৫, হাদীস নং-৪৮৮০; আলবানী, সহীহুল জামে‘, ২য় খ., পৃ. ১৩২২-১৩২৩, হাদীসনং-৭৯৮৪।
৫৫. ইহইয়াউ উলূমিদ্দীন, ৩য় খ., পৃ. ১৪৬-১৪৮।
৫৬. আল-কুরআন, ৪৯ : ১২।
৫৭. ৪খ., পৃ. ১৩, হাদীস নং-৪১৬৮।
৫৮. আবূ দাউদ, আস-সুনান, ৫ম খ., পৃ. ১৯৪-১৯৫।
৫৯. আবূ দাউদ, আস-সুনান, ৫ম খ., পৃ. ১৯৪, হাদীস নং- ৪৮৪৭।
৬০. আল-কুরআন, ১৭ : ৩৬।
৬১. আল-কুরআন, ২৮ :৫৫।
৬২. আল-কুরআন, ২৩ : ৩।
৬৩. মুসলিম, আস-সাহীহ, ১ম খন্ড, পৃ.১৬৭, হাদীস নং-৭০।
৬৪. আল-কুরআন, ৬ :৬৮।
৬৫. আল-কুরআন, ৪ : ১৪৮।
৬৬. গায্যালী, ইহইয়াউ ‘উলূমিদ্দীন, ৩য় খ., পৃ. ১৫৩।
৬৭. গায্যালী, ইহইয়াউ ‘উলূমিদ্দীন, ৩য় খ., পৃ. ১৫৩।
৬৮. গায্যালী, ইহইয়াউ ‘উলূমিদ্দীন, ৩য় খ., পৃ. ১৫৩-১৫৪।
৬৯. আল-কুরআন, ৭ : ১৯৯।
৭০. আবূ নু‘আইম, হিলইয়াতুল আউলিয়া, ৯ম খ., পৃ. ১৭৪; মুহাম্মদ ইবনু আহমদ আল-মুকাদ্দেম, হুরমাতু আহলিল ইলম, পৃ.১১৫।
৭১. প্রাগুক্ত, পৃ. ১৪৮; গায্যালী, সৌভাগ্যের পরশমনি, পৃ. ১০৫-১০৬।
৭২. আল-কুরআন, ৩ : ১৩৪।
৭৩. আলবানী, সহীহুল জামে‘, ২য় খ., পৃ. ১১১২, হাদীস নং- ৬৫২২।
৭৪. পৃ. ২য় খণ্ড, ১০৫২, হাদীস নং-৬০৯৭।
৭৫. তিরমিযী, আস-সুনান, কিতাবুয যুহদ, ৪র্থ খ., পৃ. ৪৮৩-৪৮৪, হাদীস নং-৩৩১৭, ৩৩১৮।
৭৬ আলবানী, সহীহুল জামে‘ , ২য় খ., পৃ. ১১৯৯, হাদীস নং-৭১৩৬।
৭৭. গায্যালী, ইহইয়াউ ‘উলূমিদ্দীন, ৩য় খ., পৃ. ১৪৯-১৫০।
৭৮. আলবানী, সহীহুল জামে‘ , ২য় খ., পৃ. ১২২০-১২২১, হাদীস নং-৭২৯৯।
৭৯. হুসাইন ‘আওয়াইশা, আল-গীবাত, পৃ. ১৪-১৫।

একজন ঈমানদার দা‘ঈর বর্জিত গুণাবলি পর্ব ৬

$
0
0

DawahMission_Gloucester_FB-01

লেখক:মুহাম্মদ শাহিদুল ইসলাম

পর্ব ১ | পর্ব ২ | পর্ব ৩ | পর্ব ৪| পর্ব ৫ | পর্ব ৬ | পর্ব ৭| পর্ব ৮ | পর্ব ৯ | পর্ব ১০

লোভ-লালসা

লোভ-লালসার পরিচয় ও হুকুম

লোভ-লালসার আরবী প্রতিশব্দ হলো : হিরছ (حرص)। যার আভিধানিক অর্থ লোভ, লালসা, লিপ্সা, কামনা, প্রলোভন, কার্পণ্য ইত্যাদি।

পরিভাষায়,

কারো কোন জিনিস দেখে তা লাভের আশা করা যা মানুষকে সর্বদাই আল্লাহ্ বিমূখ করে দেয় এবং দুনিয়া মুখী করে দেয় তাই-ই হিরছ।

লোভ-লালসার হুকুম

হিরছ দুই প্রকার। একটি হলো সৎ উদ্দেশ্যে। যার মধ্যে খোদাদ্রোহী কোন বিষয় সম্পৃক্ত নয়। অপরটি হলো অসৎ উদ্দেশ্যে। যার মধ্যে দুনিয়াবী কার্যক্রমকে প্রাধান্য দেয়া হয়। প্রথম প্রকারে হিরছ সর্বসম্মতক্রমে বৈধ। দ্বিতীয় প্রকারের হিরছ সর্বসম্মতিক্রমে হারাম।

লোভ-লালসা কারণ

হিরছের একমাত্র কারণ হলো মানুষর বড় হওয়ার প্রবল আকাঙ্খা করা। এখানে উল্লেখ্য যে, বড় হওয়া বলতে এ কথা বুঝানো হয়েছে যে, যে জিনিসের অধিকার আমি নই বা যা আমার প্রাপ্য নয় তার আশা করাই হলো হিরছের প্রধান ও অন্যতম কারণ। এ ক্ষেত্রে স্মরণযোগ্য যে, বৈধ ভাবে মানুষ যদি বড় হতে চায় যেমন : কোন ছাত্র ইচ্ছা করলো সে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হবে এটি তার জন্য হারাম নয়। মূলকথা হলো এমন কোন লোভ-লালসা করা যা আল্লাহর স্মরণ থেকে ব্যক্তিকে বিরত রাখে।

লোভ-লালসা পরিণতি

হাসান (রা.) হতে বর্ণিত, রাসূল ﷺ বলেছেন :

নিশ্চয়ই হিংসা-বিদ্বেষ নেকীসমূহকে নি:শেষ করে দেয়, যেমনিভাবে আগুন শুকনো কাঠকে পুড়িয়ে শেষ করে দেয়।৮০

রাসূল ﷺ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন : সাবধান শুনে নাও! আল্লাহর নিয়ামতেরও কিছু শত্রু রয়েছে। সাহাবীরা জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহর নিয়ামতের শত্রু কারা? রাসূল সা. বললেন : আল্লাহ্ স্বীয় অনুগ্রহে মানুষকে যে নিয়ামত দান করেছেন, তার কারণে মানুষকে যে হিংসা করে, সে আল্লাহর নিয়ামতের শত্রু।

বিশ্ববিখ্যাত আলেমে দ্বীন আল্লামা আবু লাইস আস-সমরকন্দী রহ. বলেন : তিন ব্যক্তির দু‘আ কবুল হয় না।

এক. হারাম ভক্ষণকারীর দু‘আ,

দুই. বেশি গীবতকারীর,

তিন. হিংসুকের দু‘আ।

লোভ-লালসা থেকে বাঁচার উপায়

মানুষের একান্ত প্রয়োজনীয় বস্তুসমূহের মধ্যে অর্থসম্পদ অন্যতম। অর্থসম্পদ ব্যতীত মানুষের জীবনধারণ একেবারেই অসম্ভব। জীবন এবং সম্পদ একটি আরেকটির পরিপূরক। সম্পদ ছাড়া যেমন জীবনধারণ সম্ভব নয়, তেমনি প্রাণহীন ব্যক্তির জন্য অর্থেরও কোন মূল্য নেই। অর্থসম্পদ মূলত: আল্লাহ্ তৈরীই করেছেন মানুষের কল্যাণের জন্য কিন্তু এ অর্থই আবার কখনও কখনও অনর্থের কারণ হয়ে থাকে। বিত্ত-বৈভব যেমন মানুষের প্রভূত কল্যাণে ব্যবহৃত হয়ে থাকে অনুরূপভাবে তা আবার মানুষের ক্ষতিকর কাজেও ব্যবহার হয়ে থাকে। এটি নির্ভর করে সম্পদের সঠিক ও অপব্যবহার এবং সুসম ও অসম বণ্টন ব্যবস্থার উপর। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যে সকল মতবাদ প্রচলিত আছে, তার সবগুলোই সম্পদ সঠিক ব্যবহার ও সুসম বণ্টনের মাধ্যমে সকল মানুষের সার্বিক কল্যাণে ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। হিরছ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার উপায় দুটি। এক. হালাল পন্থায় উপার্জন করা দুই. হারাম পেশা ত্যাগ করা। নিম্নে এগুলোর বিস্তারিত আলোচনা পেশ করা হলো :

এক. হালাল পন্থায় উপার্জন করা

বৈধ পন্থায় উপার্জনের জন্য আমরা সর্বদা চেষ্টা-প্রচেষ্টা করি। কীভাবে আমরা আমাদের রিযিক বৈধ্য পন্থায় উপার্জন করতে পারি? কারণ আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য অন্যতম একটি শর্ত হলো বান্দাহর উপার্জন হালাল পন্থায় হওয়া। কেননা রিযিক যদি হালাল পন্থায় উপার্জিত না হয় তাহলে তার কোন দু‘আ-ই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলার দরবারে কবুল হয় না। আর আল্লাহ্ রাব্বুল ‘আলামীনও হালাল রিযিকের খেয়ে জীবনধারণ করার নির্দেশ দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্ তা‘আলা আল-কুর’আনে ঘোষণা করে বলেন :

“ আমি তোমাদের জন্য যে রিযিক দিয়েছি তা থেকে পবিত্রতম বস্তু তোমরা ভক্ষণ কর।”

আর বৈধ পেশায় নিয়োজিত থেকে সম্পদ উপার্জনের জন্য পবিত্রতম ও হালাল বস্তুর খোঁজ করার নির্দেশও আল্লাহ্ তা‘আলা দিয়েছে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন :

“হে মু’মিনগণ! জুমু‘আর দিনে যখন সালাতের জন্য আহ্বান করা হয় তখন তোমরা আল্লাহর স্মরণে ধাবিত হও এবং ক্রয়-বিক্রয় ত্যাগ কর, এটাই তোমাদের জন্য শ্রেয় যদি তোমরা উপলব্ধি কর। সালাত সমাপ্ত হলে তোমরা পৃথিবীতে ছড়ায়ে পড়বে এবং আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধান করবে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করবে যাতে তোমরা সফলকাম হও। যখন তোমরা দেখলে ব্যবসায় ও কৌতুক তখন তারা তোমাকে দাঁড়ান অবস্থায় রেখে উহার দিকে ছুটে গেল। বল: আল্লাহর নিকট যা আছে তা ক্রীড়া-কৌতুক ও ব্যবসায় অপেক্ষা উৎকৃষ্ট। আল্লাহ্ সর্বশ্রেষ্ঠ রিয্কদাতা।”৮১

এ প্রসঙ্গে হাদীসের এক বর্ণনায় এসেছে, ইবনে উমর (রা) বর্ণনা করেন যে, রাসূল (ﷺ) বলেছেন :

“পৃথিবী মিষ্ট ও শ্যামল। এখানে যে ব্যক্তি হালাল সম্পদ উপার্জন করবে এবং ন্যায়সংগত পথে তা ব্যয় করবে, আল্লাহ তাকে উত্তম প্রতিদান দেবেন তাকে জান্নাত দান করবেন। আর যে ব্যক্তি হারাম সম্পদ উপার্জন করবে এবং তা অন্যায় পথে ব্যয় করবে, আল্লাহ তাকে অপমানজনক স্থানে নির্বাসিত করবেন। আর হারাম সম্পদ হস্তগতকারী ব্যক্তিরা কিয়ামতের দিন আগুনে জ্বলবে।”৮২

দুই. হারাম পন্থায় উপার্জন থেকে বিরত থাকা

পৃথিবীতে দু’ধরণের উপার্জন পরিলক্ষিত হয়। একটি হলো হালাল তথা বৈধ পন্থায় উপার্জন। আর অপরটি হলো হারাম তথা অবৈধ পন্থায় উপার্জন। মানবজীবনে এ অবৈধ পন্থায় উপার্জনকে কুর’আন ও হাদীসে হারাম ঘোষণা করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ্ বলেন :

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَأْكُلُوا أَمْوَالَكُمْ بَيْنَكُمْ بِالْبَاطِلِ إِلَّا أَنْ تَكُونَ تِجَارَةً عَنْ تَرَاضٍ مِنْكُمْ وَلَا تَقْتُلُوا أَنْفُسَكُمْ إِنَّ اللَّهَ كَانَ بِكُمْ رَحِيمًا.

“হে মু’মিনগণ! তোমরা পরস্পরের মধ্যে তোমাদের ধন-সম্পদ অন্যায়ভাবে খেয়ো না, তবে পারস্পরিক সম্মতিতে ব্যবসার মাধ্যমে হলে ভিন্ন কথা। আর তোমরা নিজেরা নিজদেরকে হত্যা করো না। নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের ব্যাপারে পরম দয়ালু।”৮৩

রাসূল (ﷺ) বলেছেন : “এক ব্যক্তি দীর্ঘ সফরে থাকা অবস্থায় এলোমেলো চুল ও ধূলিধুসরিত দেহ নিয়ে আকাশের দিকে হাত তুলে “হে প্রভু! হে প্রভু! বলে মুনাজাত করে, অথচ সে যা খায় তা হারাম, যা পান করে তা হারাম, যা পরিধান করে তা হারাম এবং হারামের দ্বারাই সে পুষ্টি অর্জন করে। তার মুনাজাত কিভাবে কবুল হবে?”৮৪ 

পর্ব ১ | পর্ব ২ | পর্ব ৩ | পর্ব ৪| পর্ব ৫ | পর্ব ৬ | পর্ব ৭| পর্ব ৮ | পর্ব ৯ | পর্ব ১০


৮০. আবূ দাউদ
৮১. সূরা আল-জুমু‘আহ, ৯-১১
৮২. ইবনে হিব্বান, আস-সহীহ, (দারুল ফিকর, তা.বি.), খ. ১০, পৃ. ৩৭০, হাদীস নং-৪৫১২
৮৩. সূরা আন-নিসা, ২৯
৮৪. ইমাম মুসলিম ইবনে হাজ্জাজ ইবনে মুসলিম, আস-সহীহ, (বৈরূত : দারুর যাইল, তা.বি.), খণ্ড ৩, পৃ. ৮৫, হাদীস নং-২৩৯৩

মুসলিম জীবনের আদব-কায়দা পর্ব -৩

$
0
0

Adab in Muslim Life QA

লেখক: ড. মো: আমিনুল ইসলাম | সম্পাদনা: ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া

আল্লাহ তা‘আলার সাথে মুসলিম বান্দার আদব

মুসলিম ব্যক্তি তার প্রতি আল্লাহ তা‘আলার অগণিত নি‘য়ামতের প্রতি লক্ষ্য করে; আরও লক্ষ্য করে ঐসব নি‘য়ামতের প্রতি, যেসব নি‘য়ামত তার মায়ের গর্ভে থাকাকালীন সময় থেকে শুরু করে তার রবের সাথে সাক্ষাৎ (মৃত্যু) করা পর্যন্ত দীর্ঘ সময় ধরে তাকে পরিবেষ্টন করে রেখেছে। ফলে সে তার নিজ মুখে তাঁর যথাযথ প্রশংসা ও গুণকীর্তন করার দ্বারা এবং তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গসমূহকে তাঁর আনুগত্যের অধীনস্থ করে দেয়ার মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলার শুকরিয়া আদায় করে; আর এটাই হলো তার পক্ষ থেকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলার সাথে আদব; কেননা, নি‘য়ামতের অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা, অনুগ্রহকারীর অনুগ্রহকে অস্বীকার করা, তাকে এবং তার ইহসান ও অবদানকে অবজ্ঞা করাটা কোনো আদব বা শিষ্টাচরের মধ্যে পড়ে না। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা বলেন:

[ وَمَا بِكُم مِّن نِّعۡمَةٖ فَمِنَ ٱللَّهِۖ ] [النحل: ٥٣]

“তোমাদের নিকট যেসব নিয়ামত রয়েছে, তা তো আল্লাহর নিকট থেকেই (এসেছে)।”[1]

আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:

[ وَإِن تَعُدُّواْ نِعۡمَةَ ٱللَّهِ لَا تُحۡصُوهَآۗ ] [النحل: ١٨]

“তোমরা যদি আল্লাহর নিয়ামত গণনা কর, তবে তার সংখ্যা নির্ণয় করতে পারবে না।”[2]

আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:

[ فَٱذۡكُرُونِيٓ أَذۡكُرۡكُمۡ وَٱشۡكُرُواْ لِي وَلَا تَكۡفُرُونِ ] [البقرة: ١٥٢]

“কাজেই তোমরা আমাকে স্মরণ কর, আমিও তোমাদেরকে স্মরণ করব। আর তোমরা আমার প্রতি কৃতজ্ঞ হও এবং অকৃতজ্ঞ হয়ো না।”[3]

আর মুসলিম ব্যক্তি গভীরভাবে লক্ষ্য করে যে, আল্লাহ তা‘আলা তার সম্পর্কে জানেন এবং তার সকল অবস্থা অবলোকন করেন; ফলে তার হৃদয়-মন তাঁর ভয়ে ও তাঁর প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধায় পরিপূর্ণ হয়ে উঠে; যার কারণে সে তাঁর অবাধ্যতায় লজ্জিত হয় এবং তাঁর বিরুদ্ধাচরণ ও তাঁর আনুগত্যের গণ্ডি থেকে বেরিয়ে যাওয়াটাকে রীতিমত অপমান মনে করে। সুতরাং এটাও তার পক্ষ থেকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলার সাথে আদব; কেননা, গোলাম কর্তৃক তাঁর মালিকের সাথে অবাধ্য আচরণ করা অথবা মন্দ ও ঘৃণ্য কোনো বস্তু বা বিষয় নিয়ে তাঁর মুখোমুখি হওয়া, অথচ তিনি তা সরাসরি দেখতে পাচ্ছেন— তা কোনো ভাবেই আদব বা শিষ্টাচরের মধ্যে পড়ে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

[ مَّا لَكُمۡ لَا تَرۡجُونَ لِلَّهِ وَقَارٗ , وَقَدۡ خَلَقَكُمۡ أَطۡوَارً] [نوح: ١٣،  ١٤]

“তোমাদের কী হল যে, তোমরা আল্লাহ‌র শ্রেষ্ঠত্বের পরওয়া করছ না। অথচ তিনিই তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন পর্যায়ক্রমে।”[4]

তিনি আরও বলেন:

[ وَيَعۡلَمُ مَا تُسِرُّونَ وَمَا تُعۡلِنُونَۚ ] [التغابن: ٤]

“আর তিনি জানেন তোমরা যা গোপন কর এবং তোমরা যা প্রকাশ কর।”[5]

আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:

 وَمَا تَكُونُ فِي شَأۡنٖ وَمَا تَتۡلُواْ مِنۡهُ مِن قُرۡءَانٖ وَلَا تَعۡمَلُونَ مِنۡ عَمَلٍ إِلَّا كُنَّا عَلَيۡكُمۡ شُهُودًا إِذۡ تُفِيضُونَ فِيهِۚ وَمَا يَعۡزُبُ عَن رَّبِّكَ مِن مِّثۡقَالِ ذَرَّةٖ فِي ٱلۡأَرۡضِ وَلَا فِي ٱلسَّمَآءِ  [يونس: ٦١

“আর আপনি যে অবস্থাতেই থাকুন না কেন এবং আপনি সে সম্পর্কে কুরআন থেকে যা-ই তিলাওয়াত করেন এবং তোমরা যে আমলই কর না কেন, আমরা তোমাদের সাক্ষী থাকি- যখন তোমরা তাতে প্রবৃত্ত হও। আর আসমানসমূহ ও যমীনের অণু পরিমাণও আপনার রবের দৃষ্টির বাইরে নয়।”[6]

আবার মুসলিম ব্যক্তি গভীরভাবে এটাও লক্ষ্য করে যে, আল্লাহ তা‘আলা তার উপর ক্ষমতাবান, সে তাঁর আয়াত্তাধীন এবং তাঁর দিকে ছাড়া তার পালানোর, মুক্তির ও আশ্রয় নেয়ার আর কোনো জায়গা নেই; সুতরাং সে আল্লাহর দিকে ধাবিত হবে, তাঁর সামনে নিজেকে সমর্পণ করে দেবে, তার বিষয়াদি তাঁর নিকট সোপর্দ করবে এবং তাঁর উপর ভরসা করবে; ফলে এটা তার পক্ষ থেকে তার প্রতিপালক ও সৃষ্টা আল্লাহ তা‘আলার সাথে আদব বলে গণ্য হবে; কেননা, যাঁর থেকে পালিয়ে বেড়ানোর কোনো সুযোগ নেই তাঁর কাছ থেকে পালানো, যার কোনো ক্ষমতা নেই তার উপর নির্ভর করা এবং যার কোনো শক্তি ও ক্ষমতা নেই তার উপর ভরসা করা কোনো আদব বা শিষ্টাচারের মধ্যে পড়ে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

[ مَّا مِن دَآبَّةٍ إِلَّا هُوَ ءَاخِذُۢ بِنَاصِيَتِهَآۚ ] [هود: ٥٦]

“এমন কোন জীব-জন্তু নেই, যে তাঁর পূর্ণ আয়ত্তাধীন নয়।”[7]

আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:

[ فَفِرُّوٓاْ إِلَى ٱللَّهِۖ إِنِّي لَكُم مِّنۡهُ نَذِيرٞ مُّبِينٞ ] [الذاريات: ٥٠]

“অতএব তোমরা আল্লাহর দিকে ধাবিত হও, নিশ্চয় আমি তোমাদের প্রতি আল্লাহর পক্ষ থেকে এক স্পষ্ট সতর্ককারী।”[8]

তিনি আরও বলেন:

[ وَعَلَى ٱللَّهِ فَتَوَكَّلُوٓاْ إِن كُنتُم مُّؤۡمِنِينَ ] [المائ‍دة: ٢٣]

“এবং আল্লাহর উপরই তোমরা নির্ভর কর, যদি তোমরা মুমিন হও।”[9]

আবার মুসলিম ব্যক্তি এটাও গভীরভাবে লক্ষ্য করে যে, আল্লাহ তা‘আলা তার সকল বিষয়ে তার প্রতি অনুগ্রহ করেন এবং তার প্রতি ও তাঁর (আল্লাহর) সকল সৃষ্টির প্রতি দয়া ও করুণা করেন, যার কারণে সে এর চেয়ে আরও বেশি আশা করে; ফলে সে খালেসভাবে তাঁর নিকট অনুনয়, বিনয় ও নিবেদন করে এবং ভালো কথা ও সৎ আমলের অছিলা ধরে তাঁর নিকট প্রার্থনা করে; সুতরাং এটা তার পক্ষ থেকে তার মাওলা আল্লাহ তা‘আলার সাথে আদব বলে গণ্য হবে; কারণ, যে রহমত সকল কিছুকে বেষ্টন করে রেখেছে তার থেকে নিরাশ হয়ে যাওয়া, যে ইহসান সকল সৃষ্টিকে শামিল করে তার থেকে হতাশ বা নিরাশ হওয়া এবং যে দয়া ও অনুগ্রহ সকল সৃষ্টিকে অন্তর্ভুক্ত করে তার আশা ছেড়ে দেওয়ার মধ্যে কোনো আদব বা শিষ্টাচার নেই।  আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

[ وَرَحۡمَتِي وَسِعَتۡ كُلَّ شَيۡءٖۚ ] [الاعراف: ١٥٦]

“আর আমার দয়া তো প্রত্যেক বস্তুকে ঘিরে রয়েছে।”[10]

আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:

[ ٱللَّهُ لَطِيفُۢ بِعِبَادِهِۦ ] [الشورا: ١٩]

“আল্লাহ তাঁর বান্দাদের প্রতি অত্যন্ত কোমল।”[11]

আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:

[ وَلَا تَاْيۡ‍َٔسُواْ مِن رَّوۡحِ ٱللَّهِۖ ] [يوسف: ٨٧]

“এবং আল্লাহর রহমত হতে তোমরা নিরাশ হয়ো না।”[12]

আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:

[ لَا تَقۡنَطُواْ مِن رَّحۡمَةِ ٱللَّهِۚ ] [الزمر: ٥٣]

“তোমরা আল্লাহর অনুগ্রহ হতে নিরাশ হয়ো না।”[13]

আর মুসলিম ব্যক্তি এটাও গভীরভাবে লক্ষ্য করে যে, তার প্রতিপালক আল্লাহ তা‘আলা’র ধরা বড় কঠিন, তিনি প্রতিশোধ গ্রহণের ক্ষমতা রাখেন এবং তিনি খুব দ্রুত হিসাব গ্রহণকারী; ফলে সে তাঁর আনুগত্য করার মাধ্যমে তাঁকে ভয় করে এবং আত্মরক্ষা করে তাঁর অবাধ্য না হওয়ার মধ্য দিয়ে; ফলে এটাও আল্লাহ তা‘আলার সাথে তার পক্ষ থেকে আদব বলে গণ্য হয়; কারণ, কোনো বুদ্ধিমানের নিকটই এটা আদব বলে গণ্য হবে না যে, একজন দুর্বল আক্ষম বান্দা মহাপরাক্রমশালী প্রবল শক্তিধর মহান ‘রব’ আল্লাহ তা‘আলার মুখোমুখী হবে বা তাঁর বিরোধিতা করবে; অথচ আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

[ وَإِذَآ أَرَادَ ٱللَّهُ بِقَوۡمٖ سُوٓءٗا فَلَا مَرَدَّ لَهُۥۚ وَمَا لَهُم مِّن دُونِهِۦ مِن وَالٍ ] [الرعد: ١١]

“আর কোনো সম্প্রদায়ের জন্য যদি আল্লাহ অশুভ কিছু ইচ্ছে করেন, তবে তা রদ হওয়ার নয় এবং তিনি ছাড়া তাদের কোনো অভিভাবক নেই।”[14]

আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:

[ إِنَّ بَطۡشَ رَبِّكَ لَشَدِيدٌ ] [البروج: ١٢]

“নিশ্চয় আপনার রবের পাকড়াও বড়ই কঠিন।”[15]

তিনি আরও বলেন:

[ وَٱللَّهُ عَزِيزٞ ذُو ٱنتِقَامٍ ] [ال عمران: ٤]

“আর আল্লাহ মহা-পরাক্রমশালী, প্রতিশোধ গ্রহণকারী।”[16]

আর মুসলিম ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলার অবাধ্য হওয়ার মুহূর্তে এবং তাঁর আনুগত্য থেকে বেরিয়ে আসার সময় তাঁর প্রতি এমনভাবে লক্ষ্য করে যে, মনে হয় যেন আল্লাহর দেওয়া হুমকি তাকে পেয়ে বসেছে, তাঁর আযাব বুঝি তার প্রতি নাযিল হয়ে গেল এবং তাঁর শাস্তি যেন তার আঙ্গিনায় আপতিত হল; অনুরূপভাবে সে তাঁর আনুগত্য করার মুহূর্তে এবং তাঁর শরী‘য়তের অনুসরণ করার সময় তাঁর প্রতি এমনভাবে লক্ষ্য করে যে, মনে হয় যেন তিনি তাঁর দেয়া প্রতিশ্রুতি তার জন্য সত্যে পরিণত করে দিয়েছেন এবং তাঁর সন্তুষ্টির চাদর খুলে তাকে ঢেকে দিয়েছেন; সুতরাং এটা হলো মুসলিম ব্যক্তির পক্ষ থেকে আল্লাহ তা‘আলার প্রতি সুধারণা বিশেষ; আর আল্লাহর প্রতি ভালো ধারণা পোষণ করাটা আদব বা শিষ্টাচারের অন্তর্ভুক্ত; কেননা, কোনো ব্যক্তি কর্তৃক আল্লাহ তা‘আলার প্রতি খারাপ ধারণা পোষণ করাটা কোনো ভাবেই আদবের মধ্যে পড়ে না; কারণ, সে তাঁর অবাধ্য হয়ে চলবে এবং তাঁর আনুগত্যের গণ্ডি থেকে বেরিয়ে যাবে, আর ধারণা করবে যে, তিনি তার ব্যাপারে অবগত নন এবং তিনি তাকে তার পাপের জন্য পাকড়াও করবেন না; অথচ তিনি বলেন:

 [ وَلَٰكِن ظَنَنتُمۡ أَنَّ ٱللَّهَ لَا يَعۡلَمُ كَثِيرٗا مِّمَّا تَعۡمَلُونَ ٢٢ وَذَٰلِكُمۡ ظَنُّكُمُ ٱلَّذِي ظَنَنتُم بِرَبِّكُمۡ أَرۡدَىٰكُمۡ فَأَصۡبَحۡتُم مِّنَ ٱلۡخَٰسِرِينَ ] [فصلت: ٢٢،  ٢٣]

“বরং তোমরা মনে করেছিলে যে, তোমরা যা করতে তার অনেক কিছুই আল্লাহ জানেন না। আর তোমাদের রব সম্বন্ধে তোমাদের এ ধারণাই তোমাদের ধ্বংস করেছে। ফলে তোমরা হয়েছ ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত।”[17]

অনুরূপভাবে আল্লাহ তা‘আলার সাথে এটাও আদব নয় যে, বান্দা তাঁকে ভয় করবে ও তাঁর আনুগত্য করবে এবং ধারণা করবে যে, তিনি তাকে তার ভালো কাজের প্রতিদান দিবেন না এবং তার পক্ষ থেকে তিনি তাঁর আনুগত্য ও ‘ইবাদতকে কবুল করবেন না; অথচ তিনি বলেন:

[ وَمَن يُطِعِ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُۥ وَيَخۡشَ ٱللَّهَ وَيَتَّقۡهِ فَأُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلۡفَآئِزُونَ ] [النور: ٥٢]

“আর যে কেউ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে, আল্লাহকে ভয় করে ও তাঁর তাকওয়া অবলম্বন করে, তাহলে তারাই কৃতকার্য।”[18]

আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:

[ مَنۡ عَمِلَ صَٰلِحٗا مِّن ذَكَرٍ أَوۡ أُنثَىٰ وَهُوَ مُؤۡمِنٞ فَلَنُحۡيِيَنَّهُۥ حَيَوٰةٗ طَيِّبَةٗۖ وَلَنَجۡزِيَنَّهُمۡ أَجۡرَهُم بِأَحۡسَنِ مَا كَانُواْ يَعۡمَلُونَ ] [النحل: ٩٧]

“মুমিন হয়ে পুরুষ ও নারীর মধ্যে যে কেউ সৎকাজ করবে, তাকে আমি অবশ্যই পবিত্র জীবন দান করব এবং তাদেরকে তাদের কর্মের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার দান করব।”[19]

আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:

[ مَن جَآءَ بِٱلۡحَسَنَةِ فَلَهُۥ عَشۡرُ أَمۡثَالِهَاۖ وَمَن جَآءَ بِٱلسَّيِّئَةِ فَلَا يُجۡزَىٰٓ إِلَّا مِثۡلَهَا وَهُمۡ لَا يُظۡلَمُونَ  ] [الانعام: ١٦٠]

“কেউ কোনো সৎকাজ করলে সে তার দশ গুণ পাবে। আর কেউ কোনো অসৎ কাজ করলে তাকে শুধু তার অনুরূপ প্রতিফলই দেয়া হবে এবং তাদের প্রতি যুলুম করা হবে না।”[20]

আর মূলকথা হলো: মুসলিম ব্যক্তি কর্তৃক তার প্রতিপালকের দেয়া নি‘য়ামতের জন্য তাঁর শুকরিয়া আদায় করা, তাঁর অবাধ্যতার দিকে ধাবিত হওয়ার সময় তাঁকে লজ্জা পাওয়া, তাঁর কাছে সত্যিকার অর্থে তাওবা করা, তাঁর উপর ভরসা করা, তাঁর রহমতের প্রত্যাশা করা, তাঁর শাস্তিকে ভয় করা, তাঁর প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করার ব্যাপারে এবং তাঁর ইচ্ছা মাফিক তাঁর কোনো বান্দার প্রতি শাস্তিমূলক প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের ব্যাপারে তাঁর প্রতি ভালো ধারণা পোষণ করাটাই হলো আল্লাহ তা‘আলার সাথে তার আদব রক্ষা করে চলা; আর বান্দা কর্তৃক এ আদবের যতটুকু ধারণ ও রক্ষা করে চলবে, ততটুকু পরিমাণে তার মর্যাদা সমুন্নত হবে, মান উন্নত হবে এবং সম্মান বৃদ্ধি পাবে; ফলে সে আল্লাহর অভিভাবকত্ব ও তা তাঁর তত্ত্ববধানে থাকা ব্যক্তিবর্গের অন্তর্ভুক্ত হবে এবং তাঁর রহমত ও নি‘য়ামত পাওয়ার উপযুক্ত হবে।

আর এটাই মুসলিম ব্যক্তির দীর্ঘ জীবনের একমাত্র চাওয়া এবং চূড়ান্ত প্রত্যাশা। হে আল্লাহ! আপনি আমাদেরকে আপনার অভিভাবকত্ব নসীব করুন, আপনি আমাদেরকে আপনার তত্ত্ববধান থেকে বঞ্চিত করবেন না এবং আমাদেরকে আপনার নিকটতম বান্দাগণের অন্তর্ভুক্ত করুন; হে আল্লাহ! হে জগতসমূহের প্রতিপালক! আমাদের আবেদন কবুল করুন।

……………………………………………………


[1] সূরা আন-নাহল, আয়াত: ৫৩

[2] সূরা আন-নাহল, আয়াত: ১৮

[3] সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৫২

[4] সূরা নূহ, আয়াত: ১৩ – ১৪

[5] সূরা আত-তাগাবুন, আয়াত: ৪

[6] সূরা ইউনুস, আয়াত: ৬১

[7] সূরা হুদ, আয়াত: ৫৬

[8] সূরা আয-যারিয়াত, আয়াত: ৫০

[9] সূরা আল-মায়িদা, আয়াত: ২৩

[10] সূরা আল-আ‘রাফ, আয়াত: ১৫৬

[11] সূরা আশ-শুরা, আয়াত: ১৯

[12] সূরা ইউসূফ, আয়াত: ৮৭

[13] সূরা আয-যুমার, আয়াত: ৫৩

[14] সূরা আর-রা‘দ, আয়াত: ১১

[15] সূরা আল-বুরূজ, আয়াত: ১২

[16] আলে ইমরান, আয়াত: ৪

[17] সূরা ফুসসিলাত, আয়াত: ২২ – ২৩

[18] সূরা আন-নূর, আয়াত: ৫২

[19] সূরা আন-নাহল, আয়াত: ৯৭

[20] সূরা আল-আন‘আম, আয়াত: ১৬০

ক্রোধ থেকে পরিত্রাণের উপায়

$
0
0

অনুবাদক : শিহাব উদ্দিন হোসাইন আহমদ

عن أبي هريرة- رَضِيَ اللهُ عَنْهُ- أَنَّ رَجُلاً قَالَ لِلنَّبِيُّ- صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَ سَلَّمَ: أوْصِنِيْ قَالَ : لَا تَغْضَبْ، فَرَدَّدَ مِرَارًا، قَالَ : لَا تَغْضَبْ. رواه البخاري (৫৬৫১)

আবু হুরাইরা রা. বর্ণনা করেন, জনৈক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ -সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর দরবারে এসে বললেন, আমাকে কিছু উপদেশ দিন। রাসূল বললেন, ক্রুদ্ধ হয়ো না। সে ব্যক্তি বারংবার উপদেশ চাইলে রাসূল (একই উত্তর দিয়ে) তাকে বললেন, ক্রদ্ধ হয়ো না। বোখারি-৫৬৫১

আভিধানিক ব্যাখ্যা

أَنَّ رَجُلاً তিনি ছিলেন রাসূলের বিশিষ্ট সাহাবি জারিয়া বিন কুদামাহ রা.।
لَا تَغْضَبْ অর্থাৎ, যে সকল কারণে রাগ আসে সেগুলো থেকে দূরে থাক।
، فَرَدَّدَ مِرَارًا সে ব্যক্তি বারংবার প্রশ্ন করে এ প্রত্যাশা করছিলেন যে, আরো অধিক উপকারী ও ব্যাপক কোন বিষয় রাসূল তাকে জ্ঞাত করাবেন। কিন্তু রাসূল সাল¬াল¬াহু আলাইহি ওয়াসাল¬াম অন্য কিছু না বলে একটি উপদেশের উপরেই ক্ষান্ত রইলেন।

হাদিসের শিক্ষণীয় বিষয়

(১) উলে¬খিত হাদিসটি রাসূলের ‘জামিউল কালাম’- এর মধ্য থেকে অন্যতম। সংক্ষিপ্ত শব্দে যাতে ব্যাপক অর্থময় মর্মের বিস্তার করা হয়। বিজ্ঞ আলেমগণ এ হাদিসের সুদীর্ঘ ব্যাখ্যা দিয়েছেন। কেননা এতে অনেক শিক্ষণীয় বিষয়, সূক্ষ্মতা ও গোপন রহস্য লুকিয়ে আছে। প্রতিটি মুসলমানের উচিত নবী রাসূলুল্লাহ -সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন তা অনুসরণ ও জীবনে পূর্ণ বাস্তাবায়ন করা।
(২) ক্রোধ হল মানুষ্য চরিত্রের এক অস্বাভাবিক অবস্থা। যা সুনির্দিষ্ট কারণে হয়ে থাকে। এই ক্রোধের পরিণতি অত্যন্ত ভয়াবহ। ক্রোধ বিষয়ে মানুষের যেমন বিভিন্ন অবস্থান রয়েছে, তেমনিভাবে এ বিষয়ে ইসলামেরও দিক নির্দেশনা দিয়েছে নানাভাবে। মানুষের উচিত এ গুলোকে ভালোভাবে অবলোকন করা, এবং সঠিক ও যথাযথ উপায়ে প্রয়োগ করা।

ক্রোধের প্রকার

ক্রোধ বিভিন্ন প্রকার। নিম্নে তার সার বর্ণনা করা হল।

(ক) প্রশংসনীয় ক্রোধ : যেমন আললাহর প্রতি মহব্বত পোষণকারী কোন মুসলিম যখন আললাহদ্রোহী কোন কাজ হতে দেখে, তখন সে ক্রুদ্ধ হয়। এই ক্রোধ প্রশংসনীয়। এমন ব্যক্তি আললাহর নিকট পুরস্কৃত হবে। আললাহ তাআলা বলেন—
ذَلِكَ وَمَنْ يُعَظِّمْ حُرُمَاتِ اللَّهِ فَهُوَ خَيْرٌ لَهُ عِنْدَ رَبِّهِ
এটাই বিধান। আর কেউ আললাহর সম্মানযোগ্য বিধানাবলীর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করলে পালনকর্তার নিকট তা তার জন্য উত্তম। সূরা হজ : ৩০

(খ) নিন্দনীয় ক্রোধ: এ এমন ক্রোধ যা হতে রাসূলুল্লাহ -সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিষেধ করেছেন। যেমন নিজের অন্যায় দাবী প্রতিষ্ঠা করার জন্য ক্রুদ্ধ হওয়া। এ প্রকারের ক্রোধান্ধ ব্যক্তি আললাহর নিকট ঘৃণিত।
(গ) স্বভাবগত ক্রোধ: যেমন কারো স্ত্রী তার কথা অমান্য করলে সে ক্রুদ্ধ হয়, এই প্রকারের ক্রোধ হালাল, কিন্তু এর কু-পরিণামের কারণে এই ক্রোধ থেকেও বারণ করা হয়েছে। একে রাসূলের নিষিদ্ধ ক্রোধের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

ক্রোধের কতিপয় কারণ

(ক) স্বভাবগত ক্রোধ
(খ) অহংকারের ফলে উদ্ভূত ক্রোধ
(গ) ব্যক্তিত্ব ও নেতৃত্বের লালসা জনিত ক্রোধ
(ঘ) অনর্থক কলহ বশত: ক্রোধ
(ঙ) অত্যধিক হাসি মজাক ও ঠাট্টা বিদ্রƒপ জনিত ক্রোধ

ক্রোধের পরিণাম খুবই অমঙ্গলজনক

(ক) ক্রোধ বুদ্ধিমান ব্যক্তির বুদ্ধি নির্ভুলভাবে প্রয়োগে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে, ফলে উত্তেজনার বশীভূত হয়ে অন্যায়ের নির্দেশ প্রদান করে। অত:পর যখন ক্রোধ থেমে যায়, তখন এর জন্য লজ্জিত হয়। যেমন কেউ ক্রোধে অস্থির হয়ে স্ত্রীকে তালাক দিয়ে ফেলল। বা নিজ সন্তানকে অথবা আপনজনকে এমন প্রহার করল যে, সে রক্তাক্ত হয়ে গেল। এহেন ক্রোধের কারণে নিশ্চয় পরবর্তীতে সে লজ্জিত হবে।
(খ) ক্রোধান্ধ ব্যক্তি থেকে মানুষ পলায়ন করে, বর্জন করে তার আশপাশ। ফলে সে কখনো মানুষের শ্রদ্ধা ও আন্তরিকতা লাভ করতে পারে না, বঞ্চিত হয় মানুষের সু-দৃষ্টি হতে। বরং সব সময় মানুষের নিকট সে ঘৃণিত হয়ে থাকে।
(গ) ক্রোধ হল মানুষের মাঝে শয়তানের প্রবেশদ্বার। এ পথে প্রবেশ করে মানুষের জ্ঞান বুদ্ধি নিয়ে সে খেলা করে।
(ঘ) ক্রোধ পাপ কাজের দ্বার উন্মুক্তকারী।
(ঙ) ক্রোধ সমাজে বিরাজমান পারস্পরিক আন্তরিকতা ও সৌহার্দ্যকে ভেঙে দিয়ে বিশৃঙ্খলা ও অমানবিকতা সৃষ্টি করে।
(চ) ক্রোধ স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ক্ষতিকর। কেননা অত্যধিক ক্রোধ মস্তিষ্ক—যা সম্পূর্ণ শরীরের নিয়ন্ত্রক—এর উপর আঘাত হানে। ফলে তা বহু মূত্র, রক্তের বায়ুচাপ, ও হার্টের দুর্বলতাসহ অনেক রোগের কারণ হয়।
(জ) ক্রোধের পরিণামফল হল, নিজের সম্পদ ধ্বংস করা ও মানুষের রোষানলে পতিত হওয়া।

এই ক্ষতিকর ক্রোধ থেকে পরিত্রাণের উপায়

(ক) যে সমস্ত কারণে মানুষ ক্রুদ্ধ হয় সেগুলো থেকে দূরে থাকা।

(খ) মুখ ও অন্তর দ্বারা আললাহর জিকির করা। কেননা, ক্রোধ হল শয়তানের কু-প্রভাবের বিষক্রিয়া।

তাই যখন মানুষ আললাহর জিকির করে তখন শয়তানের প্রভাব মুক্ত হয়ে যায়। আললাহ বলেন—
যারা বিশ্বাস স্থাপন করে এবং তাদের অন্তর আল¬াহর জিকির দ্বারা শান্তি লাভ করে , জেনে রাখ আললাহর জিকির দ্বারাই অন্তরসমূহ শান্তি পায়। রা’দ : ২৮
(গ) ক্রোধ পরিত্যাগ ও মানুষকে ক্ষমার সওয়াবের কথা স্মরণ করা। এ প্রসঙ্গে মহান আললাহ বলেন—
তোমরা তোমাদের পালনকর্তার ক্ষমা ও জান্নাতের দিকে ছুটে যাও, যার সীমানা হচ্ছে, আসমান জমিন, যা তৈরি করা হয়েছে মুত্তাকীদের জন্য। যারা সচ্ছলতায় ও অভাবের সময় ব্যয় করে, যারা নিজেদের রাগকে সম্বরণ করে, আর মানুষের প্রতি ক্ষমা প্রদর্শন করে, বস্তুত: আললাহর সৎকর্মশীলদেরকেই ভালোবাসেন। আলে ইমরান : ১৩৩, ১৩৪
রাসূল বলেন—
لا تغضب و لك الجنة.
ক্রুদ্ধ হয়ো না, প্রতিদানে তোমার জন্য জান্নাত। যাদুদ দায়িয়াহ : ৪৯

(ঘ) ক্রোধের মন্দ পরিণতির কথা স্মরণ করা। ক্রোধান্ধ ব্যক্তি যদি ক্রুদ্ধ অবস্থায় নিজ অশোভণীয় বিকৃত আকৃতি দেখতে পেত তাহলে লজ্জায় তখনি ক্ষান্ত হয়ে যেত।

(চ) ক্রুদ্ধ ব্যক্তির অবস্থার পরিবর্তন করা, যে অবস্থায় ছিল তার পরিবর্তে অন্য অবস্থা গ্রহণ করা।

(ছ) ওজু করা, তা এই জন্য যে ক্রোধ হল শয়তানের পক্ষ থেকে। আর শয়তান আগুনের তৈরি। আর আগুন পানি দ্বারা নির্বাপিত হয়ে যায়। এ প্রসঙ্গে রাসূলের সুস্পষ্ট বাণী রয়েছে।

(জ) যখন ক্রোধ আসবে, তখন أعوذ بالله من الشيطان الرجيم পড়ে নিবে। কেননা মানুষ শয়তানের প্রভাবে ক্রোধাক্রান্ত হয়, যখন সে উক্ত বাক্য পাঠ করে তখন শয়তান পিছু হটে যায়, যেমন হাদিসে আছে—
দ্ইু ব্যক্তি রসুলের সামনে একে অন্যকে কটু বাক্য বলছিল। তাদের চেহারা বিবর্ণ হয়ে গিয়েছিল। রাসূলুল্লাহ -সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আমি এমন বাণী সম্পর্কে অবগত, যদি সে তা পাঠ করত, তবে তার ক্রোধ দূরীভূত হত। যদি সে আউযু বিল¬লাহি মিনাশ শায়তানির রাজিম বলত, তবে তার ক্রোধ দূর হয়ে যেত। বোখারি : ৫৬৫০

(৭) মোমিনের বিশেষ গুণ হল সে সব সময় উভয় জগতের মঙ্গলজনক কাজে সচেষ্ট থাকে, যেমন হাদিসে বর্ণিত ব্যক্তি উপদেশের জন্য রাসূলের উপস্থিতিকে সুবর্ণ সুযোগ মনে করে রাসূল থেকে বারংবার উপদেশ চাচ্ছিলেন, যা তার জীবনের পাথেয় হবে। বর্তমান যুগে আললাহর পথে আহ্বায়ক ও আলেম সম্প্রদায়ের উপস্থিতি আললাহর অনুগ্রহ মনে করে তাদের শিক্ষা, আদেশ ও উপদেশ থেকে উপকৃত হওয়া উচিত।

সমাপ্ত

সময় ব্যবস্থাপনা –আপনার ফলপ্রসূ ও চৌকস জীবনের চাবিকাঠি

$
0
0
মূল : আবু প্রোডাক্টিভ । ভাষান্তর : মোহাম্মদ সলিমুল্লাহ । সম্পাদনা : আব্‌দ আল-আহাদ আমার পুরনো এক বন্ধু আমাকে একবার বলেছিল, “একটা পুরান কথা (myth) ইদানীং খুব চলছে। কথাটা এমন : “সময়কে…

ব্যবসা-বাণিজ্যে সততা

$
0
0
লেখকঃ ড. মুহাম্মাদ আজিবার রহমান | ওয়েব সম্পাদনাঃ শাবাব শাহরিয়ার খান জীবিকা নির্বাহের প্রয়োজনে মানুষকে উপার্জনের নানাবিধ পথ বেছে নিতে হয়। ইসলামের দিকনির্দেশনা হ’ল হালাল পথে জীবিকা উপার্জন করা। হারাম…

ফজরের সালাতের জন্য জেগে উঠার কিছু কার্যকরী কৌশল

$
0
0
মুল প্রবন্ধঃ ProductiveMuslim.com | অনুবাদঃ মুসাফির শহীদ আমরা যারা নিয়মিত সালাত আদায় করার চেষ্টা করি, আমাদের সবগুলো সালাত ঠিক থাকলেও ‘ফজরের সালাত’ নিয়ে কিছুটা সমস্যায় পড়তে হয়। অনেকেই অনেক চেষ্টা করেও পারি না…

কার্যকর অধ্যনের ৫টি ফলপ্রসূ বৈশিষ্ট্য

$
0
0
লেখক : ইয়াকুব আলী | ভাষান্তর : মোহাম্মদ সলিমুল্লাহ | সম্পাদনা : আব্‌দ আল-আহাদ   অনেকেই বই পড়েন। কিন্তু যখন জিজ্ঞেস করা হয় কী পড়েছেন, তখন মস্তিকের সাথে যুদ্ধ করতে…

মানুষ কষ্ট দিলে মনের ক্ষত সারাবেন যেভাবে

$
0
0
মূল প্রবন্ধ : ইয়াসমিন মোজাহেদ | ভাষান্তর : মোঃ মুনিমুল হক |  সম্পাদনা : আব্‌দ আল-আহাদ যখন ছোট ছিলাম, পৃথিবীটাকে মনে হতো একেবারেই নির্ঝঞ্ঝাট এবং খুব পরিপাটি একটা জায়গা। কিন্তু বড়…

পর্ব ১ –একজন ঈমানদার দা‘ঈর বর্জিত গুণাবলি

$
0
0
লেখক:মুহাম্মদ শাহিদুল ইসলাম (সহকারী অধ্যাপক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, উত্তরা ইউনিভার্সিটি, ঢাকা) পর্ব ১ | পর্ব ২ | পর্ব ৩ | পর্ব ৪| পর্ব ৫ | পর্ব ৬ | পর্ব ৭| পর্ব ৮ | পর্ব ৯ | পর্ব ১০  ভূমিকা মহান…

খাদ্য অপচয়

$
0
0
লেখক: শরীফ আবু হায়াত অপু ২০০৫ সালের কথা। দীপালিদের বাসায় নিয়ম ছিল যে সে খাবে রাতের ভাত, আর দুপুরে খাবে তারভাই। এই নিয়মের পিছনে জিরো ফিগারের বাসনা না – ছিল তার…

দৃষ্টি সংযত রাখার মাহাত্ম্য ও মর্যাদা

$
0
0
ভাষান্তর : হামিদা মুবাশ্বেরা | সম্পাদনা : আব্‌দ আল-আহাদ আল্লাহ্‌ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা বলেছেন, “(হে নবী) আপনি  মু’মিন পুরুষদের বলুন, তারা তাদের দৃষ্টিকে সংযত রাখবে এবং তাদের  লজ্জাস্থানের হিফাযত করবে। এটাই তাদের জন্য অধিক পবিত্র।…

আপনার সন্তান থেকে আপনি কী চান?

$
0
0
লেখকঃ আহমেদ রফিক গাজিপুর থেকে ঢাকা ফিরছিলাম। বাসে উঠে বসলাম। কিছুক্ষন পর এক মুরব্বী উঠে আমার পাশেই বসলেন। আমি সালাম দিলাম। স্নিগ্ধ কোমল চেহারা। শ্বেত-শুভ্র লম্বা দাড়ি। দেখলেই শ্রদ্ধা করতে ইচ্ছা করে। বয়সের ভারে বেশ ন্যুজ বোঝা যায়। যেন জোর করেই লুকোনোর চেষ্টা। কালো প্যান্ট সাদা শার্ট পরা। ইন করা। হাতে একটি এক্সিকিউটিভ ফাইল। কাগজ-পত্র […]

বাতিঘর

$
0
0
লেখিকাঃ রেহনুমা বিনত আনিস    কোণাচোখে তারিককে পাশের টেবিলে আরাম করে বসতে দেখে জামিল দ্রুত গলা নামিয়ে বলে, ‘শুনুন, আপনি কিন্তু কিছুতেই আমাকে বিয়ে করতে রাজি হবেননা’। ঘটনার আকস্মিকতায় থতমত খেয়ে যায় ফারজানা। সে লোকটাকে চেনেনা, জানেনা, কোন সালাম নেই, সম্ভাষন নেই, হুট করে এই আচমকা অনুরোধ! তারিকের দিকে জামিলের চোরা চাহনি, ফিসফিস কথা বলার ভঙ্গি […]

এক মিনিটে আপনি কি কি আমল করতে পারেন

$
0
0
প্রশ্ন: আমরা অফিসে বা কর্মস্থলে ইবাদত-বন্দেগী ও নেককাজের তেমন কোন সময় পাই না। অফিসের পর বাকী যে সামান্য সময় পাই এর মধ্যে আমরা কি কি আমল করতে পারি এবং এ সময়কে কিভাবে কাজে লাগাতে পারি? উত্তর: সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য। সময় মানুষের জীবন। সময়কে কখনো অপচয় হতে বা অকাজে নষ্ট হতে দেয়ার মত নয়। প্রজ্ঞাবান ও […]

কুরআন থেকে দূরে পলায়ন

$
0
0
লিখেছেনঃ   শায়েখ আবদুল আজিজ ইবনে বায  | বাংলা অনুবাদঃ  জহিরুল কাইয়ুম প্রশ্নঃ প্রিয় শেইখ, যারা এক মাস অথবা এমনকি অনেক অনেক মাস যাবত কুরআন পাঠ/তেলাওয়াত করে না এবং এমন আচরণের জন্য কোন অজুহাতও নেই তাদের জন্য আপনার উপদেশ কি ? যাই হোক, আপনি দেখে থাকবেন তাদের কেউ কেউ এমন সব ম্যাগাজিন পড়ে এবং গভীরভাবে অনুসরণ করে যেগুলো তাদের জন্য […]

পরাজিত মানসিকতার মুসলিম

$
0
0
লেখকঃ আবু হামযা ‘তারবিয়াহ’ একটি আরবি শব্দ যার ভাষাগত অর্থ হচ্ছে বৃদ্ধি করা, জন্মানো, উন্নতি ইত্যাদি। প্রচলিত অর্থে, তারবিয়াহ’ মানে হচ্ছে মানুষকে বিভিন্ন উপায়ে উন্নত করা ও প্রশিক্ষণ দান । তাকওয়া, ইলম অর্জন, অন্যদের ইসলাম সম্পর্কে শিক্ষা দান এগুলো সবই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের তারবিয়াহ’র অন্তর্ভুক্ত তবুও কিছু সুনির্দিষ্ট বিষয়ে মুসলিমদের মানসিকতা উন্নয়ন কিংবা ‘তারবিয়াহ’র বিষয়টি হয়তো […]
Viewing all 452 articles
Browse latest View live


<script src="https://jsc.adskeeper.com/r/s/rssing.com.1596347.js" async> </script>