Quantcast
Channel: QuranerAlo.com – কুরআনের আলো ইসলামিক ওয়েবসাইট
Viewing all 452 articles
Browse latest View live

দুনিয়ার মোহ ত্যাগ করা ও দারিদ্রতার মাহাত্ম্য

$
0
0

 

আল্লাহ তাআলা বলেন,

"বস্তুতঃ পার্থিব জীবনের দৃষ্টান্ত তো বৃষ্টির মত, যা আমি আসমান হতে বর্ষণ করি। অতঃপর তার দ্বারা উৎপন্ন হয় ভূপৃষ্টের উদ্ভিদগুলো অতিশয় ঘন হয়, যা থেকে মানুষ ও পশুরা ভক্ষণ করে। অতঃপর যখন ভূমি তার শোভা ধারণ করে ও নয়নাভিরাম হয়ে ওঠে এবং তার মালিকরা মনে করে যে, তারা এখন তার পুর্ন অধিকারী, তখন দিনে অথবা রাতে তার উপর আমার (আযাবের) আদেশ এসে পড়ে, সুতরাং আমি তা এমনভাবে নিশ্চিহ্ন করে দেই, যেন গতকাল তার অস্তিত্বই ছিল না। এরুপেই আয়াতগুলোকে আমি চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য বিশদরূপে বর্ণনা করে থাকি"।(সূরা ইউনুস ২৪)

তিনি আরও বলেন,

"তাদের কাছে পেশ কর উপমা পার্থিব জীবনের; এটা পানির ন্যায় যা আমি বর্ষণ করি আকাশ হতে, যার দ্বারা ভূমির উদ্ভিদ ঘন সন্নিবিস্ট হয়ে উদগত হয়। তারপর তা বিশুষ্ক হয়ে এমন চূর্ন-বিচূর্ন হয় যে, বাতাস ওকে উড়িয়ে নিয়ে যায়। আর আল্লাহ সর্ব বিষয়ে শক্তিমান। ধনঐশ্বর্য ও সন্তান-সন্ততি পার্থিব জীবনের শোভা। আর সৎকার্য, যার ফল স্থায়ী, ওটা তোমার প্রতিপালকের নিকট পুরস্কার প্রাপ্তির জন্য শ্রেষ্ঠ এবং আশা প্রাপ্তির ব্যাপারেও উৎকৃষ্ট।" (সূরা কাহফ ৪৫-৪৬ )

 আরো অন্য জায়গায় তিনি বলেছেন,

 "তোমার জেনে রাখো যে, পার্থিব জীবন তো ক্রীড়া-কৌতুক, জাঁকজমক, পারষ্পরিক অহংকার প্রকাশ, ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি প্রাচুর্য লাভের প্রতিযোগিতা ব্যতীত আর কিছুই নয়। এর উপমা বৃষ্টি; যার দ্বারা উৎপন্ন ফসল কৃষকদেরকে চমৎকৃত করে, তারপর তা শুকিয়ে যায়, ফলে তুমি তা পীতবর্ন দেখতে পাও, অবশেষে তা টুকরো-টুকরো (খড়-কুটায়) পরিণত হয় এবং পরকালে রয়েছে কঠিন শাস্তি এবং আল্লাহর ক্ষমা ও সন্তুষ্টি। আর পার্থিব জীবন ছলনাময় ভোগ ব্যতীত কিছুই নয়।" (সূরা হাদীদ ২০ আয়াত)

অন্যএ আল্লাহ তাআলা বলেন,

 "নারী, সন্তান-সন্ততি, জমাকৃত সোনা-রূপার ভাণ্ডার, পছন্দসই (চিহ্নত) ঘোরা, চতুষ্পদ জন্তু ও ক্ষেত-খামারের প্রতি আসক্তি মানুষের নিকট লোভনীয় করা হয়েছে। এ সব ইহজীবনের ভোগ্য বস্ত। আর আল্লাহর নিকতেই উওম আশ্রয়স্থল রয়েছে"। (আলে ইমরান ১৪)

তিনি আরো বলেন,

" হে মানুষ! আল্লাহর প্রতিশ্রুতি সত্য; সুতরাং পার্থিব জীবন যেন কিছুতেই তোমাদেরকে প্রতারিত না করে এবং কোন প্রবঞ্চক যেন কিছুতেই আল্লাহ সম্পর্কে প্রবঞ্চিত না করে"। (সূরা ফাত্বির ৫ আয়াত)

আল্লাহ তাআলা অন্য জায়গায় বলেন, 

  "প্রাচুর্যের প্রতিযোগিতা তোমাদেরকে মোহাচ্ছন্ন করে রেখেছে। যতক্ষণ না তোমরা (মরে) কবরে উপস্থিত হও। কখনও নয়, তোমরা শীঘ্রই জানতে পারবে। আবার বলি, কখনও নয়, তোমরা শীঘ্রই জানতে পারবে। সত্যিই, তোমরা নিশ্চিত জ্ঞান থাকলে অবশ্যই তোমরা জানতে (ঐ প্রতিযোগিতার পরিণাম)" (সূরা তাকাসুর ১-৫ আয়াত)

তিনি আরও বলেন,

 "এ পার্থিব জীবন তো খেল-তামাশা ছাড়া কিছুই নয়। আর পরলৌকিক জীবনই তো প্রকৃত জীবন; যদি ওরা জানত"। (সূরা আনকাবূত ৬৪ আয়াত)

এ মর্মে প্রচুর আয়াত ও হাদীস রয়েছে। তার মধ্যে কয়েকটি হাদীস বর্ণনা করা হল-

১) আমর ইবনে আউফ আনসারী (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) একবার আবূ উবাইদাহ ইবনে জারাহকে জিযিয়া (ট্যাক্স) আদায় করার জন্য বাহরাইন পাঠালেন। তারপর তিনি বাহরাইন থেকে (প্রচুর) মাল নিয়ে এলেন। আনসারগন তাঁর আগমনের সংবাদ শুনে ফজরের নামাযে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সঙ্গে শরীক হলেন। যখন তিনি নামায পড়ে (নিজ বাড়ি) ফিরে যেতে লাগলেন, তখন তারা তাঁর সামনে এলেন।  রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাদেরকে দেখে হেসে বললেন, “আমার মনে হয়, তোমরা আবূ উবাইদাহ বাহরাইন থেকে কিছু (মাল) নিয়ে এসেছে, তা শুনেছ।”  তারা বলল, ‘জী হ্যাঁ ।' তিনি বললেন, “সুসংবাদ গ্রহণ কর এবং তোমরা সেই আশা রাখ, যা তোমাদেরকে আনন্দিত করবে। তবে আল্লাহর কসম! তোমাদের উপর দারিদ্র্য আসবে আমি এ আশংকা করছি না.বরং আশংকা করছি যে, তোমাদের পূর্ববর্তী উম্মতের ন্যায় তোমাদেরও পার্থিব জীবনে প্রশস্তুতা আসবে। আর তাতে তোমরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে, যেমন তাদেরকে ধ্বংস করে দিয়েছিল।।” (সহীহুল বুখারী ৩১৫৮,৪০১৫, মুসলিম ২৯৬১)

২) আবূ সাইদ খুদরী (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মিম্বরে বসলেন এবং আমরা তাঁর আশেপাশে বসলাম। তারপর তিনি বললেন, “আমি তোমদের উপর যার আশঙ্কা করছি তা হল এই যে, তোমাদের উপর শোভা ও সৌন্দর্য (এর দরজা) খুলে দেওয়া হবে।” (সহীহুল বুখারী ১৪৬৫,৯২২, মুসলিম ১০৫২)

৩) উক্ত রাবী (রাঃ) থেকেই বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “দুনিয়া হচ্ছে সুমিষ্ট ও সবুজ শ্যামল এবং আল্লাহ তাআলা তোমাদেরকে তাতে প্রতিনিধি করেছেন। তারপর তিনি দেখবেন যে, তোমরা কিভাবে কাজ কর। অতএব তোমরা দুনিয়ার ব্যাপারে সাবধান হও ও নারীজাতির ব্যাপারে।” (মুসলিম ২৭৪২, তিরমিযী ২১৯১)

৪) আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, নবী (সাঃ) বলেছেন, “হে আল্লাহ! আখেরাতের জীবনই প্রকৃত জীবন।” (সহীহুল বুখারী ২৮৩৪,২৮৩৫ মুসলিম ১৮০৫)

৫) উক্ত রাবী থেকেই বর্ণিত, নবী (সাঃ) বলেছেন, “তিনটি জিনিস মৃত ব্যক্তির অনুসরণ করে (সঙ্গে যায়)  দাফনের পর দুটি ফিরে আসে, আর একটি তার সাথেই থেকে যায়। সে তিনটি হল, (এক) তার পরিবারবর্গ, (দুই) তার মাল, (তিন) তার আমল। দাফনের পর তার পরিবারবর্গ ও মাল ফিরে আসে। আর তার আমল তার সাথেই থেকে যায়।” (সহীহুল বুখারী ৬৫১৪, মুসলিম ২৯৬০)

৬) উক্ত রাবী থেকেই বর্ণিত, নবী (সাঃ) বলেছেন, “কিয়ামতের দিন জাহান্নামীদের মধ্যে হতে এমন এক ব্যক্তি নিয়ে আসা হবে, যে দুনিয়ায় সবচেয়ে সুখী ও বিলাসী ছিল। তারপর তাকে জাহান্নামে একবার (মাএ) চুবানো হবে, তারপর তাকে বলা হবে, ‘হে আদম সন্তান! তুমি কি কখনো ভাল জিনিস দেখেছ? তোমার নিকটে কি কখনো সুখ-সামগ্রী এসেছে?’ সে বলবে, ‘না। আল্লাহর কসম! হে প্রভু!’ আর জান্নাতীদের মধ্যে হতে এমন এক ব্যক্তিকে নিয়ে আসা হবে, যে দুনিয়ায় সবচেয়ে দুখী ও অভাবী ছিল। তাকে জান্নাতে (মাএ একবার) চুবানোর পর বলা হবে, ‘হে আদম সন্তান! তুমি কি দুনিয়ায়তে কখনো কষ্ট দেখছ? তোমার উপরে কি কখনো বিপদ গেছে?’ সে বলবে, ‘না। আল্লাহর কসম! আমার উপর কোনদিন কষ্ট আসেনি এবং আমি কখনো কোন বিপদও দেখিনি।” (মুসলিম ২৮০৭, আহমাদ ১২৬৯৯,১৩২৪৮)

৭) মুস্তাওরিদ ইবনে শাদ্দাদ (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “আখিরাতের মুকাবেলায় দুনিয়ার দৃষ্টান্ত ঐরূপ, যেমন তোমাদের কেউ সমুদ্রে আঙ্গুল ডুবায় এবং ( তা বের করে ) দেখে যে,  আঙ্গুলটি সমুদ্রে কতটুকু পানি নিয়ে ফিরেছে।” (মুসলিম ২৮৫৮,  আহমাদ ১৭৫৪৭,১৭৫৪৮)

৮) জাবের (রাঃ) হতে বর্ণিত,একদা রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বাজারের পাশ দিয়ে গেলেন। এমন অবস্থায় যে, তাঁর দুই পাশে লোকজন ছিল। তারপর তিনি ছোট কানবিশিষ্ট একটি মৃত ছাগল ছানার পাশ দিয়ে গেলেন। তিনি তার কান ধরে বললেন, “তোমাদের কেউ কি এক দিরহামের পরিবর্তে এটাকে নেওয়া পছন্দ করবে?” তারা বললেন, ‘আমরা কোন জিনিসের বিনিময়ে এটা নেওয়া পছন্দ করব না এবং আমারা এটা নিয়ে করবই বা কি?’ তিনি বললেন, “তোমরা কি পছন্দ কর যে, (বিনামুল্যে) এটা তোমাদের হোক?” তারা বললেন, ‘আল্লাহর কাসম! যদি এটা জীবিত থাকত তবুও সে ছোট কানের কারনে দোষযুক্ত ছিল। এখন সে মৃত (সেহেতু একে কে নেবে)?’ তিনি বললেন, “আল্লাহর কসম! তোমাদের নিকট এই  মৃত ছাগল ছানাটা যতটা  নিকৃষ্ট, দুনিয়া আল্লাহর নিকট তার চেয়ে বেশি নিকৃষ্ট।” (মুসলিম ২৯৫৭, আবূ দাউদ ১৮৬, আহমাদ ১৪৫১৩)

৯) আবূ যার (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি (একবার) নবী (সাঃ) –এর সাথে মদীনার কালো পাথুরে যমীনে হাঁটছিলাম। উহুদ পাহাড় আমাদের সামনে পড়ল। তিনি বললেন, “হে আবূ যার! এতে আমি খুশী নই যে, আমার নিকট এই উহুদ পাহাড় সমান স্বর্ণ থাকবে, এ অবস্থায় তিনদিন অতিবাহিত হবে অথচ তার মধ্যে থেকে একটি দীনারও আমার কাছে অবশিষ্ট থাকবে। অবশ্য টা থাকবে যা আমি ঋণ আদায়ের জন্য বাকী রাখব অথবা আল্লাহর বান্দাদের মাঝে এইভাবে এইভাবে এইভাবে ডানে, বামে ও পিছনে খরচ করব।”

তারপর (কিছু আগে) চলে তিনি বললেন, “প্রাচুর্যের অধিকারীরাই কিয়ামতের দিন নিঃস্ব হবে। অবশ্য সে নয় যে সম্পদকে (ফোয়ারার মত) এইভাবে এইভাবে এইভাবে ডানে, বামে ও পিছনে খরচ করে। কিন্ত এরকম লোকের সংখ্যা খুবই কম।”

তারপর তিনি আমাকে বললেন, “তুমি এখানে বসে থাক, যতক্ষণ না আমি তোমাদের কাছে (ফিরে) আসছি।” এরপর তিনি রাতের অন্ধকারে চলতে লাগলেন, এমনকি শেষ পর্যন্ত তিনি অদৃশ্য হয়ে গেলেন। হঠাৎ, আমি এক জোর শব্দ শুনলাম। আমি ভয় পেলাম যে কোন শত্রু হয়তো নবী (সাঃ)-এর সামনে পড়েছে। সুতরাং আমি তাঁর নিকট যাওয়ার ইছা করলাম, কিন্ত তাঁর কথা আমার স্মরণ হল, “তুমি এখানে বসে থাক, যতক্ষণ না আমি তোমাদের কাছে (ফিরে) আসছি।” সুতরাং আমি তাঁর ফিরে না আসা পর্যন্ত বসে থাকলাম। (তিনি ফিরে এলে) “আমি বললাম,আমি এক জোর শব্দ শুনলাম, যাতে আমি ভয় পেলাম ।” সুতরাং যা শুনলাম আমি তা তাঁর কাছে উল্লেখ করলাম।

তিনি বললেন, “তুমি শব্দ শুনেছিলে?” আমি বললাম, “জী হ্যাঁ” , তিনি বললেন, “তিনি জিবরাঈল ছিলেন। তিনি আমার কাছে এসে বললেন, “আপনার উম্মাতের মধ্যে যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক না করে মরবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।” আমি বললাম, “যদিও সে ব্যভিচার করে ও চুরি করে তবুও কি?” তিনি বললেন, “যদিও সে ব্যভিচার করে ও চুরি করে।” (সহীহুল বুখারী ৬২৬৮,১২৩৭,২৩৮৮,৩২২২, মুসলিম ৯৪)

১০) আবূ হুরাইরা (রাঃ) থেকেই বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “যদি আমার নিকট উহুদ পাহাড় সমান সোনা থাকত, তাহলে আমি এতে আনন্দিত হতাম যে, ঋণ পরিশোধের পরিমাণ মত বাকী রেখে অবশিষ্ট সবটাই তিন দিন অতিবাহিত না হতেই আল্লাহর পথে খরচ করে ফেলি।” (সহীহুল বুখারী ২৩৮৯,৬৪৪৫,৭২২৮, মুসলিম ৯৯১)

১১) উক্ত সাহাবী (সাঃ) থেকেই বর্ণিত, নবী (সাঃ) বলেছেন, “(দুনিয়ার ধন-দৌলত ইত্যাদির দিক দিয়ে) তোমারা মধ্যে যে নীচে তোমরা তার দিকে তাকাও এবং যে তোমাদের উপরে তার দিকে তাকায়ো না। যেহেতু সেটাই হবে উৎকৃষ্ট পন্থা যে, তোমাদের প্রতি যে আল্লাহর নিয়ামত রয়েছে তা তুচ্ছ মনে করবে না।” (সহীহুল বুখারী ৬৪৯০,মুসলিম ২৯৬৩)

১২) বুখারীর বর্ণনায় আছে, “তোমাদের কেউ যখন এমন ব্যক্তির দিকে তাকায়, যাকে সম্পদে ও দৈহিক গঠনে তার থেকে বেশি শ্রেষ্ঠত্ব দেওয়া হয়েছে, তখন সে যেন এমন ব্যক্তির দিকে তাকায়, যে এ বিষয়ে তার চেয়ে নিম্নস্তরের।”

১৩) আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত, নবী (সাঃ) বলেছেন, “ধ্বংস হোক দীনারের গোলাম, দিরহামের গোলাম ও উওম পোশাকের গোলাম (দুনিয়াদার)! যদি তাকে দেওয়া হয়, তাহলে সে সন্তুষ্ট হয়। আর না দেওয়া হলে অসন্তুষ্ট হয়। (সহীহুল বুখারী ২৮৮৭, ৭৪৩৫, তিরমিযী ২৫৭৫)

১৪) উক্ত সাহাবী (রাঃ) থেকেই বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘সওরজন (আহলে সুফফাকে) এই অবস্থায় দেখেছি, তাদের কারো কাছে (গা ঢাকার) জন্য চাদর ছিল না, কারো কাছে লুঙ্গী ছিল এবং কারো কাছে চাদর, (এক সঙ্গে দুটি বস্ত্রই কারো কাছে ছিল না) তারা তা গর্দানে বেঁধে নিতেন। তারপর সেই বস্ত্র কারো পায়ের অর্ধগোছা পর্যন্ত হত এবং কারো পায়ের গাঁট পর্যন্ত। সুতরাং তাঁরা তা হাত দিয়ে জমা করে ধরে রাখতেন, যেন লজ্জাস্থান দেখা না যায়!’ (সহীহুল বুখারী ৪৪২)

১৫) উক্ত রাবী থেকেই বর্ণিত, তিনি বললেন, নবী (সাঃ) বলেছেন, “দুনিয়া মু’মিনের জন্য জেলখানা এবং কাফেরের জন্য জান্নাত।” (মুসলিম ২৯৫৬, তিরমিযী ২৩২৪)

১৬) ইবনে উমার (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) (একদিন) আমার দুই কাঁধ ধরে বললেন, “তুমি এ দুনিয়াতে একজন মুসাফির অথবা পথচারীর মত থাক।” আর ইবনে উমার (রাঃ) বলতেন, ‘তুমি সন্ধ্যায় উপনীত হলে আর ভোরের অপেক্ষা করো না এবং ভোরে উপনীত হলে সন্ধ্যার অপেক্ষা করো না। তোমার সুস্থতার অবস্থায় তোমার পীড়িত অবস্থার জন্য কিছু সঞ্চয় কর এবং জীবিত অবস্থায় তোমার মৃত্যুর জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ কর।” (সহীহুল বুখারী ৬৪১৬, তিরমিযী ২৩৩৩)

*এই হাদিসটির ব্যাখ্যায় উলামাগন বলেন, দুনিয়ার দিকে ঝুঁকে পড়ো না এবং তাকে নিজের আসল ঠিকানা বানিয়ে নিও না । মনে মনে এ ধরনা করো না যে, তুমি তাতে দীর্ঘজীবী হবে। তুমি তার প্রতি যত্নবান হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করো না। তার সাথে তোমরা সম্পর্ক হবে ততটুক, যতটুক একজন প্রবাসী তার প্রবাসের সাথে রেখে থাকে। তাতে সেই বিষয়-বস্ত নিয়ে বিভোল হয়ে যেও না, যে বিষয়-বস্ত নিয়ে সেই প্রবাসের ব্যক্তি হয় না, যে স্বদেশে নিজের পরিবারের নিকট ফিরে যেতে চায়। আর আল্লাহই তওফীক দাতা।

১৭) আবুল আব্বাস সাহল ইবনে সা’দ (রাঃ) বলেন, এক ব্যক্তি নবী (সাঃ) –এর কাছে এসে বলল, ‘হে আল্লাহর রসূল! আপনি আমাকে এমন কর্ম বলে দিন, আমি তা করলে যেন আল্লাহ আমাকে ভালবাসেন এবং লোকেরাও আমাকে ভালবাসে।’ তিনি বললেন, “দুনিয়ার প্রতি বিতৃষ্ণা আনো, তাহলে আল্লাহ তোমাকে ভালবাসবেন। আর লোকদের ধন-সম্পদের প্রতি বিতৃষ্ণা আনো, তাহলে লোকেরা তোমাকে ভালবাসবে।” (ইবনু মাজাহ ৪১০২)

১৮) নু’মান ইবনে বাশীর (রাঃ) বলেন, উমার ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) (পূর্বেকার তুলনায় বর্তমানে) লোকেরা যে দুনিয়ার (ধন-সম্পদ) অধিক জমা করে ফেলেছে সে কথা উল্লেখ করে বললেন, ‘আমি রাসূলুল্লাহ (সাঃ) –কে দেখেছি, তিনি সারা দিন ক্ষুধায় থাকর ফলে পেটের উপর ঝুঁকে থাকতেন (যেন ক্ষুধার জ্বালা কম অনুভব হয়)  তিনি পেট ভরার জন্য নিকৃষ্ট মানের খুরমাও পেতেন না।’ (মুসলিম ২৯৭৭,২৯৭৮, তিরমিযী ২৩৭২)

১৯) আয়েশা (রাঃ) বলেন, “রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এই অবস্থায় ইন্তেকাল করলেন যে, তখন একটা প্রানীর খেয়ে বাঁচার মত কিছু খাদ্য আমার ছিল না। তবে আমার তাকের মধ্যে যৎসামান্য যব ছিল। এ থেকে বেশ কিছুদিন আমি খেলাম। কিন্ত যখন একদিন মেপে নিলাম, সেদিনই তা শেষ হয়ে গেল।” (সহীহুল বুখারী ৩০৯৭, তিরমিযী ২৪৬৭)

২০) উম্মুল মু’মিনীন জুয়াইরিয়্যাহ বিন্তে হারেসের ভাই আমর ইবনে হারেস (রাঃ) বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাঁর মূত্যুর সময় কোন দীনার, দিরহাম, ক্রেতদাসী এবং কোন জিনিসই ছেড়ে যাননি। তবে তিনি ঐ সাদা খচ্চরটি ছেড়ে গেছেন, যার উপর তিনি সওয়ার হতেন এবং তাঁর হাতিয়ার ও কিছু জমি; যা তিনি মুসাফিরদের জন্য সাদকাহ করে গেছেন।’ (সহীহুল বুখারী ৪৪৬১,২৭৩৯,২৮৭৩)

২১) খাব্বার ইবনে আরাও (রাঃ) বলেন, ‘আমরা আল্লাহর চেহেরা (সন্তোষটি) লাভের উদ্দেশ্যে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সঙ্গে (মদীনা) হিজরত করলাম। যার সওয়াব আল্লাহর নিকট আমাদের প্রাপ্য। এরপর আমাদের কেউ এ সওয়াব দুনিয়াতে ভোগ করার পূর্বেই বিদায় নিলেন। এর মধ্যে মুসআব ইবনে উমাইর (রাঃ) তিনি উহুদ যুদ্ধে শহীদ হলেন এবং শুধুমাএ একখানা পশমের রঙিন চাদর রেখে গেলেন। আমরা (কাফনের জন্য) তা দিয়ে তাঁর মাথা ঢাকলে তাঁর পা বেরিয়ে গেল। আর পা ঢাকলে তাঁর মাথা বেরিয়ে গেল। তাই রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আমাদেরকে নির্দেশ দিলেন যে, “তা দিয়ে তাঁর মাথা ঢেকে দাও এবং পায়ের উপর ‘ইযখির’ ঘাস বিছিয়ে দাও।” আর আমাদের মধ্যে এমনও লোক রয়েছেন, যাঁদের ফল পেকে গেছে। আর তাঁরা তা সংগ্রহ করছেন।’ (সহীহুল বুখারী ১২৭৬, ৩৮৯৭,৩৯১৪,৪০৪৭)

২২) সাহল ইবনে সা’দ (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “যদি আল্লাহর নিকট মাছির ডানার সমান দুনিয়া (মূল্য বা ওজন) থাকত, তাহলে তিনি কোন কাফেরকে তাঁর (দুনিয়ার) এক ঢোক পানিও পান করাতেন না।” (তিরমিযী ২৩২০, ইবনে মাজাহ ৪১১০)

২৩) আবূ হুরাইরা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) –কে বলতে শুনেছি, “শোনো ! নিঃসন্দেহে দুনিয়া অভিশপ্ত। অভিশপ্ত তাঁর মধ্যে যা কিছু আছে (সবই)  তবে আল্লাহর যিকর এবং তাঁর সাথে সম্পৃক্ত জিনিস, আলেম ও তালেবে-ইলম নয়।” (তিরমিযী ২৩২২, ইবনে মাজাহ ৪১১২)

২৪) আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “তোমরা জমি-জায়গা, বারি-বাগান ও শিল্প-ব্যবসায়ে বিভোর হয়ে পড়ো না। কেননা, (তাহলে) তোমরা দুনিয়ার প্রতি আসক্ত হয়ে পড়বে।” (তিরমিযী ২৩২৮, আহমাদ ৩৫৬৯,৪০৩৮,৪২২২)

২৫) আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) একদিন আমাদের পাশ দিয়ে অতিক্রম করলেন। এমন অবস্থায় যে, আমরা আমাদের একটি কুঁড়েঘর সংস্কার করছিলাম। তিনি বললেন, “এটা কী?” আমরা বললাম, ‘কুঁড়ে ঘরটি দুর্বল হয়ে ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম হয়েছিল, তাই আমরা তা মেরামত করছি।’ তিনি বললেন, “আমি ব্যাপারটিকে (মৃত্যুকে) এর চাইতেও নিকটবর্তী ভাবছি।” (তিরমিযী ২৩৩৫, আহমাদ ৬৪৬৬)

২৬) কা’ব ইবনে ইয়ায (রাঃ) বলেন, আমি আল্লাহর রসূল (সাঃ)-কে বলতে শুনেছি; “প্রত্যেক উম্মাতের জন্য ফিতনা রয়েছে এবং আমরা উম্মাতের ফিতনা হচ্ছে মাল।” (তিরমিযী ২৩৩৬, আহমাদ ১৭০৭)

২৭) আব্দুল্লাহ ইবনে শিখখীর (রাঃ) বলেন, আমি নবী (সাঃ) –এর নিকট এলাম, এমন অবস্থায় যে, তিনি ‘আলহাকুমুত তাকাসুর’ অর্থাৎ, প্রাচুর্য্যের প্রতিযোগিতা তোমাদেরকে মোহাচ্ছন্ন করে রেখেছে। (সূরা তাকাসুর) পড়ছিলেন।

তিনি বললেন, “আদম সন্তান বলে, ‘আমার মাল, আমার মাল।’ অথচ হে আদম সন্তান! তোমার কি এ ছাড়া কোন মাল আছে, যা তুম খেয়ে শেষ করে দিয়েছ অথচ যা তুমি পরিধান করে পুরাতন করে দিয়েছ অথবা সাদকাহ করে (পরকালের জন্য) জমা রেখেছ।” (মুসলিম ২৯৫৮)

২৮) আব্দুল্লাহ ইবনে মুগাফফাল থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদিন একটি লোক নবী (সাঃ) –কে বলল, ‘হে আল্লাহর রসূল! আল্লাহর কসম! আমি নিঃসন্দেহে আপনাকে ভালবাসি।’ তিনি বললেন, “তুমি যা বলছ, তা চিন্তা করে বল।” সে বলল, ‘আল্লাহর কসম! আমি নিঃসন্দেহে আপনাকে ভালবাসি।’ এরূপ সে তিনবার বলল। তিনি বললেন, “যদি তুমি আমাকে ভালবাসো, তাহলে দারিদ্রের জন্য বর্ম প্রস্তুত রাখো। কেননা, যে আমাকে ভালবাসবে স্রোত তার শেষ প্রান্তের দিকে যাওয়ার চাইতেও বেশি দ্রতগতিতে দারিদ্র তার নিকট আগমন করবে।” (তিরমিযী ২৩৫০)

২৯) কা’ব ইবনে মালেক (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “ছাগলের পালে দুটি ক্ষুধার্ত নেকড়ে বাঘকে ছেড়ে দিলে ছাগলের যতটা ক্ষতি করে, তার চেয়ে মানুষের সম্পদ ও সম্মানের প্রতি লভ-লালসা তার দ্বীনের বেশী ক্ষতিকারক।” (তিরমিযী ২৩৭৬, আহমাদ ১৫৩৫৭, ১৫৩৬৭)

৩০) আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) একদিন চাটাই –এর উপর শুলেন। তারপর তিনি এই অবস্থায় উঠলেন যে, তাঁর পার্শ্বদেশে দাগ পড়ে গিয়েছিল। আমরা বললাম, ‘হে আল্লাহর রসূল! যদি (আপনার অনুমতি হয়, তাহলে) আমরা আপনার জন্য নরম গদি বানিয়ে দিই।’ তিনি বললেন, “দুনিয়ার সাথে আমার কি সম্পর্ক? আমি তো এ জগতে ঐ সওয়ারের মত যে ক্লান্ত হয়ে একটু বিশ্রামের জন্য গাছের ছায়ায় থামল। পুনরায় সে চলতে আরম্ভ করল এবং ঐ গাছটি ছেড়ে দিল।” (তিরমিযী ২৩৭৭, ইবনু মাজাহ ৪১১৬৯)

৩১) আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “গরীব মুমিনরা ধনীদের পাঁচশত বছর পূর্বে জান্নাতে প্রবেশ করবে।” (তিরমিযী ২৩৫৩,২৩৫৪, ইবনু মাজাহ ৪১২২)

৩২) ইবনে আব্বাস (রাঃ) ও ইমরান ইবনে হুসাইন(রাঃ) থেকে বর্ণিত, নবী (সাঃ) বলেছেন, “আমি বেহেশ্তের মধ্যে তাকিয়ে দেখলাম, তার অধিকাংশই গরীব লোক। আর দোযখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, তার অধিকাংশ অধিবাসীরাই মহিলা।” (সহীহুল বুখারী ৩২৪১,৫১৯৮,৬৪৪৯,৬৫৪৬, মুসলিম ২৭৩৮)

ইমাম বুখারী উক্ত হাদিসকে ইমরান ইবনে হুসাইন (রাঃ) থেকেও বর্ণনা করেছেন।

৩৩) উসামাহ ইবনে যায়েদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, নবী (সাঃ) বলেন, “আমি জান্নাতের দুয়ারে দাঁড়িয়ে দেখতে পেলাম, সেখানে অধিকাংশ নিঃস্ব লোক রয়েছে। আর ধনবানরা তখনো (হিসাবের জন্য) অবরুদ্ধ রয়েছে। অথচ দোযখীদেরকে দোযখের দিকে হাঁকিয়ে নিয়ে যাওয়ার আদেশ দেওয়া হয়ে গেছে।” (সহীহুল বুখারী ৫১৯৬, ৬৫৪৭, মুসলিম ২৭৩৬)

৩৪) আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, নবী (সাঃ) বলেছেন, “সবচেয়ে সত্য কথা কোন কবি বলেছেন, তা হল লাবীদ (কবীর) কথা, (তিনি বলেছেন,) ‘শোনো, আল্লাহ ছাড়া সব কিছুই বাতিল।” (সহীহুল বুখারী  ৩৮৪১, ৬১৪৭,৬৪৮৯ মুসলিম ২২৫৬)

 


শয়তানের ছয়টি অনিষ্ট- দশটি প্রতিকার

$
0
0

 শয়তান ছয় ভাবে আমাদের অনিষ্ট করার চেষ্টা করে; এই চেষ্টায় সে ততক্ষণ পর্যন্ত লেগে থাকে যতক্ষণ পর্যন্ত না মানুষকে এর মধ্যের কোন একটি বা একের অধিক ক্ষতিতে ফেলতে পারেঃ

 

১) শিরক এবং অবিশ্বাস বা কুফরের মধ্যে ফেলা;

২) তারপর বিদাআতে জড়িয়ে ফেলা;

৩) অতঃপর বড় গুনাহে প্রলুব্ধ করা;

৪)  তারপর ছোট গুনাহে লিপ্ত করানো;

৫) এরপর নেক আমলের পরিবর্তে ‘মুবাহ’ আমলে ব্যস্ত রাখা; (যে কাজে গুনাহ বা সওয়াব কোনটিই হয় না এমন কাজকে মুবাহ বলে, যেমন খাওয়া, ঘুম ইত্যাদি);

উপরের কোন উপায়েই যদি অনিষ্ট না করতে পারে তাহলে

৬)  অবশেষে অধিক সওয়াবের আমলের পরিবর্তে তুলামূলক কম সওয়াবের আমলে ব্যস্ত রাখা।

 শয়তান থেকে আত্মরক্ষার দশটি উপায়ঃ

১)  আল্লাহর কাছে শয়তানের অনিষ্ট থেকে আশ্রয় চাওয়া;

২) সুরা ফালাক ও সুরা নাস তেলাওয়াত করা;

৩)  আয়াতুল কুরসি তেলাওয়াত করা;

৪)  সুরা বাকারা তেলাওয়াত করা;

৫)  সুরা বাকারার শেষ দুই আয়াত তেলাওয়াত করা;

৬)  সুরা গাফির এর প্রথম তিন আয়াত তেলাওয়াত করা;

৭)  “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু, ওয়াহদাহু, লা শারীকা লাহু, লাহুল মুলকু ওয়া লাহুল হামদু ওয়া হুয়া ‘আলা কুল্লি শাইইন কাদীর” একশত বার পড়া যার অর্থ - আল্লাহ ছাড়া ইবাদতের যোগ্য কোন মাবুদ নেই, তিনি এক তাঁর কোন শরীক নেই, রাজত্ব তারই, প্রশংসা মাত্রই তাঁর, তিনি সকল কিছুর উপর ক্ষমতাবান।

৮)  অধিক হারে আল্লাহর জিকির করা;

৯)  ভালভাবে ওজু করা এবং সালাত আদায় করা;

১০)  অনর্থক এদিক সেদিক খেয়াল করা, অসার কথা বলা, অতিরিক্ত খাওয়া ও অহেতুক লোকজনের সাথে মেলামেশা থেকে নিজেকে বিরত রাখা।

 

সূত্রঃ ইবনুল কায়্যিম এর লেখা বাদা-ই আল ফাওয়া-ইদ তারীক আল ওয়াসুল ইলা আল ইলম আল মাউল(পৃষ্ঠা ১২৯) থেকে শায়খ আব্দুর রাহমান ইবনে নাসির আস সাদী এর সংকলন কৃত

এক বাস ড্রাইভার

$
0
0
বাংলা অনুবাদঃ জহিরুল কাইয়ুম ।  ওয়েব সম্পাদনাঃ মোঃ মাহমুদ -ই- গাফফার | English Version

চমৎকার একটি দিন। ড্রাইভার স্টেশন থেকে যাত্রা শুরু করে রাস্তা ধরে চলেছেন গন্তব্যের পানে। প্রথম কয়েকটি স্টপেজ ভালমতই পার হয়ে গেল। কেউ নামলো কেউ আবার উঠল। সবকিছুই ঠিকঠাক যাচ্ছিল।

 

তারপর হল কি! পরবর্তী স্টপেজে ছয় ফুট আট ইঞ্চি লম্বা, সুঠাম দেহী এক কুস্তিগীর উঠল গাড়ীতে। গাড়ীতে উঠে ড্রাইভারের দিয়ে কড়া নজরে তাকিয়ে বলল,  পালোয়ান কখনো ভাড়া দেয় না তারপর গিয়ে বসল গাড়ির পেছনের এক সিটে।

 

এ ফাঁকে বাস ড্রাইভারের দৈহিক বর্ণনাটাও দিয়ে রাখি। ড্রাইভার প্রায় পাঁচ ফুট তিন ইঞ্চি লম্বা,হালকা পাতলা গড়ন, আচার আচরণে মোটামুটি নম্র টাইপের। পালোয়ানের আচরণ ড্রাইভারের ভাল না লাগলেও পালোয়ানের সাথে ড্রাইভার কোন তর্ক-বিতর্কে জড়াতে যায়নি।

 

পরের দিনও ঐ একই ঘটনা-সেই পালোয়ান আবার গাড়িতে উঠল এবং গতদিনের মত ভাড়া দিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে সিটে বসে পড়ল। পরের দিনও ঐ একই কাহিনী। তারপরের দিনও তাই।

 

পালোয়ান বাসভাড়া না দিয়ে প্রতিদিন সুবিধা নিচ্ছে। বিষয়টি রীতিমত বাস ড্রাইভারের মাথাব্যাথার কারণ হয়ে উঠল। এমনকি তার ঘুম হারাম হওয়ার জোগাড়। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে ড্রাইভার এবার অন্য পন্থা অবলম্বনের মনস্থির করল। সিদ্ধান্ত নিল পালোয়ানকে সায়েস্তা করার জন্যে বডি বিল্ডিং করবে। কারাতে,জুডো যা আছে  প্রয়োজনে সব শিখবে। পরিকল্পনা মাফিক এক প্রশিক্ষন কেন্দ্রে ভর্তিও হল।

 

সময়টা গ্রীষ্মের শেষের দিক। প্রশিক্ষন নিয়ে ড্রাইভার নিজেই এবার পালোয়ান হয়ে উঠেছে। নিজের শক্তি-সামর্থ্যের ব্যাপারে সে এখন সন্তুষ্ট।

 

পরের এক সোমবার পালোয়ান বাসে উঠে পূর্বের ভঙ্গিমায় বলল, পালোয়ান কখনো ভাড়া দেয় না  আর অমনি ড্রাইভার লাফিয়ে উঠে গলা ফাটিয়ে বলে উঠল, কেন ভাড়া দিস না???!!!

 

হতভম্ব হয়ে পালোয়ান এবার জবাব দিল, আমার বিনামুল্যে বাস ভ্রমনের পাস আছে।

 

গল্পের নৈতিক শিক্ষা

গল্পের নৈতিক শিক্ষা একেবারে পরিষ্কার যা আমাদের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে এবং দৈনন্দিন চলাফেরায় অবহেলা করে আমরা এড়িয়ে যাই।

 

ঘটনা থেকে জানা গেল যে পুরো ঘটনা না জেনে হঠকারীতার পরিচয় দিয়ে কোন বিষয়ে উপসংহারে পৌঁছা মোটেই বুদ্ধিমানের কাজ নয়।

 

একজন মুসলিম তার অপর মুসলিম ভাই সম্পর্কে উত্তম ধারণা পোষণ করবে এবং তাকে  সন্দেহের সুবিধা দেবে (কোন কারণে সন্দেহ করতে হলে তাকে ভাল জেনে পরবর্তী অনুসন্ধানে অগ্রসর হবে)। সম্ভব হলে তাকে তার অবস্থান বা পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করার সুযোগ দেবে যেন সন্দেহের কোন কারণ থাকলে তা পরিষ্কার হয়ে যায়।

 

“অনুমান করা থেকে বেঁচে থাকো। কারণ অনুমান হলো সবচেয়ে বড় মিথ্যা। আর বেঁচে থাকো অন্যের দোষ খোঁজা থেকে, এবং অন্যের উপর গোয়েন্দাগিরি করা থেকে, বেঁচে থাকো (মন্দ কাজে) প্রতিযোগিতা করা থেকে, বেঁচে থাক অপরের হিংসা করা থেকে, অপরকে ঘৃণা করা থেকে এবং একে অপরকে পরিহার করা থেকে; এমনভাবে থাকো যেন তোমরা পরস্পর ভাই এবং আল্লাহ্‌র দাস”।  [আল-বুখারী; খণ্ড ৮, অধ্যায় ৭৩, হাদীস নং ৯২]

অন্যের কথাকে সর্বোত্তম উপায়ে ব্যাখ্যা করাটা হলো মু’মিনদের অন্যতম গুণ। ‘উমার (রা) বলেন,

“তোমার বিশ্বাসী ভাইয়ের কোনো কথাকে খারাপ অর্থে গ্রহণ করো না, যতক্ষণ পর্যন্ত তা ভালো অর্থে নেওয়ার সুযোগ থাকে।”

 

একইভাবে ইসলামিক বিশেষজ্ঞগণের মত হল, যদি কাউকে সন্দেহ করার কোন কারণ থাকেও, তবুও মানুষের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় সন্দেহকে প্রশ্রয় দেয়া উচিত নয়।

 

পরিশেষে,কোন ব্যক্তিকে মূল্যায়ন করার সময় উক্ত ব্যক্তির চারিত্রিক সকল দিক বিবেচনা করা এবং হঠকারীতা পরিহার করা উচিৎ। কারো উপর মিথ্যারোপ করা থেকে বেঁচে থাকার জন্য তার ব্যাপারে পুরো বিষয়টা পরিষ্কারভাবে জেনে নেয়া উচিত।

মুসলমানদের ১৫ টি প্রশংসনীয় চারিত্রিক গুণাবলী

$
0
0
লেখক : আদেল বিন আলী আশ-শিদ্দী / আহমদ আল-মাযইয়াদ     

অনুবাদ : সাইফুল্লাহ আহমাদ  | ওয়েব সম্পাদনাঃ মোঃ মাহমুদ -ই- গাফফার

ইসলামী শরীয়ত হচ্ছে একটি পরিপূর্ণ জীবন পদ্ধতি যা সকল দিক থেকে সার্বিকভাবে মুসলমানের ব্যক্তিগত জীবনকে গঠন করার ব্যাপারে অত্যন্ত গুরুত্বারোপ করেছে এসব দিকের মধ্যে গুনাবলি শিষ্টাচার ও চরিত্রের দিকটি অন্যতম। ইসলাম এদিকে অত্যন্ত গুরুত্বারোপ করেছে। তাইতো আকীদা ও আখলাকের মাঝে সম্পর্ক স্থাপন করে দিয়েছে, যেমন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন,

“মুমিনদের মধ্যে পরিপূর্ণ ঈমানদার হচ্ছে সে ব্যক্তি, যে তাদের মধ্যে সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী।” [আহমাদ, আবু দাউদ, তিরমিযি ]

 

সুতরাং উত্তম চরিত্র হচ্ছে ঈমানের প্রমাণবাহী ও প্রতিফলন। চরিত্র ব্যতীত ঈমান প্রতিফলিত হয় না বরং নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সংবাদ দিয়েছেন যে, তাঁকে প্রেরণের অন্যতম মহান উদ্দেশ্য হচ্ছে চরিত্রের উত্তম দিকসমূহ পরিপূর্ণ করে দেয়া। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন,

 আমি তো কেবল চরিত্রের উত্তম দিকসমূহ পরিপূর্ণ করে দিতে প্রেরিত হয়েছি।  ইমাম আহমাদ ও ইমাম বুখারী আদাবুল মুফরাদে বর্ণনা করেছেন।

 

এ কারণেই আল্লাহ তাআলা উত্তম ও সুন্দরতম চরিত্রের মাধ্যমে তাঁর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর প্রশংসা করেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন,

 “নিশ্চয়ই আপনি মহান চরিত্রে অধিষ্ঠিত।” [সূরা আল, কালাম : ৪]

 

কোথায় এ চরিত্র বর্তমান বস্তুবাদী মতবাদ ও মানবতাবাদী মানুষের মনগড়া চিন্তা চেতনায় ?
যেখানে চরিত্রের দিককে সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করা হয়েছে, তা শুধু সুবিদাবাদী নীতিমালা ও বস্তুবাদী স্বার্থের উপর প্রতিষ্ঠিত। যদিও তা অন্যদের উপর জুলুম বা নির্যাতনের মাধ্যমে হয়। অন্য সব জাতির সম্পদ লুন্ঠন ও মানুষের সম্মান হানীর মাধ্যমে অর্জিত হয়।

 

একজন মুসলমানের উপর তার আচার-আচরণে আল্লাহর সাথে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাথে, অন্য মানুষের সাথে, এমনকি নিজের সাথে কি ধরনের আচরণ করা উচিত ইসলাম তার এক অভিনব চকমপ্রদ চিত্র অংকন করে দিয়েছে। যখনই একজন মুসলমান বাস্তবে ও তার লেনদেনে ইসলামী চরিত্রের অনুসরণ করে তখনই সে অভিষ্ট পরিপূর্ণতার অতি নিকটে পৌঁছে যায়, যা তাকে আরো বেশি আল্লাহর নৈকট্য লাভ ও উচ্চ মর্যাদার সোপানে উন্নীত হতে সহযোগিতা করে। পক্ষান্তরে, যখনই একজন মুসলমান ইসলামের চরিত্র ও শিষ্টাচার হতে দূরে সরে যায় সে বাস্তবে ইসলামের প্রকৃত প্রাণ চাঞ্চল্য, নিয়ম-নীতির ভিত্তি হতে দূরে সরে যায়। সে যান্ত্রিক মানুষের মত হয়ে যায়, যার কোন অনুভূতি এবং আত্মা নেই।

 

ইসলামে ইবাদতসমূহ চরিত্রের সাথে কঠোরভাবে সংযুক্ত। যে কোন ইবাদত একটি উত্তম চরিত্রের প্রতিফলন ঘটায় না তার কোন মূল্য নেই। আল্লাহর সামনে নামায আদায়ের ক্ষেত্রে দেখা যায় নামায একজন মানুষকে অশ্লীল অপছন্দ কাজসমূহ হতে রক্ষা করে, আত্মশুদ্ধি ও আত্মার উন্নতি সাধনে এর প্রভাব রয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন,

 “নিশ্চয়ই নামায অশ্লীল, অপছন্দনীয় কাজ হতে নিষেধ করে।” [ সূরা আল-আনকাবুত :৪৫ ]

 

অনুরূপভাবে রোযা তাক্কওয়ার দিকে নিয়ে যায়। আর তাক্বওয়া হচ্ছে মহান চরিত্রের অন্যতম, যেমন- আল্লাহ তাআলা বলেন,

হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর রোযা ফরয করা হয়েছে যেমনি ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর যাতে তোমরা তাক্বওয়া লাভ করতে পার। [ সূরা আল বাকারা : ১৮৩ ]

 

  • রোযাঃ  অনুরূপভাবে শিষ্টাচার, ধীরস্থিরতা, প্রশান্তি, ক্ষমা, মুর্খদের থেকে বিমুখতা ইত্যাদির প্রতিফলন ঘটায়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন, “তোমাদের কারো রোযার দিন যদি হয়, তাহলে সে যেন অশ্লীল কথাবার্তা না বলে, হৈ চৈ না করে অস্থিরতা না দেখায়। যদি কেউ তাকে গালি দেয় অথবা তার সাথে লড়াই করে সে যেন বলে দেয় আমি রোযাদার। বুখারী ও মুসলিম

 

  • যাকাতঃ  অনুরূপভাবে অন্তরকে পবিত্র করে, আত্মাকে পরিমার্জিত করে এবং তাকে কৃপণতা, লোভ ও অহংকারের ব্যধি হতে মুক্ত করে। আল্লাহ তাআলা বলেন,“তাদের সম্পদ হতে আপনি সাদকাহ গ্রহণ করুন যার মাধ্যমে আপনি তাদেরকে পবিত্র ও পরিমার্জিত করবেন।” [সূরা তাওবাহ ১০৩ আয়াত ]

 

  • হজ্জঃ আর হজ্জ হচ্ছে একটি বাস্তবমুখী প্রশিক্ষণশালা আত্মশুদ্ধি এবং হিংসা বিদ্ধেষ ও পঙ্কিলতা থেকে আত্মাকে পরিশুদ্ধি ও পরিমার্জনের জন্য। আল্লাহ তাআলা বলেন, “যে এ মাস গুলোতে নিজের উপর হজ্জ ফরয করে নিল সে যেন অশ্লীলতা, পাপাচার ও ঝগড়া বিবাদ হজ্জের মধ্যে না করে।” [সূরা আল বাকারাহ : ১৯৭ ]

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন,

“যে ব্যক্তি অশ্লীল কথা-বার্তা ও পাপ কর্ম না করে হজ্জ পালন করল, সে তার পাপ রাশি হতে তার মা যেদিন জন্ম দিয়েছে সে দিনের মত নিষ্পাপ হয়ে ফিরে এল।” [বুখারী ও মুসলিম]

 

ইসলামী চরিত্রের মৌলিক বিষয়সমূহ

১ সত্যবাদিতা:

আল্লাহ তাআলা এবং তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের যে সকল ইসলামী চরিত্রের নির্দেশ দিয়েছেন, তার অন্যতম হচ্ছে সত্যবাদিতার চরিত্র। আল্লাহ তাআলা বলেন,

“হে ঈমানদারগণ আল্লাহকে ভয় কর এবং তোমরা সত্যবাদীদের সাথী হও।” সূরা আত-তাওবাহ : ১১৯

 

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন,

“তোমরা সততা অবলম্বন গ্রহণ কর, কেননা সত্যবাদিতা পুণ্যের পথ দেখায় আর পূণ্য জান্নাতের পথ দেখায়, একজন লোক সর্বদা সত্য বলতে থাকে এবং সত্যবাদিতার প্রতি অনুরাগী হয়, ফলে আল্লাহর নিকট সে সত্যবাদী হিসাবে লিপিবদ্ধ হয়ে যায়।” মুসলিম

 

২ আমানতদারিতা :

মুসলমানদের সে সব ইসলামী চরিত্র অবলম্বনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে তার একটি হচ্ছে আমানতসমূহ তার অধিকারীদের নিকট আদায় করে দেয়া। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

“নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের নির্দেশ দিচ্ছেন আমানতসমূহ তার হকদারদের নিকট আদায় করে দিতে।” সূরা আন নিসা : ৫৮

 

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর সম্প্রদায়ের নিকট আল আমীন উপাধি লাভ করেছিলেন, তারা তাঁর নিকট তাদের সম্পদ আমানত রাখত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং তার অনুসারীদের মুশরিকরা কঠোর ভাবে নির্যাতন শুরু করার পর যখন আল্লাহ তাকে মক্কা হতে মদীনা হিজরত করার অনুমতি দিলেন তিনি আমানতের মালসমূহ তার অধিকারীদের নিকট ফিরিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা না করে হিজরত করেননি। অথচ যারা আমানত রেখেছিল তারা সকলেই ছিল কাফের। কিন্তু ইসলাম তো আমানত তার অধিকারীদের নিকট ফিরিয়ে দিতে নির্দেশ দিয়েছে যদিও তার অধিকারীরা কাফের হয়।

 

৩ অঙ্গীকার পূর্ণ করা:

ইসলামী মহান চরিত্রের অন্যতম হচ্ছে অঙ্গীকার পূর্ণ করা। আল্লাহ তাআলা বলেন :

“আর অঙ্গীকার পূর্ণ কর, কেননা অঙ্গীকার সম্বন্ধে জিজ্ঞাসিত হবে।” সূরা ইসরা : ৩৪

 

আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রতিশ্রতি ভঙ্গকরা মুনাফিকের বৈশিষ্ট্যের মধ্যে গণ্য করেছেন।

 

৪ বিনয় :

ইসলামী চরিত্রের আরেকটি হচ্ছে একজন মুসলমান তার অপর মুসলিম ভাইদের সাথে বিনয়ী আচরণ করবে। সে ধনী হোক বা গরীব। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

“তুমি তোমার পার্শ্বদেশ মুমিনদের জন্য অবনত করে দাও।” সূরা আল হিজর : ৮৮

 

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন,

“আল্লাহ তাআলা আমার নিকট ওহী করেছেন যে, ‘তোমরা বিনয়ী হও যাতে একজন অপরজনের উপর অহংকার না করে। একজন অপর জনের উপর সীমালংঘন না করে।” -মুসলিম।

 

৫ মাতা-পিতার প্রতি সদ্ব্যবহার:

মাতা-পিতার প্রতি সদ্ব্যবহার উত্তম চরিত্রের অন্যতম। আর এটা তাদের অধিকার মহান হওয়ার কারণে, যে অধিকার স্থান হল আল্লাহর হকের পরে।আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

‘আর আল্লাহর ইবাদত কর, তাঁর সাথে কোন কিছুকে শরীক করো না, এবং মাতা-পিতার প্রতি সদ্ব্যবহার কর।” [সূরা আন-নিসা : ৩৫ আয়াত]

 

আল্লাহ তাআলা তাদের আনুগত্য, তাদের প্রতি দয়া ও বিনয় এবং তাদের জন্য দু’আ করতে নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন :

“তাদের উভয়ের জন্য দয়ার সাথে বিনয়ের ডানা নত করে দাও এবং বল, হে আমার রব! তাদের প্রতি দয়া কর যেভাবে শৈশবে আমাকে তারা লালন-পালন করেছেন।” [ সূরা আল ইসরা : ২৪ ]

 

এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নিকট এসে জিজ্ঞেস করল,

‘হে আল্লাহর রাসূল! আমার উত্তম আচরণ পাওয়ার সবচেয়ে বেশী অধিকারী ব্যক্তি কে ? তিনি বললেন, ‘তোমার মা।’ অত:পর জিজ্ঞেস করল তারপর কে? তিনি উত্তর দিলেন, ‘তোমার মা।’ অতঃপর জিজ্ঞেস করল তার পর কে? তিনি উত্তর দিলেন, ‘তোমার মা।’ অতঃপর জিজ্ঞেস করল তার পর কে? উত্তর দিলেন, ‘তোমার পিতা।’ [বুখারী ও মুসলিম]

 

মাতা-পিতার প্রতি এ সদ্ব্যবহার ও দয়া অনুগ্রহ অতিরিক্ত বা পূর্ণতা দানকারী বিষয় নয় বরং তা হচ্ছে সকল মানুষের ঐক্যমতের ভিত্তিতে ফরযে আইন।

 

৬ আত্মীয়তার সর্ম্পক বজায় রাখা :

আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখা ইসলামী চরিত্রের অন্যতম। আর তারা হচ্ছে নিকটাত্মীয়গণ যেমন, চাচা, মামা, ফুফা, খালা, ভাই, বোন প্রমূখ।

আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখা ওয়াজিব, আর তা ছিন্ন করা জান্নাত হতে বঞ্চিত ও অভিশাপের কারণ। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

“ যদি তোমরা ক্ষমতা পাও, তাহলে কি তোমরা পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করবে এবং আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করবে? তারা তো ঐ সব লোক যাদের প্রতি আল্লাহ অভিশাপ করেছেন। এতে তিনি তাদেরকে বধির করে দিয়েছেন এবং তাদের দৃষ্টি অন্ধ করে দিয়েছেন।” [সূরা মুহাম্মাদ : ২২-২৩]

 

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন,

“আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্নকারী বেহেশ্তে প্রবেশ করবে না।” [বুখারী ও মুসলিম]

 

৭ প্রতিবেশীর প্রতি সুন্দরতম ব্যবহার:

প্রতিবেশীর প্রতি সুন্দরতম ব্যবহার হচ্ছে ইসলামী চরিত্রের অন্যতম। প্রতিবেশী হচ্ছে সে সব লোক যারা আপনার বাড়ীর আশে পাশে বসবাস করে। যে আপনার সবচেয়ে নিকটবর্তী সে সুন্দর ব্যবহার ও অনুগ্রহের সবচেয়ে বেশী হকদার। আল্লাহ তাআলা বলেন,

“আর মাতা-পিতার প্রতি সদ্ব্যবহার কর, নিকটাত্মীয়, এতিম, মিসকীন নিকটতম প্রতিবেশী ও দূরবর্তী প্রতিবেশীর প্রতিও।” [সূরা আন-নিসা : ৩৬]

 

এতে আল্লাহ নিকটতম ও দূরবর্তী প্রতিবেশীর প্রতি সদ্ব্যবহার করতে ওসিয়ত করেছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেনঃ

‘জিবরীল আমাকে প্রতিবেশীর ব্যাপারে ওসিয়ত করতেছিল এমনকি আমি ধারণা করেনিলাম যে, প্রতিবেশীকে উত্তরাধিকার বানিয়ে দেয়া হবে।’ [বুখারী ও মুসলিম]

 

অর্থাৎ আমি মনে করেছিলাম যে ওয়ারিশদের সাথে প্রতিবেশীর জন্য মিরাসের একটি অংশ নির্ধারিত করে দেবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আবু যর রা. কে লক্ষ্য করে বলেন,

‘হে আবু যর! যখন তুমি তরকারী পাক কর তখন পানি বেশি করে দাও, আর তোমার প্রতিবেশীদের অঙ্গীকার পূরণ কর।” [ মুসলিম]

 

প্রতিবেশীর পার্শ্বাবস্থানের হক রয়েছে যদিও সে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের প্রতি অবিশ্বাসী বা কাফের হয়।

 

৮ মেহমানের আতিথেয়তা:

ইসলামী চরিত্রের আরেকটি হচ্ছে মেহমানের আতিথেয়তা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বাণী,

“যে ব্যক্তি আল্লাহ এবং পরকালের প্রতি বিশ্বাস করে সে যেন তার মেহমানকে সম্মান করে।” [বুখারী ও মুসলিম]

 

৯ সাধারণভাবে দান ও বদান্যতা:

ইসলামী চরিত্রের অন্যতম দিক হচ্ছে দান ও বদান্যতা। আল্লাহ তাআলা ইনসাফ, বদান্যতা ও দান কারীদের প্রশংসা করেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

“যারা আল্লাহর রাস্তায় নিজেদের সম্পদ ব্যয় করে অতঃপর যা খরচ করেছে তা থেকে কারো প্রতি অনুগ্রহ ও কষ্ট দেয়ার উদ্দেশ্য করে না, তাদের জন্য তাদের প্রতিপালকের নিকট প্রতিদান রয়েছে। তাদের কোন ভয় নেই এবং তারা দুশ্চিন্তাও করবে না।”   [সূরা আল বাকারাহ : ২৬২]

 

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন,

‘যার নিকট অতিরিক্ত বাহন থাকে সে যেন যার বাহন নেই তাকে তা ব্যবহার করতে দেয়। যার নিকট অতিরিক্ত পাথেয় বা রসদ রয়েছে সে যেন যার রসদ নেই তাকে তা দিয়ে সাহায্য করে।”  [মুসলিম]

 

১০ ধৈর্য্য ও সহিষ্ণুতা:

ধৈর্য্য ও সহিষ্ণুতা হচ্ছে ইসলামী চরিত্রের অন্যতম বিষয়। অনুরূপভাবে মানুষদের ক্ষমা করা, দুর্ব্যবহারকারীকে ছেড়ে দেয়া ওজর পেশকারীর ওজর গ্রহণ করা বা মেনে নেয়াও অন্যতম। আল্লাহ তাআলা বলেন :

“আর যে ধৈর্য্য ধারণ করল এবং ক্ষমা করল, নিশ্চয়ই এটা কাজের দৃঢ়তার অন্তর্ভূক্ত।”   [সূরা আশ শুরা : ৪৩]

 

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

‘তারা যেন ক্ষমা করে দেয় এবং উদারতা দেখায়, আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করে দেয়া কি তোমরা পছন্দ কর না?’ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “দান খয়রাতে সম্পদ কমে যায় না। আল্লাহ পাক ক্ষমার দ্বারা বান্দার মার্যাদাই বৃদ্ধি করে দেন। যে আল্লাহর জন্য বিনয় প্রকাশ করে আল্লাহ তার সম্মানই বৃদ্ধি করে দেন।” [মুসলিম ] তিনি আরো বলেন, “দয়া কর, তোমাদের প্রতি দয়া করা হবে। ক্ষমা করে দাও তোমাদেরও ক্ষমা করে দেয়া হবে।”   [আহমাদ]

 

 

১। ১  মানুষের মাঝে সমঝোতা ও সংশোধন:

ইসলামী চরিত্রের আরেকটি হচ্ছে মানুষের মাঝে সমঝোতা ও সংশোধন করে দেয়া, এটা একটি মহান চরিত্র যা ভালবাসা সৌহার্দ প্রসার ও মানুষের পারষ্পারিক সহযোগিতার প্রাণের দিকে নিয়ে যায়।আল্লাহ তাআলা বলেন:

“তাদের অধিকাংশ শলাপরামর্শের মধ্যে কল্যাণ নেই। কেবল মাত্র সে ব্যক্তি ব্যতীত যে সাদকাহ, সৎকর্ম ও মানুষের মাঝে সংশোধনের ব্যাপারে নির্দেশ দেয়। যে আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষ্যে এসব করে অচিরেই আমরা তাকে মহা প্রতিদান প্রদান করব।” [সূরা আন নিসা : ১১৪]

 

১।২  লজ্জা:

ইসলামী চরিত্রের অন্যতম আরেকটি চরিত্র হচ্ছে লজ্জা। এটা এমন একটি চরিত্র যা পরিপূর্ণতা ও মর্যাদাপূর্ণ বৈশিষ্ট্যের দিকে আহবান করে। অশ্লীলতা ও বেহায়াপনা হতে বারণ করে। লজ্জা আল্লাহর পক্ষ হতে হয়ে থাকে। ফলে মুসলমান লজ্জা করে যে, আল্লাহ তাকে পাপাচারে লিপ্ত দেখবে। অনুরূপভাবে মানুষের থেকে এবং নিজের থেকেও সে লজ্জা করে। লজ্জা অন্তরে ঈমান থাকার প্রমাণ বহন করে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন,

‘লজ্জা ঈমানের বিশেষ অংশ।’ [বুখারী ও মুসলিম]

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বলেন, “লজ্জা কল্যাণ ছাড়া আর কিছুই নিয়ে আসে না।” [বুখারী ও মুসলিম]

 

১।৩  দয়া ও করুণা:

ইসলামী চরিত্রের আরেকটি উল্লেখযোগ্য চরিত্র হচ্ছে দয়া বা করুণা। এ চরিত্রটি অনেক মানুষের অন্তর হতে ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে। ফলে তাদের অন্তর পাথরের মত অথবা এর চেয়েও শক্ত হয়ে গেছে। আর প্রকৃত মু’মিন হচ্ছে দয়াময়, পরোপকারী, গভীর অনুভূতি সম্পন্ন উজ্জল অনুগ্রহের অধিকারী। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

“অত:পর সে তাদের অন্তর্ভূক্ত হয় যারা ঈমান এনেছে পরস্পর পরস্পরকে ধৈর্য্য ও করুণার উপদেশ দিয়েছে। তারা হচ্ছে দক্ষিণ পন্থার অনুসারী।”  [সূরা আল-বালাদ : ১৭- ১৮]

 

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন,

“মুমিনদের পারস্পরিক সৌহার্দ্য, করুণা, অনুকম্পার উপমা হচ্ছে একটি শরীরের মত। যখন তার একটি অঙ্গ অসুস্থ হয় গোটা শরীর নিদ্রাহীনতা ও জ্বরে আক্রান্ত হয়।”  [মুসলিম]

 

১।৪  ইনসাফ বা ন্যায়পরায়ণতা:

ন্যায় পরায়ণতা ইসলামী চরিত্রের আরেকটি অংশ। এ চরিত্র আত্মার প্রশান্তি সৃষ্টি করে। সমাজে নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা এবং বিভিন্ন প্রকার অপরাধ বিমোচনের দিকে নিয়ে যায়। আল্লাহ তাআলা বলেন:

“নিশ্চয়ই আল্লাহ ন্যায়পরায়ণতা ইহসান ও নিকটাত্মীয়দের দান করতে নির্দেশ দেন।”   [সূরা আল নাহাল : ৯০]

 

আল্লাহ তাআলা বলেন :

“ইনসাফ কর, এটা তাক্বওয়ার অতীব নিকটবর্তী।”   [সূরা আল মায়িদা : ৮]

 

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন,

“ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তিরা আল্লাহর নিকট নূরের মিম্বরের উপর বসবে। তারা হল সে সব লোক, যারা বিচার ফয়সালার ক্ষেত্রে, পরিবার-পরিজনের ক্ষেত্রে এবং যে দায়িত্বই পেয়েছে তাতে ইনসাফ করে।”

 

১।৫  চারিত্রিক পবিত্রতা:

ইসলামী চরিত্রের অন্যতম বিষয় হচ্ছে চারিত্রিক পবিত্রতা। এ চরিত্র মানুষের সম্মান সংরক্ষণ এবং বংশে সংমিশ্রন না হওয়ার দিকে পৌঁছে দেয়। আল্লাহ তাআলা বলেন :

“যাদের বিবাহের সামর্থ নেই, তারা যেন চারিত্রিক পবিত্রতা গ্রহণ করে। যতক্ষণ না আল্লাহ তার অনুগ্রহে তাকে সম্পদশালী করেন।” [ সুরা আন নূর-৩৩ ]

 

রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এরশাদ করেছেন,

“তোমরা আমার জন্য ছয়টি বিষয়ের জিম্মাদার হও। তাহলে আমি তোমাদের জন্য জান্নাতের জিম্মাদার হব। যখন তোমাদের কেউ কথা বলে সে যেন মিথ্যা না বলে। যখন তার কাছে আমানত রাখা হয় তখন যেন খেয়ানত না করে। যখন প্রতিশ্র“তি দেয় তা যেন ভঙ্গ না করে। তোমরা তোমাদের দৃষ্টি অবনত কর। তোমাদের হস্তদ্বয় সংযত কর। তোমাদের লজ্জাস্থান হেজাফত কর।” [ হাদীসটি তাবারানী বর্ণনা করেছেন এবং হাদীসটিকে ‘হাসান’ বলেছেন ]

 

ইসলামের এ সব চরিত্রে এমন কিছু নেই যা ঘৃণা করা যায়। বরং এসব এমন সম্মান যোগ্য মহৎ চারিত্রাবলী যা প্রত্যেক নিষ্কলুষ স্বভাবের অধিকারীর সমর্থন লাভ করে। মুসলমানগণ যদি এ মহৎ চরিত্র ধারণ করত তাহলে সর্বস্থান থেকে তাদের নিকট মানুষ আগমন করত এবং দলে দলে আল্লাহর দ্বীনে তারা প্রবেশ করত যেভাবে প্রথম যুগের মুসলমানদের লেন-দেন ও চরিত্রের কারণে সে সময়ের মানুষ ইসলামে প্রবেশ করেছিল।

                                                                                                                                    সমাপ্ত

ইসলাম প্রচার ব্যুরো, রাবওয়াহ, রিয়াদ

 

প্রচণ্ড রাগ হলে কি করবেন?

$
0
0
মূল প্রবন্ধঃ ডঃ হাসান শামসি বাশা্‌
 অনুবাদঃ   মোঃ মুনিমুল হক  |  ওয়েব সম্পাদনাঃ   মোঃ মাহমুদ -গাফফার  
11

আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য আত্মসংযম বা রাগ নিয়ন্ত্রণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা গুন। এটা আমাদের ক্রোধ বা রাগের নানারকম শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি থেকে বাঁচিয়ে রাখে।

আবু হুরাইরা (রাঃ) বলেন, একদিন রসূলাল্লাহ(সঃ) এর কাছে এক ব্যক্তি এসে বললেন,“হে আল্লাহ্‌র রসূল, আপনি আমাকে কিছু অসিয়ত করুন।” উত্তরে নবী করিম(সঃ) বললেন, “তুমি রাগান্বিত হইয়ো না” সে ব্যাক্তি একথাটি কয়েকবার বলল। তিনি (প্রত্যেকবারই একই কথা) বললেন, “তুমি রাগান্বিত হইয়ো না” [সহীহ বুখারী ৫৬৮৬ ইফা]

নবী করিম(সঃ) আরও বলেন,

সে প্রকৃত বীর নয়, যে কাউকে কুস্তীতে হারিয়ে দেয়। বরং সেই প্রকৃত বাহাদুর, যে ক্রোধের সময় নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম।” [সহীহ বুখারী ৫৬৮৪ ইফা]

নবী করিম(সঃ) এই উপদেশটি দিয়েছিলেন কারণ তিনি বুঝতে পেরেছিলেন কেউ রাগান্বিত হয়ে পড়লে তা তার এবং তার আশেপাশের লোকজনের জন্য শারীরিক ও মানসিকভাবে কতটা ক্ষতিকর ও বিপদজনক। কিন্তু তিনি এটাও জানতেন যে রাগের মুহূর্তে এই উপদেশটা মেনে চলা এত সহজ নয়, তাই তিনি রাগ নিয়ন্ত্রণের উপায়ও শিখিয়ে দিয়েছেন আমাদেরকে। তাকে যখন জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, “হে আল্লাহ্‌র রসূল(সঃ), তাহলে (রাগের) চিকিৎসা কি?” উত্তরে নবী করিম(সঃ) বললেন,

কেউ যদি দাঁড়ানো অবস্থায় রাগান্বিত হয়ে পড়ে তার উচিত সাথে সাথে বসে পড়া, আর রাগ না কমা পর্যন্ত ওই অবস্থায় থাকা। অন্যথায় তার উচিত শুয়ে পড়া।” [আবু দাউদ ৪৭৬৪]

নবী করিম(সঃ) কেন এই উপদেশ দিয়েছেন আমাদের তা সঠিকভাবে বুঝতে হলে আমাদের জানতে হবে আমাদের শরীর ও মনের উপর রাগের ক্ষতিকর প্রভাবগুলো কি কি, আর বসে বা শুয়ে পড়ার সাথে রাগের সম্পর্কটাই বা কি। কেউ যখন রাগান্বিত হয়ে পড়ে তখন তার কিডনির উপরে অবস্থিত অ্যাড্রেনালিন গ্রন্থি থেকে অ্যাড্রেনালিন নামক একপ্রকার হরমোন নিঃসরণ শুরু হয়। রাগ, ভয়, রক্তে শর্করার পরিমাণ কমে যাওয়া বা এজাতীয় যেকোনো শারীরিক বা মানসিক চাপের কারণে এই হরমোনের নিঃসরণ ঘটতে পারে। আর এই অ্যাড্রেনালিন গ্রন্থি থেকে নরঅ্যাড্রেনালিন নামক আরও  একপ্রকার হরমোন নিঃসরণ ঘটে, যদিও কিনা এই হরমোনের প্রধান উৎস হল হৃদপিণ্ডে সিম্পেথেটিক স্নায়ুর প্রান্তভাগে। তবে এই দুই প্রকার হরমোনই পরস্পর সম্পর্কযুক্ত এবং আর এদের নিঃসরণও ঘটে একই সাথে।

রাগের ফলে আমাদের শরীরে এই দুইপ্রকারের হরমোনই অধিক পরিমাণে নিঃসরিত হতে থাকে। এরমধ্যে একটা হরমোন যেহেতু হৃদপিণ্ড থেকে নিঃসরিত হয়, তাই রাগান্বিত অবস্থায় আমাদের হৃদপিণ্ড অধিকতর সক্রিয় হয়ে পড়ে, ফলে হৃদকম্পন হয়ে উঠে আরও দ্রুত ও অনিয়মিত। শারীরিক বা মানসিক চাপের ফলে হৃদপিণ্ডের এই তীব্র পরিবর্তন আমরা অনেকেই প্রায় সময় অনুভব করতে পারি। তাছাড়াও আমদের রেগে যাবার ফলে হৃদপিণ্ডের অতি-সক্রিয়তার কারণে অতিরিক্ত অক্সিজেনের জোগান দেওয়ার জন্য হৃদপেশীর সংকোচনও বেড়ে যায় কয়েক গুন; ফলে ধমনীতে চাপ পড়ে। আর তাই রাগান্বিত অবস্থায় হৃদরোগে আক্রান্ত ব্যক্তির স্বাস্থ্যঝুকি অনেকগুণ বেড়ে যায়। আর যাদের ধমনীর প্রশস্ততা কম তাদের হার্ট অ্যাটাকের (Cardiac Arrest) সম্ভাবনাও বেড়ে যায় কয়েকগুণ, কেননা তাদের সংকুচিত ধমনী দিয়ে হঠাৎ অধিক বেগে রক্ত সঞ্চালনের ফলে ধমনীতে সৃষ্ট অতিরিক্ত চাপের কারণে তা ছিঁড়ে যেতে পারে যেকোনো সময়। শরীরে এই দুই হরমোনের পরিমাণ বেড়ে যাবার ফলে আমাদের রক্তচাপও বৃদ্ধি পায় অনেক, যা ব্লাড প্রেসারের (অধিক বা কম রক্তচাপের) সমস্যায় আক্রান্ত ব্যক্তির জন্য খুবই বিপদজনক ও ক্ষতিকর। তাছাড়া ডায়াবেটিক রোগীদের সাধারণত রাগ নিয়ন্ত্রণের পরামর্শ দেওয়া হয় কেননা রাগ বা মানসিক চাপের ফলে সৃষ্ট অতিরিক্ত অ্যাড্রেনালিন আমাদের রক্তে শর্করার পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়, যা একজন ডায়াবেটিক রোগীর জন্য খুবই বিপদজনক।

এছাড়াও কিছু কিছু ক্ষেত্রে রাগ বা ক্রোধ আমদের পুরো শরীরেই নানারকম মারাত্মক স্বাস্থ্য সমস্যার সৃষ্টি করে। আর একারণেই হয়তো নবী করিম(সঃ) বারবার রাগ সংবরণের উপদেশ দিয়েছেন আমাদের। এর গুরুত্ব বুঝাতে গিয়ে তিনি পরপর তিনবার বলে উঠেন, “রাগান্বিত হইয়ো না।”

এবার দেখা যাক রাগ নিয়ন্ত্রণের জন্য রসূল(সঃ) যে উপায় বলে দিয়েছেন আমাদের তা কতটা বিজ্ঞানসম্মত? চিকিৎসাশাস্ত্রের বিখ্যাত লেখক হ্যারিসন বলেন, “এটা বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত যে, পাঁচ মিনিট শান্তভাবে দাড়িয়ে থাকাকালীন একজন ব্যক্তির রক্তে নরঅ্যাড্রেনালিনের পরিমাণ দুই থেকে তিনগুণ বেড়ে যেতে পারে। দাড়িয়ে থাকার কারণে অ্যাড্রেনালিনও সামান্য পরিমাণে বেড়ে যায়। কিন্তু বিভিন্ন রকমের মানসিক চাপ রক্তে অ্যাড্রেনালিনের মাত্রা খুব বাড়িয়ে দিতে পারে।”

সহজ কথায় বলতে হয়, শান্তভাবে পাঁচ মিনিট দাড়িয়ে থাকলেই মানুষের রক্তে নরঅ্যাড্রেনালিনের পরিমাণ দ্বিগুণ বেড়ে যায়, সাথে সাথে অ্যাড্রেনালিনও সামান্য পরিমাণে বেড়ে যায়। এখানে মনে রাখা উচিত যে অ্যাড্রেনালিন নামক হরমোনটি প্রধানত রাগ বা মানসিক চাপের কারণে বৃদ্ধি পেয়ে থাকে। তাই সুস্পষ্টভাবে এটা প্রতীয়মান হয় যে দাঁড়ানো অবস্থায় রেগে গেলে এই হরমোনের অতিরিক্ত নিঃসরণ আমাদের শরীরের উপর মারাত্মক চাপ সৃষ্টি করে। এর থেকেই বুঝা যায় আজ থেকে পনেরোশ বছর আগে যখন বর্তমানের তুলনায় চিকিৎসাবিজ্ঞানে মানুষের জ্ঞান বা অগ্রগতি ছিল যৎসামান্য তখন রসূল(সঃ) এর দিয়ে যাওয়া এই উপদেশ বানীর গুরুত্ব কতটুকু। “কেউ যদি দাঁড়ানো অবস্থায় রাগান্বিত হয়ে পড়ে তার উচিত সাথে সাথে বসে পড়া আর রাগ না কমা পর্যন্ত ওই অবস্থায় থাকা। অন্যথায় তার উচিত শুয়ে পড়া।”- এটাই হল সর্বকালের সর্বাধুনিক ডাক্তারি পরামর্শ!

রাগ নিয়ন্ত্রণে রাখার এতসব দুনিয়াবি উপকারিতার পাশাপাশি যারা নিজেদের রাগ নিয়ন্ত্রণে রাখে, তাদেরকে মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনের সূরা আল-ইমারানে পরকালে ক্ষমা ও জান্নাতের অধিবাসী করবার ওয়াদা করছেনঃ

“যারা নিজেদের রাগকে সংবরণ করে আর মানুষের প্রতি ক্ষমা প্রদর্শন করে, বস্তুতঃ আল্লাহ সৎকর্মশীলদিগকেই ভালবাসেন।” [সূরা আল ইমরান, ৩:১৩৪]

তাছাড়া পূর্বেইতো বলেছি রসূল(সঃ)তাকেই প্রকৃত বীর বলেছেন যে নিজের ক্রোধ সংবরণ করতে পারে।

ENGLISH VERSION

উৎসঃ আল-জূমা ম্যাগাজিন, ভলিউম ১২- ইস্যু ৪- রবিউস সানী ১৪২১ হিজরি

ইসলামে হালাল উপার্জন : গুরুত্ব ও তাৎপর্য

$
0
0

লিখেছেন : ড. মোঃ আবদুল কাদের    |    ওয়েব সম্পাদনা : মোঃ মাহমুদ ইবনে গাফফার

Coins and plant, isolated on white background

 

ইসলাম পরিপূর্ণ এক জীবন ব্যবস্থার নাম। এতে মানবজীবনের ব্যক্তিগত পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলের যাবতীয় বিষয়ের সমাধানে হিকমতপূর্ণ বিধানের বর্ণনা রয়েছে। এটি মানুষের জন্য যা কল্যাণকর ও হিতকর সে বিষয় বৈধ করত: সবিশেষ গুরুত্বারোপ করেছে এবং যাবতীয় অকল্যাণ ও ক্ষতিকর বিষয় হতে মানবজাতিকে সর্তক করেছে। অতএব, ইসলাম মানবজাতির জন্য কল্যাণের আঁধার হিসেবে শান্তির বার্তা নিয়ে আবির্ভূত হয়েছে। মানবদেহের জীবনীশক্তি হিসেবে রক্তের যে গুরুত্ব রয়েছে, মানবজীবনে অর্থের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তাও তেমনি তাৎপর্যপূর্ণ। ফলে অর্থ মানব জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। আর এর জন্য প্রয়োজন মেধা, শ্রম ও সময়ের যথোপযুক্ত ব্যবহার। জীবন নির্বাহের এ মাধ্যমটিই পেশা হিসেবে পরিগণিত।

 

মহান আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নির্ধারিত ফরজ ইবাদত (যেমন নামায) সম্পন্ন করার পর জীবিকা অন্বেষনে জমীনে ছড়িয়ে পড়তে নির্দেশ দিয়েছেন। যাতে সর্বশ্রেষ্ঠ জীব নিজেই জীবিকা অর্জনে ব্রতী হয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজের পরিশ্রম লব্দ উপার্জনকে সর্বোত্তম উপার্জন বলে আখ্যায়িত করেছেন। তবে নিশ্চয় উপার্জনের পন্থা শরীয়াত নির্ধারিত পন্থায় হতে হবে। এমন উপার্জনকে ইসলাম অবৈধ ঘোষনা করেছে, যাতে প্রতারনা, মিথ্যা, ধোঁকাবাজি, জনসাধারণের অকল্যাণ সর্বোপরি জুলুম রয়েছে। দুনিয়ার জীবনে অবৈধ পন্থায় উপার্জন করে সুখ-সাচ্ছন্দ লাভ করলেও পরকালীন জীবনে রয়েছে এর জন্য জবাবদিহিতা ও সুবিচার। সে লক্ষে ইসলাম হালাল উপার্জনের অপরিসীম গুরুত্ব প্রদান করেছে। নিম্নে এসম্পর্কে আলোচনা প্রদত্ত হলো:

উপার্জনের গুরুত্ব

খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা, মানুষের মৌলিক অধিকার। এগুলোর যোগান দিতে মানুষকে বেছে নিতে হয় সম্পদ উপার্জনের নানাবিধ পন্থা। জীবিকা নির্বাহের জন্য মানুষ যেসব পেশা অবলম্বন করে তা হলো: কৃষি, ব্যবসা-বানিজ্য, চাকুরী, শিল্প প্রভৃতি। উপার্জনের মাধ্যম ব্যতীত কোন ব্যক্তির পক্ষেই উপর্যুক্ত মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ করা সম্ভব নয়। মানুষকে মহান আল্লাহ সৃষ্টির শ্রেষ্ট জীব হিসেবে সৃষ্টি করেই ক্ষান্ত হননি; বরং তাদের যাবতিয় মৌলিক অধিকারও সংরক্ষণের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। সে লক্ষে তিনি মহাশুণ্যের সব সৃষ্টিকে মানুষের সেবায় নিয়োজিত করেছেন। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে:

‘‘তিনিই সেই মহান সত্তা, যিনি পৃথিবীর সবকিছু তোমাদের (ব্যবহারের জন্য) তৈরী করেছেন।’’ [1]

 

তবে এক্ষেত্রে তিনি মানুষকে দিয়েছেন পূর্ণ স্বাধীনতা যা তার ইখতিয়ারভুক্ত একান্ত নিজস্ব ব্যাপার। ফলে প্রত্যেকে স্ব-স্ব যোগ্যতা, মেধা, শ্রম ও সময়ের যথোপযুক্ত ব্যবহারের মাধ্যেমে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের প্রয়াস চালায়।

 

মানবজীবনে অর্থনীতির গুরুত্ব অপরিসীম। এটি মানুষের জীবন নির্বাহের অন্যতম চালিকা শক্তি হিসেবে সমাদৃত, মানব জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে পরিগণিত। মহান আল্লাহ মানুষকে এর গুরুত্ব অনুধাবন বোধগম্য করার নিমিত্তে পবিত্র কুরআনে সালাতের পাশাপাশি যাকাত তথা অর্থের উল্লেখ ৮২ স্থানে করেছেন। শুধু তাই নয়, মহান আল্লাহ অর্থনৈতিক বিধানও নির্দেশ করেছেন। ফলে কুরআনুল কারিমকে একটি অর্থবিদ্যার মহাকোষ বললেও অত্যুক্তি হবে না। মানুষ কিভাবে উপার্জন করবে, কোন পন্থায় তা ব্যয় করবে এবং উপার্জনের ক্ষেত্রে যাবতীয় অর্জনীয় ও বর্জনীয় গুণাবলীর সম্পর্কে এর সুষ্পষ্ট নির্দেশনা বিদ্যমান। তাইতো ব্যক্তির উপার্জিত সম্পদে তিনি যাকাত ফরয করেছেন, যেন সম্পদ এক শ্রেণির লোকদের মাঝে সীমাবদ্ধ না থাকে। আল্লাহ তা‘আলা ফরয ইবাদত সমাপনান্তে জীবিকা নির্বাহে উপার্জন করার লক্ষ্যে যমিনে ছড়িয়ে পড়তে নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন:

‘‘সালাত সমাপ্ত হলে তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে এবং আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধান করবে, এবং আল্লাহকে অধিক স্মরন করবে যাতে তোমরা সফলকাম হও [2]।’’

 

এ আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম কুরতুবী (র.) বলেন:

‘‘যখন নামায শেষ হয়ে যাবে, তখন তোমরা ব্যবসায়িক কাজকর্ম ও অন্যান্য পার্থিব প্রয়োজনাদি পূরণে বেড়িয়ে পড়ো [3]।’’

 

এখানে উপার্জনের একটি মূলনীতি সুস্পষ্টভাবে প্রতিভাত হয়েছে। আর তাহলো এমন পন্থা অবলম্বন করতে হবে, যাতে আল্লাহর স্মরণে ব্রত থাকা যায়।

অতএব, যেসব পেশায় বা উপার্জনের পন্থায় আল্লাহর স্মরণে বিমুখ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে ইসলাম তা অবৈধ হিসেবে ঘোষনা করেছে। পবিত্র কুরআনে অন্যত্র এ বিষয়ে প্রমাণ পাওয়া যায়। সেটি হলো ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে যদি কখনও আল্লাহর স্মরণে ব্রত হওয়ার আহবান আসে, তাহলে তখন যাবতীয় ব্যবসায়িক কর্ম পরিহার করা সকল ইমানদারদের জন্য ওয়াজিব।[4]

 

জীবিকা অর্জনের নিমিত্তে বিদেশে পাড়ি জমানোরও নির্দেশও রয়েছে এবং এটিকে আল্লাহর রাস্তায় বের হওয়ার সমপর্যায়ভুক্ত বলে গণ্য করা হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন:

‘‘আল্লাহ জানেন যে, তোমাদের মধ্যে কেউ কেউ অসুস্থ হয়ে পড়বে, কেউ আল্লাহর অনুগ্রহের সন্ধানে দেশভ্রমন করবে এবং কেউ কেউ আল্লাহর পথে যুদ্ধে লিপ্ত হবে।’’ [5]

আলোচ্য আয়াতের ব্যাখ্যায় আল্লামা ইবনে কাসীর (রহ.) বলেন:

‘‘অর্থ্যাৎ যারা ব্যবসা-বানিজ্য ও রিযিক উপার্জনের বিভিন্ন উপায় অবলম্বনের মাধ্যমে আল্লাহর অনুগ্রহ লাভের অন্বেষায় পৃথিবীতে ভ্রমনরত।[6]’’

 

তাছাড়া ব্যক্তি জীবনে অর্থনৈতিক স্বাবলম্বী হওয়ার ব্যাপারে বিশ্বনবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমনভাবে উৎসাহিত করেছেন যে, ভিক্ষাবৃত্তিকে তিনি নিন্দা করেছেন। এ মর্মে যুবাইর ইবনে ‘আউয়াম রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

‘‘তোমাদের কেউ তার রশি নিয়ে চলে যাক, পিঠে কাঠের বোঝা বহন করে এনে বিক্রয় করুক এবং তার চেহারাকে আল্লাহর আযাব থেকে বাঁচিয়ে রাখুক এটা তার জন্য মানুষের নিকট ভিক্ষা করা, চাই তাকে দান করুক বা না করুক তার চাইতে উত্তম।’’ [7]

 

অতএব উপার্জন করার মনোবৃত্তি ব্যতিরেকে যারা ভিক্ষাবৃত্তিতে প্রবৃত্ত হয় তাদের এ ধরনের পেশাকে অবৈধ সাব্যস্ত করা হয়েছে। এ মর্মে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

‘‘তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি সর্বদা মানুষের কাছে চেয়ে বেড়ায় সে কিয়ামতের দিন এমন অরস্থায় আগমন করবে যে, তার মুখমণ্ডলে এক টুকরো গোশতও থাকবে না।[8]’’

ইসলাম মানবতার ধর্ম। দুস্থ মানবতার সেবায় দান করার রীতি ইসলামে চালু আছে। তবে ভিক্ষাবৃত্তিকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করতে ইসলাম অনুমোদন দেয় নি। বরং একে বার বার নিরুৎসাহিত করেছে যা, নিষেধের পর্যায় পৌঁছে গিয়েছে।

 

উপার্জনের ক্ষেত্রে ইসলাম নিজ হাতে উপার্জন করাকে সর্বোত্তম উপার্জন হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। এ মর্মে হাদীসে এসেছে:

হযরত রাফে ইবনে খাদীজা রাদিয়াল্লাহু আনহা হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে, সর্বোত্তম উপার্জন কোনটি? জবাবে তিনি বলেন: ব্যক্তির নিজস্ব শ্রমলব্দ উপার্জন ও সততার ভিত্তিতে ক্রয়-বিক্রয়।’’  [9]

 

নবী রাসূলগণের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, তাঁরা নিজ হাতে কর্ম সম্পাদনকে অধিক পছন্দ করতেন। আমাদের প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জীবনে প্রাথমিক সময়ে ছাগল চড়ানো ও পরবর্তীতে খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহার ব্যবসায়িক দায়িত্ব পালনের বর্ণনা পাওয়া যায়, যা নিজ হাতে জীবিকা নির্বাহে উৎকৃষ্ট প্রমাণ বহন করে।

 

ইসলামের দৃষ্টিতে হালাল উপার্জন

হালাল বলতে আমরা সাধারণত: যাবতীয় বৈধ পন্থাকেই বুঝি। যা কল্যানকর ও হিতকর এবং যাবতীয় অবৈধ ও অকল্যাণকর হতে মুক্ত। ইসলামে হালাল উপার্জনের গুরুত্ব অপরিসীম। মহান আল্লাহ মানব জাতিকে উপার্জনের জন্যে উৎসাহ দিয়েই ক্ষান্ত হননি; বরং যাবতীয় বৈধ ও অবৈধ পন্থাও বাতলে দিয়েছেন। অতএব হালাল উপার্জন বলতে বুঝায় উপার্জনের ক্ষেত্রে বৈধ ও শরী‘আত সম্মত পন্থা অবলম্বন।

 

হালাল উপায়ে জীবিকা উপার্জনের ফলে সমাজ ব্যবস্থায় ধনী দরিদ্রের মাঝে সুষম ভারসাম্য ফিরে আসে; কৃষক দিন মজুর, ক্রেতা-বিক্রেতা, শ্রমিক-মালিক এবং অধস্তনদের সাথে উর্ধ্বতনদের সুদৃঢ় ও সংগতিপূণ সর্ম্পক তৈরী হয়। ফলে সকল শ্রেণীর নাগরিকই তাদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা করার সুযোগ পায় এবং সমাজ সংসারে নেমে আসে শান্তির সুবাতাস।

মূলত: ইসলাম যে পেশাকে অবৈধ বলে ঘোষনা করেছে সেসব পন্থায় উপার্জন ব্যতীত অন্যান্য পন্থায় উপার্জন করা বৈধ বলে বিবেচিত।[10]

 

ইসলাম প্রদত্ত সীমারেখা ও মূলনীতি ঠিক রেখে বৈধ যে কোন পণ্যের ব্যবসা করার মাধ্যমে উপার্জনকে ইসলামী শরী‘আত হালাল হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। এছাড়া যদি কেউ বৈধ উপায়ে যোগ্যতানুযায়ী চাকুরী করে এবং ঘুষ সহ যাবতীয় অবৈধ লেন-দেন ও অসৎ মানসিকতা থেকে দুরে থাকে তবে সেটাও জীবিকার্জনের হালাল পন্থা হিসেবে সাব্যস্ত হবে।

মহান আল্লাহ মানুষকে তাঁর ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছেন। এটি শুধুমাত্র পাঁচ ওয়াক্ত নামায, রোযা, যাকাত প্রভৃতির উপরই সীমাবদ্ধ নয়। জীবন ব্যবস্থার পূর্ণাঙ্গ রূপ রেখার প্রণেতা হিসেবে ইসলামে রয়েছে জীবন ধারনের যাবতীয় বিষয় সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক নির্দেশনা। এ দৃষ্টিকোন থেকে বিচার করলে হালাল উপায়ে উপার্জনের ব্যবস্থা গ্রহণও অন্যতম একটি মৌলিক ইবাদত। শুধু তাই নয়, ইসলাম এটিকে অত্যাবশ্যক (ফরয) কাজ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।

 

এ মর্মে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর একটি হাদীস প্রনিধানযোগ্য। তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

‘‘ফরয আদায়ের পর হালাল পন্থায় উপার্জনও ফরয।’’  [11]

 

উপর্যুক্ত হাদীসের মাধ্যমে প্রতিভাত হয় যে, ইসলামে হালাল উপার্জনের গুরুত্ব কতখানি এবং কোন ব্যক্তি যেন হারাম কোন পেশা অবলম্বন না করে উপরোক্ত হাদীসে সে মর্মেও অর্ন্তনিহীত নির্দেশ রয়েছে। পরকালীন জীবনে এ ফরয ইবাদতটি সম্পর্কে যে মানুষকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে তার সুস্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে। কেননা যাবতীয় ফরয সম্পর্কে বান্দা জিজ্ঞাসিত হবে। অতএব এটি ফরয কাজ সমূহের অন্তর্গত এক মৌলিক অত্যাশ্যকীয় ইবাদতে গণ্য হয়েছে।

 

 

উপার্জনের ক্ষেত্রে ইসলাম যেসব পন্থাকে হালাল করেছে সেগুলোর মূলনীতিসহ সংক্ষিপ্ত বিবরণ নিম্নে দেয়া হলো:

১.১ ব্যবসা বাণিজ্য

উপার্জনের ক্ষেত্রে ব্যবসা-বাণিজ্য সব চেয়ে বড় সেক্টর। ইসলামের দৃষ্টিতে এটি একটি মহৎ পেশা। সমাজ জীবনে যার ক্রিয়াশীলতা ও প্রভাব অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ও সুদূঢ় প্রসারী। ইসলাম ব্যবসা-বাণিজ্যকে শুধু বৈধ বলেই ক্ষান্ত হয়নি; বরং এ ব্যাপারে সবিশেষ উৎসাহ ও গুরুত্ব প্রদান করেছে। যেন মুসলিম উম্মাহ পৃথিবীর বুকে একটি শ্রেষ্ট জাতি হিসেবে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধি ও স্বয়ং-সম্পূর্ণতা অর্জন করতে পারে। মহান আল্লাহ বলেন:

‘‘তিনি (আল্লাহ) ব্যবসাকে হালাল করেছেন এবং সুদকে করেছেন হারাম।’’  [12]

 

উপরোক্ত আয়াতের মর্ম উপলব্দিতে প্রতীয়মান হয় যে, সুদভিত্তিক লেন-দেনের মাধ্যমে যারা পৃথিবীতে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন করছে তাদের মুকাবিলায় মহান আল্লাহ ব্যবসা-বাণিজ্যকে বৈধ বলে ঘোষনা দিয়েছেন। অতএব অবৈধ পন্থা হতে বাঁচার এবং প্রাচুর্য ও সমৃদ্ধি লাভের এটি অনেক বড় অবলম্বণ। এছাড়াও জীবিকার একটি বৃহৎ অংশ রয়েছে এ ব্যবস্থাপনায়। মুরসাল হাদীসে বর্ণিত হয়েছে,

‘‘তোমরা ব্যবসা বানিজ্য কর। কারণ তাতেই নিহিত রয়েছে নয়-দশমাংশ জীবিকা’’  [13]

 

তাছাড়া সততা, বিশ্বস্ততা, ন্যায়পরায়নতা, ধোঁকামুক্ত, কল্যাণমুখী মানসিকতাসম্পন্ন ব্যবসায়ীদের প্রশংসায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অনেক হাদীস বিদ্যমান। এ ধরনের ব্যবসায়ীকে তিনি নবীগণ, ছিদ্দিক, ও শহীদদের সমমর্যাদাপূর্ণ বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

‘‘সৎ ও ন্যায়পরায়ণ ব্যবসায়ী (পরকালে) নবী, সিদ্দিকীন ও আল্লাহর পথে জীবন বিসর্জনকারী শহীদদের সঙ্গী হবে। [14]

 

ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ইসলাম যেসব মূলনীতি দিয়েছে তাহলো: ধোঁকা ও প্রতারনামুক্ত, মিথ্যার আশ্রয় বিহীন, পণ্যের দোষ - গুণ স্পষ্ট থাকা, ভাল পণ্যের সাথে খারাপ পণ্যের মিশ্রণ না করা, মুনাফাখোরী মানোবৃত্তি পরিহার করে কল্যাণমুখী মানষিকতা পোষণ, মজুদদারি চিন্তা-চেতনা পোষণ না করা, ওজনে হের-ফের না করা, সর্বোপরি যাবতীয় শঠতা ও জুলুম থেকে বিরত থাকা।

 

১.২. চাকুরী

এটি জীবিকা নির্বাহে উপার্জনের অন্যতম মাধ্যম হিসেবে পরিগণিত। জনসংখ্যার একটা উল্লেখযোগ্য অংশ আমাদের দেশে সরকারী আধা-সরকারী, বেসরকারী, ব্যাংক-বীমা, এন.জি.ও. ও ব্যক্তিমালিকানাধিন এবং স্বায়ত্বশাসিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকুরী করে। এসব চাকুরীর ক্ষেত্রে ইসলামের মূল দর্শন হলো প্রত্যেক চাকুরে তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব পূর্ণ নিষ্ঠা, আন্তরিকতা ও সচ্ছতার সাথে পালন করবে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ বিষয়ের মূলনীতি বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন:

‘‘তোমাদের প্রত্যেকেই এক একজন দায়িত্বশীল। তোমাদের প্রত্যেককে নিজ নিজ দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে।’’ [15]

 

তবে এক্ষেত্রে অবশ্যই সকলকে যাবতীয় অনিয়ম, দুর্নীতি যেমন ঘুষ গ্রহণ, স্বজনপ্রীতি অন্যায়ভাবে কাউকে  সুযোগ সুবিধা (undue Facilities) দান, কারো প্রতি জুলুম করা প্রভৃতি বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি রাখতে হবে। কেননা এসব অনিয়ম ও দুর্নীতি-পরায়ণদের অশুভ পরিণতি সম্পর্কে ইসলামের সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে।[16]

 

এছাড়াও কর্তব্যে অবহেলা, অনিয়মানুবর্তিতা ও কার্যে উদাসীনতার দরুন চাকুরীজীবিদের উপার্জন অনেক সময় বৈধতা হারিয়ে ফেলে। আমাদের দেশে দেখা যায় অনেক স্কুল-কলেজের শিক্ষক শ্রেণীকক্ষে পাঠ দানের পরিবর্তে টিউশনী ও কোচিং সেন্টারের প্রতি বেশী ঝুকে পড়েছেন। অনেক ডাক্তার হাসপাতালে রোগী না দেখে ক্লিনিকে জমজমাট ব্যবসা শুরু করে দিয়েছেন। যা কর্তব্যে অবহেলার নামান্তর। তারা যদি স্বীয় দায়িত্ব যথাযথ ও পূর্ণভাবে পালন করার পর অতিরিক্ত সময় এসব কাজ করেন তবে তা দোষের নয়।

 

১.৩.কৃষিকর্ম

কৃষিকর্ম জীবিকা নির্বাহে অন্যতম উপার্জন মাধ্যম। ইসলাম এটিকে মহৎ পেশা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। কৃষিকার্যের সুচনা হয়েছে আদিপিতা আদম আলাইহিস সালাম থেকেই তাঁকে কৃষি কার্য, আগুনের ব্যবহার ও কুটির শিল্প শিক্ষা দেয়া হয়েছিল।[17]

পর্যায়ক্রমে এ ব্যবস্থার উন্নতি সাধিত হয়েছে। পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ মানবজাতির কল্যাণে এ ব্যবস্থাকে সাব্যস্ত করেছেন।[18]

 

বাংলাদেশ একটি কৃষি প্রধান দেশ। এদেশের অধিকাংশ লোকই কৃষি নির্ভর জীবিকা নির্বাহ করে। অথচ ইসলামের কৃষিনীতি সম্পর্কে অবগত হয়ে যদি কেউ তাঁর এ ব্যবস্থাপনায় ইসলামী নীতি অনুসরণ করে তবেই তা হালাল উপার্জন হবে। আর সেগুলো হলো:

[ক]. ভূমির মালিক নিজেই চাষ করবে। এ সম্পর্কে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

‘‘যার জমি রয়েছে সে নিজেই চাষাবাদ করবে।’’  [19]

তবে এক্ষেত্রে কারো জমি অন্যায়ভাবে অধিকারে আনে কিংবা উত্তরাধিকারকে অংশ না দিয়ে চাষ করলে গুরুতর অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে।  [20]

 

অথবা, মজুরের দ্বারা নিজের তত্বাবধানে চাষ করবে অথবা কোন ভূমিহীনকে চাষাবাদ ও ভোগদখল করতে দিবে।

 

[খ]. উৎপন্ন ফসলের নির্দিষ্ট অংশ দেয়ার শর্তে কাউকে চাষ করতে দেয়া।

[গ]. প্রচলিত বাজার দর অনুযায়ী নির্দিষ্ট পরিমাণ নগদ টাকার বিনিময়ে কাউকে এক বছরের জন্য তার ভোগাধিকার দান করা।  [21]

[ঘ]. জমিতে হারাম দ্রব্য উৎপাদন না করা, যাতে ক্ষতিকর কোন উপাদান রয়েছে্ যেমন: আফিম, গাঁজা, চারস বা অনুরূপ মাদক দ্রব্য।  [22]

[ঙ]. অংশীদারিত্ব চাষাবাদ যাবতীয় প্রতারণা, ধোঁকা, ঠকবাজি, ও অজ্ঞতা থেকে মুক্ত থেকে ন্যায়পরায়নতা ও ইনসাফ ভিত্তিক নীতির লালন করতে হবে।

 

আল্লামা মাওয়ারদী উল্লেখ করেছেন যে,

উৎপাদনের মূল উপাদান দু’টি, এক. কৃষি, দুই. ব্যবসা-বানিজ্য। তবে এদুয়ের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ও পবিত্রতম হলো কৃষি।  [23]

 

ইসলামে মানুষের অর্থ-সম্পদ লাভের তিনটি নৈতিক পন্থা নির্ধারন করে দেয়া হয়েছে। আর তা হলো:

১. পরিশ্রম:

পরিশ্রমের মাধ্যমে মানুষ অর্থ সম্পদ উপার্জন করতে পারে। সে সঙ্গে মেধা ও যোগ্যতার সমন্বয়ে মানুষ অর্থের পাহাড় গড়তে সক্ষম হয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন আল্লাহর নিকট ঐ জীবিকাই উত্তম যা মানুষ নিজ হাতে উপার্জন করে। এভাবে শ্রমদানের ক্ষেত্রও বহুবিধ ও বিচিত্র ধরনের। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:

১. শিল্পকর্ম:

ব্যবসা-বাণিজ্যের পাশাপাশি শিল্পকর্মও মানুষের অন্যতম পেশা। এ মহতি পেশায় জনসংখ্যার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ নিয়োজিত রয়েছে। এ কর্মটি সম্পর্কে ইসলাম যথেষ্ট গুরুত্বরোপ করেছে। যুগে যুগে প্রেরিত নবী-রাসূলগণ শুধু উৎসাহের বানী প্রদান করেই ক্ষান্ত হননি; বরং শিল্প ও ব্যবসার ময়দানে তাদের বিশাল অবদান রয়েছে। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে:

‘‘আমি তাঁকে (দাউদ আলাইহিস সালাম) বর্ম নির্মাণ শিক্ষা দিয়েছিলাম যাতে তা যুদ্ধে তোমাদেরকে রক্ষা করে।’’  [24]

 

শিল্প শিক্ষাকে মহান আল্লাহ নিয়ামত হিসেবে অভিহিত করেছেন এবং এ-জন্য শুকরিয়া আদায় করার নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহর নবীগণ কোন না কোন শিল্পকর্মে নিয়োজিত ছিলেন। উপরোক্ত আয়াতে দাউদ আলাইহিস সালাম বর্ম শিল্পে নিয়োজিত ছিলেন বলে আভাস রয়েছে। এছাড়াও তিনি প্রথম জীবনে চাষী হিসেবে কাজ করেছেন। তিনি শষ্য বপন ও কর্তন করতেন। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘যে জমি মানুষের খিদমতের জন্য কোন কাজ করে তাঁর দৃষ্টান্ত মূসা আলাইহিস সালাম জননীর ন্যায়। তিনি নিজে সন্তানকে দুধ পান করিয়েছেন; আবার ফেরাউনের কাছ থেকে পাবিশ্রমিক পেয়েছেন। এছাড়া মূসা আলাইহিস সালাম মাদইয়ানে ৮ বছর চাকরী করছেন, নূহ আলাইহিস সালাম জাহাজ নির্মান করেছেন। যাকারিয়া আলাইহিস সালাম কাঠমিস্ত্রির কাজ করতেন। বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাল্যকালে ছাগল চরাতেন, যৌবনে ব্যবসা করেছেন, চাকরী করেছেন, খন্দকের যুদ্ধে মাটি কেটেছেন, মাথায় বোঝা বহন করেছেন। কূপ থেকে পানি তুলেছেন, নিজ হাতে জামা ও জুতা সেলাই করেছেন, স্ত্রীকে ঘরে রান্নার কাজে সাহায্য করেছেন, এমনকি দুধ দোহনও করেছেন। এজন্য পেশা ক্ষুদ্র হোক, বৃহৎ হোক, তাতে কিছু আসে যায় না। নিজে পরিশ্রম করে শ্রমলব্দ আয়ে নিজের পরিবারবর্গের আস্বাদনের জন্য সংগ্রাম করা অতিশয় সম্মান ও পূণ্যের কাজ।

 

২. উত্তরাধিকার:

উত্তরাধিকারসূত্রে মানুষ অর্থ সম্পদ লাভ করে থাকে। কোন ব্যক্তির মৃত্যুর পর তার উত্তরাধিগণ ইসলামের বিধান অনুযায়ী মৃতের পরিত্যক্ত স্থাবর, অস্থাবর সম্পত্তি হতে যে সম্পদ লাব করে থাকে তা হালাল।

 

৩. হেবা বা দান:

কোন বিনিময় মূল্য বা প্রতিদান ব্যাতিরেকে কাউকে নিজের সম্পদের মালিকানা হস্তান্তর বা দান করা এবং যার অনুকুলে হস্তান্তর বা দান করা হয় সে ব্যাক্তি কর্তৃক তা গ্রহণ করাকে হেবা বলা হয়। হেবার মাধ্যমে অর্জিত অর্থ সম্পদ হালাল।

 

উপার্জন বৈধ হওয়ার ইসলামী মূলনীতি

ইসলামে উপার্জনের ক্ষেত্রে অনুসরণীয় দু’টি মূলনীতি রয়েছে।

এক. মূলগত: যা উপার্জন করা হবে তা মূলগতভাবে হালাল হতে হবে।

দুই. পদ্ধতিগত: যা উপার্জন করব তা বৈধ পন্থায় হতে হবে।

 

এক. মূলগত:

একজন ব্যক্তি যা উপার্জন করবে সে উপার্জেয় বস্ত্তটি অবশ্যই উত্তম ও হালাল হতে হবে। আর ইসলাম যাবতীয় কল্যাণকর ও হিতকর বস্ত্তকে মানবজাতির জন্য হালাল করেছে।

সেলক্ষ্যেই পবিত্র কুরআনে طيبات ও حلال শব্দের অবতারনা হয়েছে। মহান আল্লাহ মানব জাতিকে সম্বোধন করে হালাল ও তাইয়্যিব যা রয়েছে তা থেকে আহার করতে বলেছেন। তিনি বলেন:

‘‘হে মানুষ! পৃথিবীতে হালাল ও তাইয়্যেব যা রয়েছে তা থেকে আহার কর। আর শয়তানের পদাংক অনুসরণ করো না, নি:সন্দেহে সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু। [25]

 

উপরোক্ত আয়াতের আলোকে বলা যায় যে, শুধুমাত্র হালাল হলেই চলবে না; বরং তা অবশ্যই তাইয়্যিব (পবিত্র ও উত্তম) হতে হবে। এখানে তাইয়্যিব বলতে ভেজালমূক্ত স্বাস্থসম্মত উদ্দেশ্য। অর্থাৎ এমন উপায় অবলম্বন করতে হবে যা মূলগত ভাবেই নির্ভেজাল, খাটি ও পবিত্র। অবশ্য অধিকাংশ মুফাস্সিরগণ আয়াতে হালাল শব্দ দ্বারা মূলগত বৈধতার এবং তাইয়্যিব দ্বারা পদ্ধতিগত বৈধতার অর্থ গ্রহণ করেছেন এবং এ দু’শব্দ দিয়ে দু’টি মূলনীতির প্রতি ইঙ্গিত করেছেন।

 

দুই. পদ্ধতিগত

উপার্জনের ক্ষেত্রে গ্রহণীয় উপায় ও মাধ্যমটি অবশ্যই বৈধ পন্থায় হতে হবে। কেননা যাবতীয় অবৈধ উপায় ও পন্থায় অর্থসম্পদ উপার্জন করতে ইসলাম নিষেধ রয়েছে। পবিত্র কুরআনের একাধিক আয়াতের মাধ্যমে এ বিষয়ে মুমিনগণকে সর্তক করা হয়েছে।

মহান আল্লাহ বলেন:

‘‘হে মুমিনগণ! তোমরা একে অপরের সম্পত্তি অন্যায়ভাবে গ্রাস করোনা। কিন্তু তোমাদের পরস্পর রাযি হয়ে ব্যবসা করা বৈধ; এবং একে অপরকে হত্যা করিওনা; নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের প্রতি পরম দয়ালু। আর যে কেউ সীমালংঘন করে অন্যায়ভাবে তা করবে, তাকে আমি অগ্নিতে দগ্ধ করব, আর এটা করা আল্লাহর পক্ষে সহজ।’’  [26]

 

মহান আল্লাহ বলেন:

‘‘তোমরা নিজেদের মধ্যে একে অপরের সম্পদ অবৈধ পন্থায় গ্রাস করো না এবং মানুষের ধন-সম্পত্তির কিয়দাংশ জেনে শুনে অন্যায়ভাবে গ্রাস করার উদ্দেশ্যে তা বিচারকগণের নিকট পেশ করো না।[27]’’

 

উপরোক্ত আয়াতদ্বয় দ্বারা সুষ্পষ্টভাবে প্রতিভাত হয় যে, উপার্জনের পদ্ধতি ও পন্থা অবশ্যই বৈধ হতে হবে। অন্যথায় কঠোর শাস্তির ঘোষনা রয়েছে। আর এ ধরনের উপায় জুলমের নামান্তর। যার পরিণতি খুবই ভয়াবহ। অতএব প্রত্যেক মুসলমানের একান্ত উচিত উপার্জনের ক্ষেত্রে উপর্যুক্ত দু’টি বিষয়ের প্রতি গুরুত্বারোপ করা।

 

প্রখ্যাত আধুনিক তাফসিরকার আল্লামা রশিদ রেজা আয়াতে উল্লেখিত হালাল ও তাইয়্যিবা এ দু’টি শব্দের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলেন, কোন বস্ত্ত তাইয়্যিব বা উত্তম হওয়ার অর্থ হলো তাতে অন্যের অধিকার সম্পৃক্ত না থাকা। কেননা পবিত্র কুরআনে যেসব বস্ত্তর ব্যাপারে হারাম শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। সেগুলো মূলগতভাবেই হারাম বা নিষিদ্ধ। একমাত্র নিরূপায় অবস্থা ছাড়া কোন অবস্থাতেই তার ব্যবহার বৈধ নয়। এ ছাড়াও এক ধরনের হারাম রয়েছে যা মূলগতভাবে হারাম নয় কিন্তু সংশ্লিষ্ট কোন কারণে তাকে হারাম বলা হয়েছে। মূলত: এ জাতীয় বস্ত্তর বিপরীতেই তাইয়্যিব বা উত্তম শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। সুতরাং যেসব বস্ত্ত অন্যায়ভাবে উপার্জন করা হয়েছে, ন্যায়ানুগ পন্থায় করা হয়নি। যেমন: সুদ, ঘুষ, জুয়া, চুরি, ছিনতাই, রাহাজানি, ধোঁকা-প্রতারনা, আমানতের খিয়নত ইত্যাদি পন্থায় করা হয়েছে এগুলো হারাম। অর্থ্যাৎ এগুলো তাইয়্যিব বা উত্তম নয়। সারকথা প্রতিটি অপবিত্র বস্ত্তই হারাম, তা মূলগত কারণেই হোক কিংবা সংশ্লিষ্ট অন্য কোন কারণেই হোক।

 

হালাল উপার্জনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য:

জীবিকা নির্বাহের জন্য উপার্জনের গুরুত্ব ইসলামে যেমনি রয়েছে, ঠিক তেমনি হালাল উপার্জনের গুরুত্ব ও অত্যাধিক। ইসলাম মানুষের জন্য যাবতীয় জীবনোপকরণকে সহজসাধ্য, সুস্পষ্ট, ও পবিত্র করার নিমিত্বে সঠিক ও বৈজ্ঞানিক নির্দেশনা দিয়েছে। অতএব নির্দেশনা বহির্ভূত যাবতীয় উপার্জনই হারাম বা অবৈধ হিসেবে বিবেচিত। ইসলামের বক্তব্য হল মানুষকে নিজের সার্মথ্য ও যোগ্যতানুযায়ী নিজেই নিজের প্রয়োজনীয় অর্থ ও দ্রব্য সামগ্রীর সন্ধান করবে। এটি মানুষের অন্যতম অধিকার। তবে ইসলাম মানুষকে এ অধিকার দেয়নি যে, সে অর্থ সম্পদ উপার্জনের জন্য স্বীয় খেয়ালখুশিমত যে কোন পন্থা অবলম্বন করতে পারবে। তাইতো ইসলাম অর্থসম্পদ উপার্জনের ক্ষেত্রে হালাল-হারামের পার্থক্য সুনির্দিষ্ট করে দিয়েছে। সমাজ রাষ্ট্র ও ব্যাক্তির জন্য কল্যানকর যাবতীয় ব্যবস্থাকে ইসলাম হালাল করেছে। নিম্নে এ ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব সম্পর্কে আলোকপাত করা হল:

 

এক. হালাল উপার্জন একটি অলঙ্ঘনীয় বিধান

ইসলাম মানুষের জন্য হালাল ও হারামের মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য নিরূপন করেই শেষ করেনি, বরং হালাল উপার্জনে রয়েছে এর সুস্পষ্ট নির্দেশনা। ফরজ ইবাদত সমূহের আদায়ের পর এ মহতি কর্মে ঝাপিয়ে পরতে উৎসাহিত করা হয়েছে। উপার্জনের ক্ষেত্রে হালাল ও বৈধ উপায় অবলম্বন করা ব্যবসায়ীসহ সকল মানুষের উপর ইসলামের একটি অলঙ্ঘনীয় বিধান। যারা উপার্জনের ক্ষেত্রে হালাল ও হারামের প্রশ্নে সতর্কতা অবলম্বন করে না তাদের ব্যপারে নবী করিম সতর্কবাণী করেছেন। তিনি বলেন:

‘‘মানুষের নিকট এমন একটি সময় আসবে, যখন ব্যক্তি কোন উৎস থেকে সম্পদ আহরন করছে, তা হালাল না হারাম, সেদিকে কোন ভ্রুক্ষেপ করবে না।’’  [28]

 

দুই. হালাল উপার্জন দু’আ কবুলের পূর্বশর্ত

মানুষের প্রত্যহিক ও জাগতিক জীবনের চাহিদার কোন অন্ত নেই। তবে এগুলো মানুষের কাঙ্খিত ও বাঞ্চিত হলেও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে মহান স্রষ্ট্রার অনুগ্রহের, ভূমিকাই সবচেয়ে বেশী। আর এর জন্য প্রয়োজন একান্তে তাঁর দরবানে আরাধনা করা। মহান আল্লাহ ও মানুষে এ ব্যপারে সাড়া দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, এটি অন্যতম ইবাদত ও বটে। রাসূল সা. বলেন:

‘‘দোয়া হচ্ছে ইবাদত’’ অতএব দু’আ ইসলামে অন্যতম একটি ইবাদতে পরিণত হয়েছে, যার মাধ্যমে বান্দার সাথে আল্লাহর গভীর প্রেম নিবেদন করা চলে এবং যাবতীয় প্রয়োজন পূনণে সহায়ক হয়। এ গুরুত্বপূর্ণ কর্মটি আল্লাহর দরবারে গৃহীত হতে হলে উপার্জন অবশ্যই হালাল হতে হবে। কেননা আল্লাহ পবিত্র। তিনি পবিত্র ছাড়া কোন কিছুই গ্রহণ করেননা, অতএব অবৈধ উপার্জন যারা করে তাদের খাদ্যের উপার্জন হয় অবৈধ অর্থে হওয়ায় ইসলম যাবতীয় রক্ত মাংশ সবই হারাম দ্বারা পুষ্ট হয়। ফলে এ ধরনের ব্যক্তির প্রার্থনাকে ইসলামে কখনো সমর্থন করেনা।   [29]

 

এ মর্মে রাসূল সা. বলেন:

‘‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআল পবিত্র। তিনি শুধু পবিত্র বস্ত্তই গ্রহণ করেন। তিনি মুমিনদের সেই আদেশই দিয়েছেন, যে আদেশ তিনি দিয়েছিলেন রাসূলগণের।’’ আল্লাহ তা’আলা বলেন : ‘‘হে ইমানদারগণ! তোমরা পবিত্র বস্ত্ত-সামগ্রী আহার কর, যেগুলো আমি তোমাদেরকে রুযী হিসেবে দান করেছি।’’ অতঃপর রাসূল সা. এমন এক ব্যক্তির কথা উল্লেখ করলেন, যে দীর্ঘ সফরে থাকা অবস্থায় এলোমেলো চুল ও ধূলি-ধুসরিত ক্লান্ত-শ্রান্ত বদনে আকাশের দিকে আল্লাহর দরবারে হাত তুলে প্রার্থনা করে ডাকছেঃ হে আমার প্রভূ! হে আমার প্রভূ! অথচ সে যা খায় তা হারাম, যা পান করে তা হারাম, যা পরিধান করে তা হারাম এবং হারামের দ্বারা সে পুষ্টি অর্জন করে। তার প্রার্থনা কিভাবে কবুল হবে?’’  [30]

 

ইবন আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত হাদীসে এসেছেঃ

‘‘রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট একদা এ আয়াতটি তেলাওয়াত করা হল। ‘‘হে মানবমন্ডলী ! পৃথিরীর হালাল ও পবিত্র বস্ত্ত-সামগ্রী ভক্ষন কর।’’ তখন সাদ ইবন আবি ওয়াক্কাস রাদিয়াল্লাহু আনহু দাঁড়িয়ে বললেনঃ হে আল্লাহর রাসূল! আল্লহর কাছে দু’আ করুন যেন আমার দু’আ কবুল হয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ হে সা‘দ, তোমার পানাহারকে হালাল কর, তবে তোমার দু’আ কবুল হবে।’’  [31]

 

তিন. হালাল উপার্জনে বরকত লাভ হয়

উপার্জনে বরকত লাভ করতে হষে একমাত্র হালাল পন্থায় হতে হবে। কেননা বরকত দানের মালিক মহান আল্লাহ। তিনি শুধু বৈধ উপার্জনেকেই বরকত মন্ডিত করেন। এবং যাবতীয় অবৈধ উপার্জনের বারকত নষ্ট করে দেন। আর যেখানে অপচয় বৃদ্ধি পায়। ফলে সম্পদের প্রাচুর্যতা লাভে বিলম্ব হয়। অন্যদিকে হালাল উপার্জন কম হলেও তাতে বরকতের কারণে খুব স্বল্প সময়েই বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

 

চার. হালাল উপার্জন জান্নাত লাভের একমাত্র উপায়

মানুষের দু’টি জীবন রয়েছে, একটি ইহলৌকিক, অপরটি পরলৌকিক। অতএব হালাল পন্থায় উপার্জনকারী পরকালে জান্নাতে যাবে। আর অবৈধ পন্থায় উপার্জনকারী ব্যাক্তি দুনিয়ার জীবনে সম্পদের পাহাড় গড়লেও পরকালীন জীবনে তার জন্য ভয়াবহ আযাব ও শাস্তি অপেক্ষা করছে।

 

পাঁচ. অবৈধ উপায়ে সম্পদ উপার্জনকারীর জন্য জাহান্নাম অবধারিত

ইবন আববাস রা.বর্ণিত হাদীসে রাসূল সা. বলেছেনঃ

‘‘আর যে দেহ হারাম খাদ্য দ্বারা গড়ে উঠে তার জন্য দোযখের আগুনই উত্তম।’’  [32]

 

কাব ইবন উজরাহ রা. রাসূলে কারীম সা. থেকে বর্ণনা করেন:

‘‘যে শরীর হারাম পেয়ে হ্রষ্ট পুষ্ট হয়েছে, তা জান্নাতে যাবে না।’’  [33]

 

দুনিয়ার জীবনের কৃতকর্মের উপর ভিত্তি করে মহান আল্লাহ মানুষের জন্য পুরুস্কার ও শাস্তি উভয়ের ব্যবস্থা করে রেখেছেন। যারা তাঁর অনুগত বান্দা তারাই পুরুস্কার প্রাপ্ত হবে। যেহেতু অবৈধ উপায়ে উপার্জনকারী ব্যক্তি তার অবাধ্য ও দুশমন তাই তাদের জন্য ও শাস্তি নির্ধারিত রয়েছে। অতএব এ পন্থা অবলম্বনকারী ব্যক্তি জাহান্নামী।

 

ছয়. হালাল উপার্জন ইবাদত কবুলের শর্ত

অর্থ-সম্পদ দ্বারাই মানুষ জীবিকা নির্বাহ করে, খাদ্যদ্রব্য গ্রহণ করে তার দেহের বৃদ্ধি ঘটে এবং সুস্বাস্থ্য লাভ হয়। কিন্তু এ উপকরণ ক্রয়ের অর্থ যদি অবৈধ উপায়ে উপার্জিত হয় তবে তা কিভাবে বৈধ শারিরিক বৃদ্ধি হতে পারে। ফলে তার শরীরের রক্তে ও মাংসে অবৈধ বিষয়ের সংমিশ্রন ঘটে। আর এর দ্বারা যত ইবাদতই করা হোক না তা গ্রহনযোগ্য হতে পারে না। কেননা আল্লাহ অপবিত্র কোন কিছুই গ্রহণ করে না। অতএব হালাল উপার্জন ইবাদত কবুলের পূর্ব শর্ত হিসেবে শিরোধার্য। সালাত, যাকাত ও হজ্জ ইত্যাদি ফরয ইবাদতসমূহ কবুল হওয়ার জন্র অবশ্যই বৈধ পন্থায় উপার্জন করতে হবে।

 

খুলাফায়ে রাশেদীন ও সাহাবায়ে কিরাম ছিলেন হালাল উপার্জনের অন্বেষক

তাঁরা যাবতীয় লেন দেন হালাল পন্থা অবলম্বন করতেন। হারামের ভয়াবহতা সম্পর্কে তারা খুবই সচেতন ছিলেন। আবু বকর রা. এর একটি ঘটনা থেকে তাঁর হারাম বর্জন প্রবণতা ও হালালের বিষয়ে কঠোরতা সহজেই অনুমেয়। বর্ণিত আছে যে, আবু বকর রা. এর এক গোলাম ছিল সে তাঁর সঙ্গে কিছু অর্থের বিনিময়ে মুক্তির চুক্তি পত্র করে। অতঃপর সে যখন প্রতিদিন মুক্তিতপনের কিছু অর্থ নিয়ে আসতো, তখন আবু বকর রা. তাকে জিজ্ঞাসা করতেন, এ অর্থ কিভাবে সংগ্রহ করেছো? যদি সে সন্তোষজনক উত্তর দিতে পারতো, তবেই তিনি তা গ্রহণ ও ব্যবহার করতেন। অন্যথায় ব্যবহার করতেন না। এক রাতে সে আবু বকর রা. এর জন্য কিছু খাবার নিয়ে এলো। সে দিন তিনি রোযা রেখেছিলেন। তাই সেই খাবার সম্পর্কে প্রশ্ন করতে ভুরে যান এবং তা থেকে এক লোকমা খেয়ে ফেলেন। অতঃপর মনে হওয়া মাত্র তাকে জিজ্ঞেস করলেন, এ খাবার তুমি কিভাবে অর্জন করেছ? সে বললোঃ জাহেলিয়াতের আমলে আমি মানুষের ভাগ্য গণনা করতাম। আমি ভাল গণক ছিলাম না। তাই মানুষকে শুধু ধোঁকা দিতাম। এই খাবার সেই ধোঁকার মাধ্যমে উপার্জিত অর্থ দিয়ে সংগৃহীত। আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেনঃ সর্বনাশ তুমি আমায় একি করেছ! অতঃপর তিনি গলায় আঙ্গুল দিয়ে ভমি করার চেষ্টা করেন, কিন্তু সে খাবারের কিছুই বের হয়নি। অতঃপর তিনি পানি পান করে ইচ্ছাকৃত বমির মাধ্যমে পেটের সব খাবার বের করে দিলেন। তিনি আরো বললেনঃ উক্ত খাবার বের করতে গিয়ে আমার মৃত্যুর ঝঁকি থাকত তাহলেও তা বের করে ছাড়তাম। কেননা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ

‘‘যে শরীর হারাম খাদ্য দিয়ে স্বাস্থ্য লাভ করে, তার জন্য জাহান্নাম উপযুক্ত স্থান। তাই আমি ভয় পেয়ে যাই, যে এক লোকমা হারাম খাবার দিয়ে আমার শরীর কিভাবে মোটা-তাজা হতে পারে।’’

 

হালাল উপার্জনের গুরুত্ব সম্পর্কে উলামায়ে কিরামের বক্তব্য

বৈধ পন্থায় উপার্জনের গুরুত্ব উপলব্দি করতঃ তার তাৎপর্য ও পরিণাম বর্ণনা করতে গিয়ে বিদগ্ধ উলামায়ে কিরাম ও মুফাসসিরগণ পান্ডিত্যপূণ উক্তির অবতারনা করেছেন। যেমন: সুফিয়ান সাওরি রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেনঃ

‘‘না জানি তা হারামের অন্তর্ভক্ত হয়ে যায় এ আশংকায় আমরা হালাল সম্পদের দশভাগের নয়ভাগ পরিহার করতাম।’’

 

দুই. ইবন আববাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেনঃ

তাওবা করে হালাল উপার্জনে ফিরে না আসা পর্যন্ত আল্লাহ এমন কোন মানুষের নামায কবুল করেন না, যার উদরে হারাম খাদ্য রয়েছে।

 

তিন. ইমাম ওহাব ইবনুল ওয়ারদ (রহ.) বলেনঃ

যদি তুমি রাত ভর খুটির ন্যায় ইবাদতে দাড়িয়ে থাক, তবুও তা তোমার কোন কাজে আসবে না! যতক্ষন পর্যন্ত তুমি নিশ্চত হবে যে, তুমি যা খাচ্ছ তা হালাল না হারাম।

 

চার. সুফিয়ান সাওরী (রহ.) বলেনঃ

যে লোক অবৈধ অর্থ দিয়ে কোন নেক কাজ করে, সে পেশাব দিয়ে কাপড় পবিত্র কারীর মত।

 

উপসংহার:

ইলাম কল্যাণকর এক মহতি জীবন ব্যবস্থা এতে যাবতিয় পবিত্র ও উত্তম বিষয় ও বস্ত্তকে বৈধ করা হয়েছে। কেননা বস্তু মাত্রের মাঝেই কিছু কল্যাণ ও কিছু অকল্যাণের সমাহার রয়েছে। গুনাগুণের বিচারে যে বস্ত্ততে মানুষের জন্য কল্যানকর উপাদানের পরিমাণ বেশী, অকল্যানের পরিমাণ কম, সেই গুলোকেই মহান আল্লাহ মানুষের জন্য হালাল করে দিয়েছেন। আর যে সকল বস্ত্ততে কল্যান কম অথচ অকল্যানের পরিমাণ বেশী, সেগুলোকে মনুষের জন্য হারাম করে দিয়েছেন। (যেমন মদ হারাম হওয়ার কারণ কুরআনে বিধৃত হয়েছে) অতএব, আমাদেরক খাওয়া-দাওয়া, পোষাক-আষাক এবং বিভিন্ন দ্রব্য সামগী্রর ব্যবহার, এমনকি যাবতীয় আয় উপার্জনের ক্ষেত্রে লক্ষ্য রাখতে হবে যে, সেগুলো যেন হালাল ও উত্তম হয়। যা মানব দেহের জন্য ক্ষতিকর ও ধ্বংসাত্নক পদার্থ্য দিয়ে তৈরী অথবা যা মানুষের মানবতা বোধকে ধ্বংস করে অথবা যা মানুষের জন্য পাশবিকতার জন্ম দেয় এবং তার সংযমী স্বভাবকে বিনষ্ট করে! কিংবা যা মানুষের আধ্যাতিক ও নৈতিক ক্ষতির (ব্যধি) কারণ হয়, এসকল বস্ত্ত ও উপার্জন মাধ্যম অবশ্যই পরিহার করতে হবে। তাছাড়া যেসব উপায় দম্ভ, অহংকার জন্ম দেয়, পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ববোধকে নষ্ট করে, নিষিদ্ধ ভোগ-বিলাসের প্রতি মানুষকে আকৃষ্ট করে, জুলুম-স্বেচ্ছাচারিতা ও আত্নকেন্দ্রিকতার জন্ম দেয়, দুশ্চরিত্রের প্রতিধাবিত করে, মুসলমানদেরকে অবশ্যই এসব মাধ্যম বর্জন করতে হবে। আমাদের রুজি-রোজগার যখন এসব থেকে পূতে পবিত্র হবে তখনই তা হালাল ও সিদ্ধ হবে।


[1]. সূরা আল-বাকারাহ: ২৯।

[2]. সূরা জুমআহ: ১০।

[3]. কুরতুবী, আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ, আলজামেউ লি আহকামিল কুরআন, খ.১৮,পৃ.৯৬।

[4]. সূরা জুমআহ: ৯।

[5]. সূরা মুয়যাম্মিল: ২০।

[6]. আবুল দিদা ইসমইল ইবন উমর ইবন কাসীর, তাফসীরুল কুরআনিল আযীম, সম্পাদনায়: সামী ইবন মুহাম্মদ সাল্লামা, বৈরুত: দারু তাইবা নিন্ন্যাসরী, দিত্বীয় সংস্করণ, ১৪২০ হি, খ. ৮, পৃ. ২৫৮।

[7] . ইমাম মুসলিম, সহীহ মুসলিম. হাদীস নং. (১০৪২)।

[8]. ইমাম বুখারী, আলজামে‘উসসাহীহ, হাদীস নং ১৪৭৪; ইমাম মুসলিম, সহীহ মুসলিম. হাদীস নং. ১০৪০।

[9]. ইমাম আহমাদ, মুসনাদ, খ.৪, পৃ. ১৪১.

[10]. ইসলামের দৃষ্টিতে হারাম পেশা হলো: অপ্রয়োজনে ভিক্ষাবৃত্তি গ্রহণ, বেশ্যাবৃত্তি, নৃত্য ও যেনৈশিল্প, অবৈধ ব্যবসা-বানিজ্য যেমন, মুর্তি, অবৈধ পাণীয়, ভাষ্কর্য ও প্রতিকৃতি নির্মান শিল্প, সুফী কারবার, ওজনে কম দেয়া, ধোঁকা ও প্রতারণামূলক ব্যবসা, মিথ্যার আশ্রয় নেয়া, ও চাকুরী হতে অবৈধ উপার্জন যেমন ঘুষ গ্রহণ।

[11]. আবূ বকর আহমদ ইবনুল হুসাইন আল-বায়হাকী, সুনান আল-বায়হাকী, সম্পাদনায়: আব্দুল কাদির আতা (মক্কা আল-মুকাররমা: মাকতাবাতু দারুল বায, ১৪১৪ হি/১৯৯৪ খ্রী.) খ. ৬, পৃ. ১২৮। ইমাম বায়হাকী বলেন, এর রাবী দুর্বল।

[12]. সূরা আল-বাকারা: ২৭৫।

[13]. গাযালী, ইহইয়াউ উলুমুদ্দীন, (মাকতবাতুল মুস্তফা আল বাবী ওয়াল হালবী) খ. ২, পৃ. ৬৪। ইমাম ‘ইরাকী বলেন: মুরসাল

[14]. ইমাম তিরমিযী, জামে’ আত্-তিরমিযী, হাদীস নং- ১২০৯। তবে আল্লামা আলবানী এটাকে দুর্বল বলেছেন।

[15] .ইমাম বুখারী, সহীহ, হাদীস নং ৮৯৩ ; ইমাম মুসলিম, সহীহ, হাদীস নং ১৮২৯।

[16]. ঘুষ গ্রহীতা ও দাতা উভয়ের অশুভ পরিণতি সম্পর্কে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: لَعَنَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الرَّاشِي وَالْمُرْتَشِي ‘‘ঘুষ দাতা ও গ্রহীতাকে আল্লাহ্‌র রাসূল লা‘নত করেছেন।” [ইমাম তিরমিযী, সুনান তিরমিযী, হাদীস নং ১৩৩৭; ইমাম আবু দাউদ, আসসুনান, ৩৫৮০] জুলুম, স্বজনপ্রীতি সংক্রান্ত হাদীস আসবে।

[17]. ইসলামী বিশ্বকোষ, (ঢাকা: ই. ফা. বা. তা. বি.) খ. ১, পৃ. ২৪৩; ইবন খালদুন, মুবাদ্দমা, (ঢাকা: বাংলা একাডেমী, ১ম প্রকাশ, ১৯৮১) খ. ২, পৃ. ৭-৮।

[18]. আল্লাহ তা’আলা বলেন:

﴿فَلۡيَنظُرِ ٱلۡإِنسَٰنُ إِلَىٰ طَعَامِهِۦٓ ٢٤ أَنَّا صَبَبۡنَا ٱلۡمَآءَ صَبّٗا ٢٥ ثُمَّ شَقَقۡنَا ٱلۡأَرۡضَ شَقّٗا ٢٦ فَأَنۢبَتۡنَا فِيهَا حَبّٗا ٢٧ وَعِنَبٗا وَقَضۡبٗا ٢٨ وَزَيۡتُونٗا وَنَخۡلٗا ٢٩ وَحَدَآئِقَ غُلۡبٗا ٣٠ وَفَٰكِهَةٗ وَأَبّٗا ٣١ مَّتَٰعٗا لَّكُمۡ وَلِأَنۡعَٰمِكُمۡ﴾

  সূরা আবাসা: ২৪-৩২।)

[19]. ইমাম বুখারী, সহীহ আল বুখারী, হাদীস নং - ২৩৪০।

[20]. কেউ এক খন্ড জমি অন্যায়ভাবে অধিকারে নিলে কিয়ামতের দিন ঐ জমির সাত স্তবক পর্যন্ত তার কাঁধে ঝুলিয়ে দেয়া হবে। নবী (সা.) বলেছেন, তিন ব্যক্তির উপর আল্লাহ অভিসম্পাত করেন। তাদের একজন হলো যে জমির আইল বা সীমানা পরিবর্তন করে ফেলে। ইমাম আহমদ ইবন হাম্বল, আল-মুসনাদ (মিসর: মুয়াসসাতুল কুরতবা, তা. বি) খ. ৪, পৃ. ১০৩।

[21]. মাওলানা মুহাম্মদ আবদুর রহীম, ইসলামের অর্থনীতি, (ঢাকা: খায়রুন প্রকাশনী, ৪র্থ সংস্করণ, ১৯৮৭) পৃ. ১৫৮-১৫৯।

[22]. রাসূল (সা.) বলেছেন, মাদক দ্রব্য উৎপাদনকারী, যে উৎপাদন করার, মদ্যপায়ী, বহনকারী, যার কাছে বহন কলে নেয়া হয়, যে পান করায়- পরিবেশনকারী, বিক্রয়কারী, মূল্য গ্রহণ ও ভক্ষনকারী এবং যার জন্য তা ক্রয় করা হয় । এ সকলের উপরই অভিশাপ। (আবূ দাউদ সুলাইমান ইবনুল আণআম আস-সিজিস্তানী। সুনান, সম্পাদনা: মহিউদ্দীন আবদুল হামিদ ) বৈরুত দারুল ফিকর, তা.বি) খ. ৩ পৃ. ২৪৪।

[23]. আবুল ফাতাহ মুহাম্মদ ইয়াহইয়া, ইসলামী অর্থনীতির আধুনিক রুপায়ন (ঢাকা: কওমী পাবলিকেশন্স ১ম সংস্করণ ১৪০৮ হি:/ ২০০১ খ্রী:) পৃ. ১৭৯।

[24]. সূরা আল-আম্বিয়া: ৮০।

[25]. সূরা আল-বাকারা: 168।

[26]. সূরা নিসা:২৯।

[27].  সূরা আল-বাকারাহ্: ১৮৮।

[28] . ইমাম বুখারী, আস-সাহীহ, হাদীস নং ২০৫৯।

[29].  আবু দাউদ, সুনান, হাদীস নং ১৪৭৯।

[30]. ইমাম মুসলিম, সহীহ মুসলিম, হাদীস নং- ১০১৫।

[31].  ইমাম তাবারানী, মু‘জামুল আওসাত, খ. ৬, পৃ. ৩১০

[32]. তাবারানী।

[33]. আবু ইয়া‘লা, মুসনাদ আবী ইয়া‘লা, খ.১ পৃ. ৮৪।

 

উৎস: ইসলাম হাউজ

অন্তরের কাঠিন্য

$
0
0

মূলঃ  ডঃ আবু আমিনাহ বিলাল ফিলিপস

হালাল ও হারাম সম্পর্কিত একটি বিখ্যাত হাদীসে  মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অন্তেরর গুরুত্ব সম্পর্কে আমাদের জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন :

“আমাদের শরীরে এমন একটি মাংস পিণ্ড রয়েছে যা সুস্থ থাকলে সারা শরীর সুস্থ থাকে আর যা অসুস্থ হলে সারা শরীর অসুস্থ হয়ে পড়ে। সেটি হচ্ছে হৃদয়।” [সম্পূর্ণ হাদীসটি হচ্ছে : আন-নু’মান বিন বাশীর কর্তৃক বর্ণিত : আমি আল্লাহ'র রাসূলকে বলতে শুনেছি, “হালাল ও হারাম উভয়েই স্পষ্ট, কিন্তু এ দুটির মাঝখানে রয়েছে সন্দেহজনক বিষয়সমূহ যা অধিকাংশ লোকই জানেনা। সুতরাং যে নিজেকে সন্দেহজনক বিষয় থেকে বাঁচিয়ে চলে, সে তার দ্বীন ও সম্মানের সংরক্ষণ করে।

আর যে সন্দেহজনক বিষয়ে জড়িয়ে পড়ে, তার উদাহরণ হচ্ছে সেই রাখালের মত যে তার মেষপাল চরায় কোন সংরক্ষিত চারণভূমির কাছাকাছি এমন ভাবে যে, যে কোন মুহূর্তে সে তাতে প্রবেশ করবে। (হে লোকসকল!) সাবধান! প্রত্যেক বাদশাহরই একটি সংরক্ষিত সীমানা আছে এবং আল্লাহর সংরক্ষিত সীমানা হচ্ছে তাঁর নিষিদ্ধ বিষয়সমূহ। সাবধান! আমাদের শরীরে এমন একটি মাংস পিণ্ড রয়েছে যা সুস্থ (পরিশুদ্ধ) থাকলে সারা শরীর সুস্থ থাকে, কিন্তু যদি তা কলুষিত হয়ে যায় সারা শরীর কলুষিত হয় এবং সেটি হচ্ছে হৃদয়।”] (বুখারী, প্রথম খণ্ড, ৪৯ নং হাদীস)

কথাটি তিনি বলেছেন, প্রথমে একথা ব্যাখ্যা করার পর যে হালাল স্পষ্ট, হারামও স্পষ্ট এবং এদের মাঝখানের ক্ষেত্রটি অস্পষ্ট যা অনেকেই জানেনা। যাহোক, যা একজন মানুষকে হারাম থেকে বাঁচতে ও হালাল অবলম্বন করতে সাহায্য করে তা হচ্ছে জ্ঞান ; এবং জ্ঞান ছাড়া আর যা একাজটি করতে পারে, তা হচ্ছে অন্তেরর অবস্থা। যদি অন্তর পরিশুদ্ধ হয়, জ্ঞানকে ব্যবহার করে তা হারাম এড়িয়ে চলতে পারে। যদি তা কলুষিত হয়, জ্ঞান কোন উপকারে আসে না এবং মানুষ নিষিদ্ধ বিষয়ে জড়িয়ে পড়ে।

বিদায় হজ্বে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর সাহাবাদের ও অনাগত মুসলিম জাতিসমূহের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন যে, কোন অনারবের উপর কোন আরবের শ্রেষ্ঠত্ব নেই ; কালোর উপর সাদার কোন প্রাধান্য নেই, কিন্তু আল্লাহর দৃষ্টিতে সেই শ্রেষ্ঠ যে আল্লাহকে ভয় করে – যে তাকওয়া অর্জন করেছে। এ বিষয়ে সাক্ষ্য দেওয়ার পর তিনি বলেন, “তাকওয়ার অবস্থান হচ্ছে আমাদের অন্তের।” এটি এবং অনুরূপ আরো বক্তব্যে অন্তেরর উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে – যাকে আল্লাহ তাঁর সৃষ্ট অন্য সব অঙ্গের উর্ধ্বে স্থান দিয়েছেন।

ঈমানের অবস্থান এখানেই। শরীরের অন্য কোন অঙ্গ যদি আল্লাহর আরো কাছের হতো, তাকওয়া সেখানেই অবস্থান করতো, কারণ মানুষের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ হলো ঈমান। এ ছাড়া আর কিছুরই মূল্য নেই। যারা আল্লাহকে বিশ্বাস করে, যারা তাঁর বাণী গ্রহণ করেছে এবং যারা জান্নাতকে জাহান্নামের পরিবর্তে বেছে নিয়েছে – ঈমান তাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য। ঈমান বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসীর মধ্যে পার্থক্য। দুনিয়ার সব কিছুর চেয়ে ঈমানের মূল্য বেশী। সেজন্য আল্লাহর রাসুল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যে কোন একজন মানুষকেও ইসলামের পথ দেখানো দুনিযার সব কিছুর চেয়ে উত্তম। কারো জন্য অন্য কাউকে ঈমান অর্জনে সাহায্য করা যে কোন পার্থিব বস্তুর চেয়ে মূল্যবান।

কাজের শুদ্ধতার বিচার করা হয় হৃদয়ের অবস্থা দিয়ে। নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্ললাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন যে :

“কর্মের বিচার করা হয় নিয়ত অনুসারে।” নিয়ত বা ইচ্ছার স্থান ঠোঁটে নয়, হৃদয়ে। [হাদীসটির পূর্ণ বক্তব্য : উমর বিন খাত্তাব বর্ণনা করেছেন : আল্লাহর রাসূল বলেছেন, “কর্মফল নিয়তের উপর নির্ভরশীল এবং প্রত্যেকই তা পাবে যা সে চেয়েছে। অতএব, যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের জন্য হিজরত করেছে, তার হিজরত আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের উদ্দেশ্যেই। আর যে কোন পার্থিব স্বার্থ অর্জন বা কোন মহিলাকে বিয়ের উদ্দেশ্যে হিজরত করেছে, তার হিজরত সে জন্যই যে জন্য সে হিজরত করেছে।”] (বুখারী, প্রথম খণ্ড,  ৫১ নং হাদীস)

আমরা যে কাজই বাহ্যিকভাবে করি না কেন, আমাদের হৃদয়ের অবস্থা তখন কি ছিল, তা দিয়েই তার বিচার হবে। এগুলি হচ্ছে ভাল কাজ। মন্দ কাজ মন্দই, কিন্তু ভাল কাজ বলতে আমরা যা বুঝি তা সেসব কাজ যা ন্যায়পরায়ণতার অবিচ্ছেদ্য অংশ। আল্লাহ বিচার করবেন সত্যিই সেগুলি ন্যায় কাজ কিনা।

মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের জানিয়েছেন যে প্রথম যে তিন ব্যক্তিকে জাহান্নামের আগুনে ফেলা হবে তারা মানুষের দৃষ্টিতে বড় বড় কল্যাণকর কাজে লিপ্ত ছিল। তারা হচ্ছে জ্ঞানের প্রচারে নিয়োজিত আলেম, ধনী ব্যক্তি যে তার সম্পদ থেকে দান করতো এবং আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধ করে শাহাদাৎ বরণকারী। একটি সহীহ হাদীসে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন যে তারা প্রথম জাহান্নামে নিক্ষিপ্তদের অন্তর্ভূক্ত হবে। কারণ সেই আলেম আল্লাহর সন্তুটির জন্য জ্ঞান প্রচার করতো না, করতো মানুষের কাছে বড় একজন জ্ঞানী হিসাবে সম্মান ও প্রশংসা পাওয়ার জন্য। আলাহ তাকে বলবেন : “দুনিয়াতে তুমি যা চেয়েছিলে সেই প্রশংসা তুমি পেয়ে গেছো, আখিরাতে তোমার জন্য কিছু নেই।” তারপর তাকে উপুড় করে টেনে নিয়ে জাহান্নামে ফেলে দেওয়া হবে। একইভাবে ধনী লোকটিও তার ধন-সম্পদ উদার হস্তে দান করতো যাতে লোকে তাকে মহান দাতা হিসাবে প্রশংসা করে। কিন্তু আল্লাহ বলবেন, “তুমি প্রশংসার জন্য দান করেছ এবং তা পেয়েছো। তুমি বিশুদ্ধভাবে আল্লাহর জন্য তা করনি। যতক্ষণ লোকে প্রশংসা করেছে, তুমি বদান্যতা দেখিয়েছো, কিন্তু লোকে যখন তোমার প্রতি মনোযোগ দেয়নি, তুমিও দান করা বন্ধ করে দিয়েছ। তোমার বদান্যতা ছিল শর্তযুক্ত, আলাহর সন্তুষ্টির জন্য নয়।” অতঃপর তাকে উপুড় করে টেনে নিয়ে জাহান্নামে ফেলে দেওয়া হবে। আর যে আল্লাহর রাস্তায় শহীদ হয়েছিল, আল্লাহ তাকে বলবেন : “তুমি এজন্য যুদ্ধ করেছো যে লোকে তোমাকে বলবে কত বড় একজন শক্তিশালী ও বীর যোদ্ধা তুমি!” লোকে তার প্রশংসা করেছে, কিন্তু সে আল্লাহর জন্য যুদ্ধ করেনি, সুতরাং তাকে উপুড় করে টেনে নিয়ে গিয়ে জাহান্নামে ফেলে দেওয়া হবে।

এসব কিছুই আমাদের এই শিক্ষা দিচ্ছে যে যদি হৃদয় অসুস্থ হয়, দুর্নীতিগ্রস্ত হয়, বড় বড় সৎকর্মও কোন কাজে আসবে না। সুতরাং হৃদয়ের প্রতি আমাদের গভীর মনোযোগ দেওয়া উচিত। নিজেদের হৃদয়ের অবস্থা সম্পর্কে সচেতন হওয়া ও পর্যবেক্ষণ করার জন্য আমাদের প্রচুর সময় দিতে হবে। যখন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আবু বকর সিদ্দীকের উচ্চ মর্যাদা সম্পর্কে মানুষকে বলছিলেন, তিনি বলেছিলেন;

“সে তোমাদের চেয়ে বেশী সালাত আদায় করে না বা রোযা রাখেনা, তোমাদের অনেকেই তার চেয়ে বেশী সালাত আদায় কর ও রোযা রাখ, কিন্তু তার হৃদয়ে এমন কিছু আছে যা গভীরভাবে প্রোথিত … তা হচ্ছে তার হৃদয়ে অবস্থিত ঈমান।”

এখানেই ছিল তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব। অতএব একজন মুমিনের কাছে মানব শরীরে ও অস্তিত্বে আর কোন যোগ্যতা থাকতে পারে না যে সম্পর্কে সে আরো অধিক সচেতন হবে। আল্লাহ যেভাবে চান সেভাবে এই দক্ষতা/যোগ্যতা ক্রিয়াশীল করার ব্যাপারে নিশ্চিত হতে হবে। এ সম্পর্কে আমাদের খুব বেশী সচেতন হতে হবে। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রায়ই দুআ শুরু করতেন এভাবে :

“হে আল্লাহ, আমি তোমার কাছে আশ্রয় চাই এমন জ্ঞান থেকে যা উপকারী নয় এবং এমন হৃদয় থেকে যা ভীত নয়।”

মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অত্যন্ত কোমল হৃদয়ের অধিকারী ছিলেন। তিনি মানুষের সাথে খুবই নম্র ব্যবহার করতেন। তাঁর স্ত্রীরা বলেছেন যে তাঁরা এমন কোন ঘটনার কথা মনে করতে পারেন না যেখানে তিনি তাঁদের সাথে কর্কশ ভাষায় কথা বলেছেন বা তাঁদের আঘাত করেছেন। তিনি তাঁর নম্রতার জন্য সুপরিচিত ছিলেন। এবং আল্লাহ এই গুণটিকে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বলে উল্লেখ করেছেন। সূরা আলে-ইমরানে আল্লা বলেছেন :

“আল্লাহর দয়ার কারণেই তুমি তাদের সাথে নম্র। যদি তুমি রূঢ় ও কঠিন-হৃদয় হতে, তাহলে তারা তোমার কাছে থেকে দূরে সরে যেতো।” (সূরা আলে-ইমরান, ৩ : ১৫৯)

নবীদের বৈশিষ্ট্য ছিল এটাই এবং এই বৈশিষ্ট্য তাদেরও অবশ্যই অর্জন করতে হবে যারা মানুষকে আল্লাহর পথ দেখায়। যেহেতু নবীদের জন্য এই গুণটি আবশ্যকীয়, এটি আমাদের জন্যও আবশ্যকীয়। যারা জ্ঞানের সন্ধানী তাদের জন্য এটি দরকারী, সব মানুষের জন্যই এটি দরকারী। আর পিতামাতার জন্যও ছেলেমেয়েদের প্রতি কোমল-হৃদয় হওয়া বাঞ্ছনীয়।

হৃদয়ের কোমলতা এমন একটি বিষয় যাতে আমরা প্রচুর সময় দিলেও যথেষ্ট হবে না। একবার নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল-আকরা বিন হারিস এর বাড়িতে গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি তার একটি বাচ্চাকে কোলে বসিয়ে আদর করে চুমা দিলেন। আল-আকরা বলল : “আমার আরও দশটি ছেলেমেয়ে আছে, কিন্তু আমি কখনো তাদের কাউকে চুমা দেইনি।” এটি ছিল একটি গর্বের বিষয়, পৌরুষ – যা কোমল নয়, কঠোর। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে বললেন, আল্লাহ যদি তোমার অন্তর থেকে দয়ামায়া সরিয়ে নিয়ে থাকেন, তাহলে আমার কি করার আছে! তিনি আরো বললেন, যে অন্যকে দয়া করে না সে দয়া পাবে না। সুতরাং বাচ্চাদের প্রতি কোমল আচরণ করা পিতামাতার জন্য জরুরী। যে ঘরে বাবা ছেলেমেয়েদের প্রতি দয়ালু ও ক্ষমাশীল, সে ঘর সুখ ও আনন্দে ভরা থাকে।

দয়া এমন কিছু যা ছাড়া আমরা বাঁচতে পারি না। যারা জ্ঞানের সন্ধানী, যেহেতু দ্বীনের জ্ঞান অর্জন করা আমাদের জন্য বাধ্যতামূলক, জ্ঞানের সাথে যদি সে কোমল হৃদয়ের অধিকারী না হয়, তবে জ্ঞানের সৌন্দর্য্য উপভোগ করা সম্ভব হয় না। যেমন হাসান আল-বসরী বলেছেন, “যদি কেউ জ্ঞান অনুসন্ধান করে, তা তার চেহারা, হাত ও জিহবায় এবং আল্লাহর প্রতি তার বিনয়ে প্রকাশ পাবে। এর বিপরীত কথাটিও সত্য যে কোন কিছুই জ্ঞানকে এবং দ্বীনের প্রতি আহ্বানের কাজকে ততটা নষ্ট করে না যতটা করে হৃদয়ের কাঠিন্য। যেখানে হৃদয় কঠিন হয়ে যায়, সেখানে জ্ঞান ব্যক্তির নিজেরও কোন উপকারে লাগে না বা সে তা দিয়ে অন্যেরও উপকার করতে পারে না।

হৃদয়ের কোমলতা সত্যিকার মুসলিমের বৈশিষ্ট্য। এর অনুপস্থিতিতে জীবন দুর্ভোগ ও অস্বচ্ছান্দ্যে ভরে যায়। এটা আল্লাহর ওয়াদা। যাদের হৃদয় কোমল নয় তারা দুর্ভোগময় জীবন যাপন করবে। যেমন সূরা আয-যুমারে আল্লাহ বলেছেন :

“যাদের অন্তর আল্লাহর স্মরণের ব্যাপারে কঠোর, তাদের জন্য দুর্ভোগ।” (সূরা আয-যুমার, ৩৯ : ২২)

তারা সুস্পষ্ট পথভ্রষ্টতার মধ্যে রয়েছে। তাদের জন্য দুর্ভোগ যারা কুরআন শ্রবণ করে কিন্তু তারপরও তারা ভীত ও বিনীত হয় না। দুর্ভোগ তাদের জন্য যাদের চোখকে আল্লাহর কথা স্মরণ করিয়ে দিলেও আল্লাহর ভয়ে তা ক্রন্দন করে না। দুর্ভোগ তাদের জন্য যাদের কাছে আল্লাহর সতর্কবাণী পৌঁছানোর পরও তারা তাঁর বাণীর প্রতি শ্রদ্ধাবনতও হয় না। কঠিন-হৃদয় বিশিষ্ট হওয়া একটি অভিশাপ আর হৃদয়ের নম্রতা সৌভাগ্যের কারণ। জীবনের সমস্ত কাম্য বস্তুর অধিকারী হলেও কঠিন হৃদয়-সম্পন্ন ব্যক্তি কষ্ট ভোগ করে। আপাত দৃষ্টিতে সুখময় মনে হলেও  তা এক শূন্য জীবন — একাকীত্বে পূর্ণ। তারা মনে এবং অন্তের শান্তি পায় না, কারণ তাদের অন্তর আল্লাহর প্রতি কঠিন – আল্লাহকে বিশ্বাসের ব্যাপারে ও তার আনুগত্যের ব্যাপারে। সেজন্যই আল্লাহ বলেছেন, যে তাঁর স্মরণ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে সে দুদর্শাগ্রস্ত জীবন যাপন করবে।

“… যে আমার বাণী থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে তার জন্য রয়েছে সংকীর্ণ জীবন, আর বিচার দিবসে আমরা তাকে উত্থিত করবো অন্ধ করে।” (সূরা তা-হা, ২০ : ১২৪)

এবং তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেছেনম একমাত্র আল্লাহর স্মরণেই হৃদয় শান্ত হয়।

“যারা বিশ্বাস করে, এবং যাদের হৃদয় আল্লাহর স্মরণে তৃপ্তি লাভ করে : নিঃসন্দেহে আল্লাহর স্মরণেই হৃদয়সমূহ শান্তি লাভ করে।”(সূরা রা’দ, ১৩ : ২৮)

এ জীবনে সবচেয়ে উপকারী বস্তু হচ্ছে একটি কোমল হৃদয়। আমরা হৃদয়ের কোমলতা অর্জনে চেষ্টা করবো। কারণ এছাড়া সবকিছুই অর্থহীন ও অপ্রয়োজনীয় হয়ে যাবে। কিভাবে আমরা তা অর্জন করতে পারি ?

এ জীবনে সবচেয়ে উপকারী বস্তু হচ্ছে একটি কোমল হৃদয়। আমরা হৃদয়ের কোমলতা অর্জনে চেষ্টা করবো। কারণ এছাড়া সবকিছুই অর্থহীন ও অপ্রয়োজনীয় হয়ে যাবে। কিভাবে আমরা তা অর্জন করতে পারি ?এটা কোন গোপন বিষয় নয়। এমন কিছু নয় যা অল্প কিছু মানুষ জানে এবং বিশেষ অধিবেশনে এবং জমায়েতে শুধু তা জানানো হয়। যেমন নবী মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : “আমি তোমাদের রেখে যাচ্ছি পরিষ্কার সাদা সমতলে, যার দিন তার রাত্রির মতই। যে কেউ তা থেকে বিচ্যুত হবে, সে ধ্বংস হয়ে যাবে।” তাঁর পথ আমাদের কাছে স্পষ্ট করে দেয় কিভাবে আমরা হৃদয়ের কোমলতা অর্জন করব।

প্রথম পদ্ধতি দুআ

প্রথম উপায় হচ্ছে দুআ করা।হৃদয়কে কোমল করে দেওয়ার জন্য ও তা দয়ায় পূর্ণ করে দেওয়ার জন্য আল্লাহর কাছে চাওয়ার মতো কার্যকরী আর কিছু নেই। এটাই তাঁর ওয়াদা যখন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন যে, “আল্লাহ কে ডাক নিশ্চিত হয়ে যে তিনি তোমার ডাক শুনবেন, কিন্তু একই সাথে জেনে রাখো যে আল্লাহ উদাসীন অন্তেরর দুআ কবুল করেন না।” কিন্তু তাতে আমাদের বিশ্বাস রাখতে হবে। যদি আমরা শুধু হাত তুলে বলি, “হে আল্লাহ, আমার হৃদয় কোমল করো!” এবং অন্তর থেকে না চাই, তাহলে এটা মৌখিক চাওয়া ছাড়া আর কিছুই নয়! বিশুদ্ধ চিত্তে আল্লাহর কাছে চাইতে হবে, তিনি অন্তরকে কোমল করে দেবেন, “আমাকে ডাক এবং আমি তোমাদের ডাক শুনি।” কুরআনের ভাষায়:

“আমার বান্দারা যখন তোমাকে আমার সম্পর্কে প্রশ্ন করে, আমি নিঃসন্দেহে তাদের কাছেই আছি : আমি প্রত্যেক আহ্বানকারীর আহ্বানে সাড়া দেই যখন সে আমাকে ডাকে ; তারাও যেন আমার ডাকে সাড়া দেয় এবং আমাকে বিশ্বাস করে ; যাতে তারা সঠিক পথের অনুসারী হয়।” (সূরা আল বাক্বারাহ, ২ : ১৮৬)

নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং তাঁর সাহাবাদের জীবনে আমরা যে বহু ঘটনার উদাহরণ পাই, তা একথাই প্রমাণ করে যে শুধু আল্লাহই অন্তেরর পরিবর্তন ঘটাতে সক্ষম। আমরা উমর বিন খাত্তাবের (রা) ঘটনাটি চিন্তা করি।

নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং ইসলামের প্রতি তাঁর মনোভাব এত কঠোর ছিল যে একদিন তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে হত্যা করার জন্য বের হন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এঁর প্রচেষ্টা ও ইসলামের প্রসারে ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে তিনি নিজেই ব্যাপারটার একটা নিষ্পত্তি করে ফেলতে চাইলেন। খোলা তলোয়ার হাতে বেরিয়ে গেলেন। পথে একজনের সাথে দেখা হলো, যিনি প্রথমে তাঁকে তাঁর বোনের ব্যাপারে খোঁজ নিতে বললেন। বিস্মিত হয়ে তিনি বোনের বাড়িতে গেলেন, দরজা ভেঙ্গে ঘরে ঢুকে বোনকে ও বোনের স্বামীকে প্রহার করে রক্তাক্ত করলেন। তারপর তিনি থামলেন ও দেখলেন তিনি কি করেছেন। ঘরে প্রবেশের পূর্বে তিনি কুরআনের কিছু অংশ শুনেছিলেন এবং তা তাঁর মনকে স্পর্শ করেছিল, কিন্তু তাঁর ক্রোধ সেই ভাবকে অন্তের স্থায়ী হতে দেয়নি। যখন তিনি বোনকে আঘাত করলেন এবং রক্ত প্রবাহিত হল, তাঁর চেতনা ফিরে এল। যা তিনি পূর্বে শুনেছিলেন তা তাঁর অন্তরকে নাড়া দিল। তিনি সেটা আবার শুনতে চাইলেন এবং কুরআনের কিছু অংশ তাঁকে পড়ে শোনানো হলো। তিনি বদলে গেলেন। তাঁর আমূল পরিবর্তনের জন্য এটাই যথেষ্ট ছিল। ইনিই উমর। আরেকবার, অন্য কোন সময়ে সাহাবারা তাঁকে দেখলেন তিনি বারবার হাসছেন, তারপর কাঁদছেন। তাঁরা তাঁকে এর কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। তিনি বললেন : “আমার মনে পড়েছিল জাহেলী যুগে আমার একটি দেবতা ছিল খেজুরের তৈরি। একদিন আমি এত ক্ষুধার্ত হলাম যে তার একটি টুকরা খেয়ে ফেললাম। তারপর আমি কাঁদছিলাম আমার কন্যার কথা মনে করে যাকে আমি জ্যান্ত কবর দিয়েছিলাম। যখন আমি তাকে গর্তে নামিয়ে দিচ্ছিলাম, সে আমার দাড়িতে লেগে থাকা ধূলা ঝেড়ে দিচ্ছিল।” এবং তিনি তাকে জ্যান্ত কবর দিয়েছিলেন। এটাই ছিল তখনকার রীতি—যারা কন্যা সন্তান জন্ম দেওয়াকে অসম্মানজনক মনে করে তাকে হত্যা করতো। তাঁর হৃদয় তখন কত কঠিন ছিল—কত কঠিন সেটা হতে পেরেছিল কন্যাটিকে জীবন্ত পুঁতে ফেলার সময়। কিন্তু তাঁর হৃদয় পরিবর্তিত হয়েছিল। এতখানি যে উমর যখন সালাতে ইমামতি করতেন, কান্নায় তাঁর কন্ঠ এমনভাবে আটকে যেত যে এমনকি তৃতীয় সারি থেকেও লোকে তাঁর কান্নার আওয়াজ শুনত। ইনিই ছিলেন উমর, এমন একজন যিনি এত কঠোর, এত শক্তিশালী, এত সাহসী ব্যক্তি… কিন্তু ইসলাম গ্রহণের সাথে সাথে তাঁর হৃদয় পরিবর্তিত হয়ে গেল। তাই আমাদের উচিত নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এঁর উপদেশ মত আল্লাহর দিকে ফিরে যাওয়া, তাঁর কাছে কোমল হৃদয় চেয়ে দুআ করা এবং নির্ভীক হৃদয় থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাওয়া। এই একই দুআয় তিনি আল্লাহর কাছে এমন চোখ থেকে আশ্রয় চাইতেন যা অশ্রুসিক্ত হয় না, যা কখনো কাঁদে না।

 

দ্বিতীয় পদ্ধতি মৃত্যুকে স্মরণ করা

দ্বিতীয় পথ হচ্ছে আখিরাতকে স্মরণ করা, মৃত্যুকে স্মরণ করা। এটিই একমাত্র বিষয় যে সম্পর্কে আমরা পুরোপুরি নিশ্চিত যে আমরা অবশ্যই মৃত্যুবরণ করব, যদিও বা আমাদের আল্লাহর অস্তিতে সন্দেহ থাকতে পারে, এমনকি আমাদের নিজেদের অনুসৃত পথ অন্যান্য বহু মত ও বহু পথের ভিতরে সঠিক কিনা তা নিয়েও আমাদের সংশয় থাকতে পারে। কিন্তু আমাদের জীবনটা এমন যে আমরা এতে জড়িয়ে পড়ে মৃত্যুর কথা ভুলে যাই। যেমন আল্লাহ বলেছেন, সম্পদ জমা করার আগ্রহ তাদেরকে জীবনের বাস্তবতা তা থেকে এমনভাবে প্রতারিত করে রেখেছে যে কবরে যাওয়ার সময়ই কেবল তাদের চৈতন্যোদয় হয়।

“প্রাচুর্যের লালসা তোমাদেরকে মোহাচ্ছন্ন রাখে এমনকি তোমরা কবরে পৌঁছে যাও। কিন্তু না, তোমরা শীঘ্রই জানতে পারবে বাস্তবতা)…” (সূরা আত-তাকাসুর, ১০২:১-৩)

এটি একটি ভীতিজনক বক্তব্য যে, আমরা মৃত্যু সম্পর্কে অসচেতন থেকে জীবনযাপন করে যাব এবং গতানুগতিক ব্যাপার নিয়ে মেতে থাকব, যা পরবর্তী জীবনে আমাদের কোন কাজেই আসবে না। এই পরিপ্রেক্ষিতেই নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :

“ইসলামের প্রথম যুগে আমি তোমাদের কবর জিয়ারত করতে নিষেধ করেছি। কিন্তু এখন আমি তোমাদের কবর জিয়ারতের নির্দেশ দিচ্ছি কারণ তা তোমাদের আখিরাতের কথা মনে করিয়ে দেবে।” [“আমি একসময় তোমাদের কবর জিয়ারত করতে নিষেধ করেছিলাম, (এবং এখন আমি বলছি) তোমাদের তা কর, যাতে জিয়ারত মৃত্যুর কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে উপকার করতে পারে।” (মুসলিম ও অন্যান্য)]

[আল হাকিমের এর ভাষ্য : “... কারণ (এরকম জিয়ারত) হৃদয়কে নরম করে, চোখে অশ্রু প্রবাহিত করে এবং আখিরাতকে স্মরণ করিয়ে দেয়, (কিন্তু সতর্ক থাক) যাতে নিষিদ্ধ কথা না বলা হয় (অর্থাৎ জিয়ারতের সময়)” (সহীহ আল জামি, ৫৪৮৪)] কবরস্থানে গিয়ে কবরবাসীদের অবস্থা সম্পর্কে চিন্তা ভাবনা করা উচিত (সেই কবরবাসীরা যেই হোক না কেন)। যেমন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : “কারো কবর জান্নাতের বাগানসমূহের মধ্যে একটি বাগান হবে অথবা জাহান্নামের আগুন ভরা গর্তের একটি হবে।” কবরে এমন মানুষ আছে যারা সাহায্যের জন্য চিৎকার করছে, কিন্তু সাহায্য করার কেউ নেই। যখন মুনকার ও নকীর এসে তাদের প্রশ্ন করে, “তোমাদের রব কে? তোমাদের দ্বীন কি? সেই নবী কে যাঁকে তোমাদের কাছে পাঠানো হয়েছিল?” তারা কোন উত্তর দিতে পারে না! [সহীহ আল বুখারী, দ্বিতীয় খণ্ড, ত্রয়োবিংশ পুসক্ত , ৪২২ নং হাদীস : আনাস কর্তৃক বর্ণিত : নবী বলেছেন, “যখন কোন মানুষকে কবরে শোয়ানোর পর তার সঙ্গীরা চলে যায় এবং তাদের পদধ্বনি শোনা যেতে থাকে, দুজন ফেরেশতা এসে তাকে বসিয়ে জিজ্ঞাসা করে : ‘মুহাম্মাদ সম্পর্কে তুমি কি বলতে?’ সে বলবে ‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে তিনি আল্লাহর বান্দা ও রাসূল।’ তখন তাকে বলা হবে, ‘জাহান্নামে তোমার জন্য তৈরি ঘরটি দেখ, এর পরিবর্তে আল্লাহ তোমাকে জান্নাতে একটি ঘর দিয়েছেন।’” নবী আরো বললেন, মৃত ব্যক্তি তার দুটো বাসস্থানই দেখতে পাবে। কিন্তু একজন অবিশ্বাসী বা মুনাফিক ফেরেশতাদের বলবে, ‘আমি জানি না, কিন্তু লোকে যা বলতো আমিও তাই বলতাম!’ তাকে বলা হবে, ‘তুমি জানতে না এবং তুমি হিদায়াত গ্রহণও করোনি (কুরআন পাঠের মাধ্যমে)।’ তারপর তাকে একটি লোহার হাতুড়ি দিয়ে দুই কানের মর্ধবর্তী স্থানে আঘাত করা হবে, এবং সে চিৎকার করবে, তার সেই চিৎকার মানুষ ও জ্বিন ছাড়া আর সবাই শুনতে পাবে।]

এসব প্রশ্নের উত্তর আমাদের জানা আছে কি নেই তাতে কিছু আসে যায় না, কারণ বিষয়টি সেটা নয়। পরবর্তী জীবনে লাঞ্ছনার অংশ হিসাবে আমরা প্রশ্নের উত্তর দিতে ব্যর্থ হব। আমরা জানি যে উত্তরটি হচ্ছে পরবর্তী জীবনের চাবি, কিন্তু চাবিটি আমরা ব্যবহার করতে জানি না। এ জীবনে আমাদের অন্তরে তা গ্রহণ করিনি, তাই পরবর্তী জীবনে আমাদের প্রবেশাধিকার নেই। যদি আমাদের হৃদয়ে এই বোধ এ জীবনে না আসে যে আল্লাহ আমাদের রব, মুহাম্মাদ আমাদের নবী এবং ইসলাম আমাদের দ্বীন, তাহলে এই জ্ঞান আখিরাতে আমাদের কাজে লাগবে না।তাই নারী-পুরুষ নির্বিশেষে আমাদের সকলকে এরই ভিত্তিতে কবর জিয়ারত করতে বলা হয়েছে, কারণ এর উপকারিতা শুধু পুরুষদের জন্য নয়, নারীদের জন্যও আছে। তবে নারীদের প্রকৃতির আবেগ প্রবণতার জন্য কিছু সংখ্যক আলেম বার বার জিয়ারত করতে নিষেধ করেছেন। যদিও তাদের কবর জিয়ারত করা নিষিদ্ধ নয়। তাই নিয়মিত না হলেও তাদেরও পুরুষের মতই মৃত্যুকে স্মরণের জন্য অনিয়মিত জিয়ারত করার প্রয়োজন রয়েছে। আখিরাতের স্মরণ যাদের উপর প্রভাব ফেলে আল্লাহ কুরআনে তাদের কথা বলেছেন। রাতেই এর প্রকাশ ঘটে।

“…তারা রাত্রিতে সামান্যই ঘুমাতো, রাতের শেষ প্রহরে তাদেরকে পাওয়া যেত ক্ষমা প্রার্থনারত অবস্থায়।” (সূরা আয যারিয়াত, ৫১:১৫-১৮)

পরবর্তী জীবন, কবরের পরীক্ষা এবং আসন্ন বিচারের চিন্তায় রাতে তারা জেগে ওঠে। তারা সেসময়ে তাদের বিছানা ত্যাগ করে যখন ঘুম সবচেয়ে মধুর ও গাঢ় হয়। ভাই ও বোনেরা, আসুন আমরা পরবর্তী জীবন নিয়ে চিন্তা করি। মৃত্যুর পর কি হয় তা নিয়ে চিন্তা করি ; মৃত্যুর সময়ে কি হয় তা নিয়ে-কিভাবে মু’মিনের দেহ থেকে রুহ নিয়ে যাওয়া হয়, যেমন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “পাত্রের নল দিয়ে পানির ফোঁটা যেভাবে করে পড়ে” ; কিন্তু অবিশ্বাসীদের জন্য, “কাঁটার উপর দিয়ে রেশমী কাপড় টেনে নিয়ে যাওয়ার মত”-ছিন্নভিন্ন করে। আল্লাহর ভয়ে ভীত রুহকে আসমানের উপরে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখানকার ফেরেশতারা তার প্রশংসা করে। পরে তাকে তার দেহে ফিরিয়ে দেওয়া হয় এবং জান্নাতের বাগানের একটি দরজা তার দিকে খুলে দেওয়া হয় পুনরুত্থান পর্যন্ত। কিন্তু যাদের অন্তত আল্লাহর স্মরণের ব্যাপারে কঠিন, তাদের আত্মা আসমানে আরোহণের সময় বাধাগ্রস্থ হবে। তার দেহে তাকে ছুঁড়ে ফেলা হবে। তাদের মন্দ কাজ কুৎসিত জীবের আকারে তাদের সামনে উপস্থিত হবে এবং তারা যন্ত্রণা ভোগ করবে। জাহান্নামের একটি জানালা তাদের দিকে খুলে দেওয়া হবে এবং পুনরুত্থান পর্যন-তারা সেই উত্তাপে দগ্ধ হবে। এবং পুনরুত্থান দিবসে কি ঘটবে যখন আমরা আল্লাহর সম্মুখে দণ্ডায়মান হয়ে আমাদের কৃত প্রতিটি কাজের জবাবদিহি করবো, যখন কিছুই আল্লাহর দৃষ্টি এড়াতে পারবে না, যখন জীবনের কোন কিছুই আমাদের কোন কাজে আসবে না? আল্লাহর সামনে দাঁড়ানোর সময় কেবল একটি জিনিসই আমাদের কাজে লাগবে, একটি সুস্থ হৃদয়।

তৃতীয় পদ্ধতিঃ কুরআন পাঠ

তৃতীয় যে উপায়ে আমরা আমাদের হৃদয়কে নরম করতে পারি, তা হচ্ছে কুরআন পাঠ আল্লাহ কুরআনে বলছেন :

“যারা মু’মিন, তাদের জন্য কি আল্লাহর স্মরণে এবং যে সত্য অবতীর্ণ হয়েছে, তার কারণে হৃদয় বিগলিত হওয়ার সময় আসেনি? তারা তাদের মতো যেন না হয়, যাদেরকে পূর্বে কিতাব দেয়া হয়েছিল। তাদের উপর সুদীর্ঘকাল অতিক্রান্ত হয়েছে, অতঃপর তাদের অন্তঃকরণ কঠিন হয়ে গেছে। তাদের অধিকাংশই পাপাচারী।” (সূরা হাদীদ, ৫৭ : ১৬)

যদি আমরা কুরআন নিয়ে গভীর চিন্তা করি, তা আমাদের হৃদয়কে বিগলিত করার ক্ষমতা রাখে। আলল্লাহ সেই জ্বিনের সম্পর্কে বলেছেন, যে কুরআন শুনেছিল,

“নিশ্চয়ই আমরা শুনেছি এক অত্যাশ্চর্য কুরআন ; তা আমাদের আল্লাহর দিকে পথ নির্দেশ করে এবং আমরা তাতে বিশ্বাস করি এবং আমরা আল্লাহর সাথে কোন শরীক করব না।” (সূরা আল-আহকাফ, ৪৬ : ২৯-৩২)

আল্লাহ সৎকর্মশীলদের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছেন : “যদি তারা (খৃস্টানদের মধ্য থেকে) শোনে যা নাযিল হয়েছে রাসূলের উপর, তুমি দেখবে তাদের চক্ষু অশ্রুপূর্ণ তারা যা সত্য বলে জানে তা আনয়নের জন্য।” ইথিওপিয়ার শাসকের অবস্থা ছিল তাই। যখন মুসলিমরা সেখানে আশ্রয় চেয়েছিল এবং কুরআনের এক অংশ পাঠ করে শুনিয়েছিল, তারা দেখেছিল তাঁর চোখ অশ্রুতে পরিপূর্ণ। আমাদের এমনই হওয়া উচিত। কুরআন শোনার সময় আমাদের এর অর্থের প্রতি লক্ষ্য রাখা উচিত। কুরআন যেন আমাদের কাছে পপ গান শোনার বিকল্প না হয়। মানুষ কণ্ঠস্বরে মুগ্ধ হয়ে প্রিয় তেলাওয়াতকারীর রেকর্ড কেনে। কুরআন শোনাটা যেন সঙ্গীত শোনার সমতুল্য হয়ে গেছে। আমরা এতে এতই মুগ্ধ যে যখন ক্বারী তেলাওয়াত করেন, পিছনের লোকজনকে বলতে শোনা যায় “আল্লাহ! আল্লাহ!” পপ শোতে যেমন হয়, মানুষ পিছনে নানা ধরনের কথাবার্তা বলতে থাকে। এটা কুরআন নয়…। আল্লাহ আমাদের বলেছেন, তারা কি এর অর্থের প্রতি লক্ষ্য করে না? কুরআন একটি পথ নির্দেশিকা এবং এর অর্থ অনুধাবন করেই আমরা এ থেকে উপকার পেতে পারি, এজন্য কুরআনকে আমরা কিভাবে ব্যবহার করি তা পুনরালোচনা করা উচিত। রমযানে পড়ার জন্য রেখে না দিয়ে নিয়মিত আমাদের কুরআন পাঠ করা উচিত। আমরা যেন গভীরভাবে চিন্তা করি… রমযানে সম্পূর্ণ কুরআন পড়ে শেষ করবার জন্য না পড়ি। রমযানে কুরআন খতম হলো কি না হলো তাতে কিছু যায় আসে না। বেশীর ভাগ রমযানে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কুরআন খতম করেন নি। অধিকাংশ সাহাবারাও করেন নি। বর্তমানে, কুরআন খতম ছাড়া আমাদের রমযান সম্পূর্ণ হয় না। আমরা হাফিজ ভাড়া করে আনি ৯৯ মাইল বেগে কুরআন তিলাওয়াতের জন্য, একজন আরবী ভাষী লোকের বুঝতে কষ্ট হয় যে কুরআনের কোন্‌ জায়গা হাফিজ পাঠ করছেন! এটাই নজীর হয়ে দাঁড়িয়েছে-রমযানে কুরআন খতম করা, পারলে দুবার! কিন্তু কুরআন এজন্য নয়। কুরআন চিন্তা-ভাবনা করার জন্য, যাতে যখন আমরা কুরআন শুনি তখন আল্লাহ যেমন বর্ণনা করেছেন তেমনি, মুমিনদের মত, তিলাওয়াত শুনে আমাদের শরীর যেন শিউরে উঠে। যা তাদের মন ছুঁয়ে যায় এবং হৃদয়ে কম্পন সৃষ্টি করে। (আযযুমার ৩৯ : ২৩)

যখন আমরা কুরআন শুনব, তখন তার প্রতিক্রিয়ায় আমাদের চোখে পানি না এলেও আমরা কান্নার চেষ্টা করবো। কারণ এভাবে কুরআনের ডাকে সাড়া দেওয়া উচিত। যদি আমরা তা না করি, আমরা ক্ষতিগ্রস্থ হব! এটা আল্লাহর কথা, যা আদম থেকে বর্তমান পর্যন্ত সমস্থ অবতীর্ণ গ্রন্থ মূহের মধ্যে একমাত্র সংরক্ষিত বাণী! এটা আল্লাহর সংরক্ষিত বাণী! কুরআন পাঠের সময় আমাদের বিশ্বাস রাখতে হবে যে আল্লাহ আমাদের সাথে কথা বলছেন, কারণ তা তাই। আল্লাহই সরাসরি আমাদের সাথে কথা বলছেন।

যখন তিনি ইহুদীদের সম্পর্কে আমাদের কিছু বলেন, আমরা সেটাকে শুধুমাত্র একটি তথ্য হিসাবে গ্রহণ করবো না যে ইহুদীরা এমন বা তারা তেমন ছিল। না! যখন আল্লাহ তাদের সম্পর্কে আমাদের কিছু বলেন, সেটা আমরা একটা সতর্কবাণী হিসাবে নেব-যাতে আমরা তাদের মতো না হয়ে যাই। আল্লাহ সূরা ফাতিহায় বলেছেন, “… গাইরিল মাগদুবি আলাইহিম ওয়া লা দ্বাল্লিন…”, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ব্যাখ্যা করেছেন যে আল-মাগদুবি আলাইহিম হচ্ছে ইহুদিরা এবং আদ-দ্বাল্লিন হচ্ছে খৃষ্টানরা। যাদের উপর আল্লাহ ক্রুদ্ধ তারা ইহুদী এবং যারা পথভ্রষ্ট, তারা খৃষ্টান। ইহুদিদের উপর আল্লাহ এ কারণে ক্রুদ্ধ যে তারা সত্যকে জানে কিন্তু মেনে চলে না। তোমরা মানুষকে সৎকর্মের প্রতি আহ্বান জানাও কিন্তু নিজেরা তা করতে ভুলে যাও। তারা কিতাবের পরিবর্তন করেছিল। খৃষ্টানদের সঠিক জ্ঞান ছিল না, তারা ছিল বিভ্রান-। তারা মনে করে আল্লাহ একজন মানুষ! এটা আমাদের জন্য সাবধানবাণী। যখনই আমরা এই আয়াতগুলি পাঠ করি, আল্লাহ আমাদের সতর্ক করে দেন যেন আমরা তাদের মত না হই-আমাদের কাছে সত্য আছে, কিতাব আছে, কিন্তু আমরা তা অনুসরণ করি না। আমরা যদি জ্ঞান অনুসন্ধান না করি, জানতে চেষ্টা না করি আল্লাহ আমাদের কাছে কি চান, তাহলে আমরা পথভ্রষ্ট হয়ে যাব। যখনই আমরা পড়ি “… গাইরিল মাগদুবি আলাইহিল ওয়া লা দ্বাল্লিন.. এটা যেন আমাদের স্পর্শ করে। আমরা যেন চিন্তা ভাবনা করি এ নিয়ে। সারা কুরআনে ছড়িয়ে থাকা বহু আয়াত আমাদের আখিরাতের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, বিচার দিনের লক্ষণগুলি মনে করিয়ে দেয়। কুরআনের যে কোন অংশ খুলে পড়লেই আমরা তা জানতে পারব। প্রায় প্রতিটি অধ্যায়েই আল্লাহ পরবর্তী জীবনের কথা বলেছেন। যা অন্তরের নম্রতা অর্জনের দ্বিতীয় উপায়ের সাথে সম্পর্কিত-কবর জিয়ারত করা এবং আখিরাতকে স্মরণ করা। কুরআন তা নিয়ে চিন্তা করতে বলে।

চতুর্থ পদ্ধতিঃ সৎকর্ম

হৃদয় নরম করার চতুর্থ পথ হলো সৎকর্মের মাধ্যমে। আল্লাহর জন্য বিশ্বস্তভাবে যে সৎকর্ম করা হয়, তা হৃদয়কে বিনীত করে। প্রাথমিক পর্যায়ে আমরা হয়তো তা বুঝতে পারবো না, কিন্তু আমাদের আস্থার সাথে লেগে থাকতে হবে। যেমন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আল্লাহ কর্তৃক অবশ্যকরণীয় কাজগুলো সম্পাদনের মাধ্যমে বান্দা তাঁর যতটা নিকটবর্তী হয়, ততটা আর কোন কিছুতে হয় না। সেগুলো হচ্ছে প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত সালাত, রোযা ইত্যাদি। প্রার্থনার সময় প্রায়ই আমাদের মনে হয়, “কি লাভ হচ্ছে? পরিবর্তন কোথায় হচ্ছে?” আমাদের বুঝতে হবে যে লেগে থাকতে পারলে উপকার পাওয়া যাবে। তাৎক্ষণিক ফলাফল হয়তো পাওয়া যাবে না। এটা একটা ধারাবাহিক ব্যাপার, অনেকটা একজন মানুষের বেড়ে ওঠার মতো। বাচ্চারা চিন্তা করে কখন তারা বড় হবে এবং দেওয়ালে দাগ দিয়ে রাখে এই আশায় যে একদিন ততটুকু লম্বা হবে। তারা নিজেদের বেড়ে ওঠাকে বুঝতে পারে না, কারণ সেটা ঘটছে তাদের শরীরের অভ্যন্তরে।

সৎকর্মের ব্যপারেও একই কথা… এবং প্রথম সৎকর্ম হচ্ছে যা আল্লাহ আদেশ করেছেন। প্রাথমিক অবশ্যকরণীয় কাজগুলি ত্যাগ করে অন্য কাজে আমাদের লিপ্ত হওয়া যা আল্লাহ আমাদের করতে বলেননি, একটি ভুল পদক্ষেপ। আমরা যদি প্রতিদিন যথাসময়ে পাঁচবার সালাত প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হই, তাহলে আমরা আর যা কিছুই করি না কেন তাতে কিছু যায় আসে না। সেটা অর্থহীন। এটা ভিত্তি-যদি আমরা আল্লাহ যা করতে বলেছেন, যা আমাদের কাছে দাবী করছেন তা করতে না পারি, তবে কিভাবে অন্য কিছু করে আমরা তাঁকে খুশি করতে পারি? অর্থাৎ তখন আল্লাহকে আমরা নিজের মত করে খুশি করতে চাই-যা আমাদের খুশি করে তাই আল্লাহকে খুশি করবে। এটা আল্লাহকে খুশি করা নয়।

আমাদের মনে রাখতে হবে যে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “জাহান্নামের আগুনকে আমাদের পছন্দনীয় বস্তু দ্বারা পরিবেষ্টন করা হয়েছে এবং জান্নাতকে আমাদের অপছন্দনীয় কাজ দ্বারা পরিবেষ্টন করা হয়েছে।” “যা আমাদের অপছন্দনীয়” বলতে যে মন্দ কিছু বোঝাচ্ছে তা নয়, এগুলো তাই যা আমাদের নফস করতে পছন্দ করে না, কারণ এতে পরিশ্রম ও চেষ্টার প্রয়োজন। আমরা সহজ কিছুই পছন্দ করি। সুতরাং সালাত আমাদের অপছন্দনীয় এবং কেউ যদি বলতো যে সালাতের দরকার নেই, আমরা খুশি হয়ে আলহামদুলিল্লাহ উচ্চারণ করতাম। এটা আমাদের স্বভাব, এতে আমরা খুশি হই। কিন্তু আমাদের দুঃখ হওয়া উচিত এজন্য যে আমরা শুধু এ জীবনেই সালাত আদায়ের সুযোগ পাব, পরবর্তী জীবনে নয়। সালাত আমাদের কাজে লাগবে এখানেই। পরবর্তী জীবনে আমরা সালাত আদায় করতে চাইব, আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করবো। আল্লাহ তাদের বর্ণনা দিয়েছেন যাদেরকে বিচারের জন্য তাঁর সামনে আনা হবে :

"যখন তারা তাদের কর্মসমূহ দেখবে এবং জানবে যে তারা নিজেদেরকে জাহান্নামে পাঠানোর জন্য তৈরি করেছে। তারা কি করবে? তারা কি আল্লাহর সাথে তর্ক করবে কেন তাদের জাহান্নামে পাঠানো হবে? না, তারা আল্লাহর কাছে আরেকবার দুনিয়ায় ফিরে যাওয়ার সুযোগ পেতে চাইবে, যাতে তারা সেখানে গিয়ে আল্লাহর নির্দেশিত সৎকাজ করতে পারে এবং আরো বেশি করে "(সূরা আ’রাফ, ৭ : ৫৩)।

কিন্তু আল্লা জানেন যে তারা মিথ্যা বলছে, তারা তাই করবে যা তারা আগে করেছে। কারণ যদি আল্লাহ আমাদের আবার দুনিয়াতে ফেরৎ পাঠান, তাহলে নবলব্ধ এই সচেতনতা ও জ্ঞান সহ পাঠাবেন না। আমরা আগে যা ছিলাম তেমনি ভাবেই পাঠাবেন। সালাত হচ্ছে আমাদের উপকারের জন্য। এতে করে আমরা আল্লাহকে উপকৃত করছি না। যদি পৃথিবীর সমস্থ মানুষ সালাত আদায় করতো, তা আল্লাহর কোন উপকারে আসতো না। তেমনি কেউ যদি সালাত আদায় না করতো, তাতে আল্লাহর কোন ক্ষতি বা হ্রাস ঘটতো না। সালাত আমাদের নিজেদের জন্য। সেজন্যই নবী সাল্লাল্লাহু ওয়া সাল্লাম বলতেন, “বেলাল, আযানের মাধ্যমে আমাদের শান্তি দাও।” সালাতকে আনন্দের সময় বলে বিবেচনা করা হয়, অথচ আমাদের কাছে তা বোঝা মাত্র। যত তাড়াতাড়ি তা আদায় করা যাবে, ততই ভাল, তাহলে আমরা আবার আমাদের জীবনের ব্যস্ততায় ফিরে যেতে পারব। এটা একটা ভুল…আমাদের অন্তর কঠিন হয়ে গেছে। ইহুদিদের সম্পর্কে আল্লাহ বলেছেন :

"তাদেরকে সমস্থ নিদর্শন দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু সময়ের সাথে সাথে তাদের হৃদয় কঠিন হয়ে গেছে। আমাদের হৃদয়ও কঠিন হয়ে গেছে। আমরা ইসলাম গ্রহণ করেছি, আমরা ইসলামের প্রতি সজাগ হয়েছি এবং ইসলামের বিধি নিষেধ মেনে চলার চেষ্টা করছি, কিন্তু সময়ের সাথে সাথে আমাদের হৃদয় কঠিন হয়ে গেছে। "(সূরা হাদীদ, ৫৭ : ১৬)

সালাত আমাদের কাছে আনন্দদায়ক না হলেও আমাদের চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে এবং বুঝতে হবে যে এটাই স্বাভাবিক। ঈমান বাড়ে ও কমে। অন্তর কঠিন হয়ে যায় এবং আমরা তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করি ও তা নরম হয়… মৃত্যু পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে এই সংগ্রাম চলবে। আমরা শুধু এই দুআ করি যেন আমরা ভীত ও বিনীত হৃদয় সহ মৃত্যুবরণ করতে পারি। আমরা সংগ্রাম করতে থাকব এবং এর মাঝেই ঈমানের স্বাদ পাব, সালাত আদায়ের বিধান কেন দেওয়া হয়েছে তা বুঝতে পারব, আমাদের জীবনে আল্লাহর স্মরণ বলতে কি বোঝায় তা উপলব্ধি করতে পারব। নবী সাল্লাল্লাহু ওয়া সাল্লাম তাদের কথা বলেছেন, যারা কিয়ামতের দিন আল্লাহর আরশের ছায়ায় আশ্রয় পাবে-যেদিন কোথাও কোন ছায়া থাকবে না : তারা হচ্ছে যারা আল্লাহর স্মরণে কাঁদে, তাদের হৃদয় বিনম্র। [বুখারী, অষ্টম খণ্ড, পুসিক- া ৭৬, ৪৮৬ নং হাদীস : আবু হুরায়রা কর্তৃক বর্ণিত : নবী বলেছেন, “আল্লাহ সাতজনকে পুনরুত্থান দিবসে তাঁর ছায়ায় আশ্রয় দেবেন। তাদের অন্যতম হচ্ছে সে যে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং তার চোখ অশ্রুতে ভেসে যায়।”] [বুখারী, প্রথম খণ্ড, একাদশ পুস্তিকা ৬২৯ নং হাদীস : আবু হুরায়রা কর্তৃক বর্ণিত : নবী বলেছেন : “আল্লাহ সাতজনকে তাঁর ছায়ায় আশ্রয় দেবেন সেই দিন, যেদিন তাঁর ছায়া ছাড়া আর কোন ছায়া থাকবে না। (এই সাতজন হলো) ন্যায়পরায়ণ শাসক, সেই যুবক যে আল্লার ইবাদতের মধ্যে বড় হয়েছে (অর্থাৎ শিশুকাল থেকে বিশ্বস্তভাবে আল্লার ইবাদত করছে), সেই ব্যক্তি যার অন্তর মসজিদের সাথে লেগে থাকে (অর্থাৎ জামাতে সালাত আদায়ের জন্য ব্যাকুল থাকে), সেই দুই ব্যক্তি যারা পরস্পরকে আল্লাহর জন্য ভালবাসে এবং তারা আল্লাহর জন্যই পরস্পর মিলিত হয় এবং বিচ্ছিন্ন হয়, এমন এক ব্যক্তি যে কোন সুন্দরী উচ্চবংশীয়া মহিলার আহ্বানকে উপেক্ষা করে এই বলে : আমি আল্লাহকে ভয় করি, এমন ব্যক্তি কে এত গোপনে দান করে যে তার ডান দান করলে বাঁ হাত সেটা জানতে পারে না (অর্থাৎ কেউ জানে না সে কত দান করেছে), এবং সে ব্যক্তি যে নির্জনে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং তার চোখ অশ্রুসিক্ত হয়।”]

সুতরাং সৎকাজ থেকে আমরা দূরে থাকব না, যা আমাদের অন্তর কে বিনম্র করবে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন যে, হাসিমুখে মুসলিম ভাই বোনদের সম্ভাষণ জানানো হচ্ছে সাদকা। কোন কাজকেই আমরা ছোট মনে করবো না, কোন সৎকাজই ছোট নয়। আমরা যে কোন ভাল কাজ করার চেষ্টা করবো। কিন্তু প্রথমে আমরা সেসব কাজ দিয়ে শুরু করবো যা আল্লাহ আমাদের জন্য বাধ্যতামূলক করেছেন। যেভাবে আল্লাহ বলেছেন সেভাবে আমরা সালাত প্রতিষ্ঠা করবো, যেভাবে দেওয়া উচিত সেভাবে যাকাত দেবো, রোযা রাখবো যেভাবে রাখা উচিত এবং সক্ষম হলে হজ্ব ও ওমরা পালন করবো। এই মৌলিক বিষয়গুলো আল্লাহর উদ্দেশ্যেই প্রতিষ্ঠা করতে হবে, এগুলোই আমাদের অন্তর বিনম্র করার ভিত্তি। এই কাজগুলো নিয়মিত করা এবং এর সাথে আরও অতিরিক্ত কিছু করার মাধ্যমে আমরা ক্রমান্বয়ে আল্লাহর কাছে আসতে পারবো, তখন আল্লাহর বক্তব্য অনুসারে তাঁর চোখ আমাদের চোখ হয়ে যাবে যা দিয়ে আমরা দেখবো, বাস্তবে আমরা কেবল এতটুকুই দেখয যা আল্লাহ চান যে আমরা দেখি। আমরা আল্লাহ যা পছন্দ করেন না তা দেখা হতে বিরত থাকবো, আমরা কেবল ততটুকুই নেব যা আল্লাহ চান, সেখানেই যাব যেখানে আল্লাহ চান যে আমরা যাই…। যদি আমরা আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তন করি ও আল্লাহকে ডাকি, তিনি আমাদের ডাক শুনবেন। এটা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওয়াদা।

আমার ভাই ও বোনেরা, আমি আপনাদের ও আমার নিজেকে আহ্বান জানাই আমাদের অন্তরের কথা স্মরণে রাখতে, আমাদের হৃদয়ের অবস্থান নিয়ে চিন্তা করতে। যখন আমরা সময় পাই আমরা যেন প্রশ্ন করি, আমাদের অবস্থা কি? যাতে আমরা আমাদের হৃদয়কে নরম করার কাজে সফল হতে পারি আল্লাহর রহমত ও ক্ষমার মাধ্যমে। আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তনের মাধ্যমে আমরা এই কাজ শুরু করবো। আজ রাত্রের পরবর্তী সালাতে, আসুন আমরা আল্লাহর দিকে ফিরি ও আন্তরিকভাবে আমাদের হৃদয়ের কোমলতার জন্য দুআ করি। এতে যদি আমরা বিশ্বস্ত হই, আমাদের অন্তর বিগলিত হতে থাকবে। এটা রাসূলুলল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এঁর ওয়াদা। আমাদের উচিত কুরআন পাঠ করা ও যথাসম্ভব সৎকাজ করা। কবর জিয়ারতের মাধ্যমে ও তাদের জন্য নির্ধারিত দুআ পাঠ করে ও পরবর্তী জীবন সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যা কিছু বলেছেন তা পড়ে আমাদের উচিত আখিরাতের চিন্তায় গভীর মনোনিবেশ করা। আমি আগে যেমন বলেছি, এরপরও যদি আমরা আমাদের অন্তরের কোমলতার সন্ধান না পাই, আমরা কাঁদতে চেষ্টা করবো। আমরা জোর করেই কাঁদতে চেষ্টা করবো যাতে আমরা আমাদের ভিতরের অনুভূতিগুলোকে সরিয়ে দিতে ও মুক্ত করে দিতে পারি, তা নাহলে অন্তর নরম হবে না।

সুতরাং আমি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি ও চাই যে আল্লাহ যেন আমাদের সকলকে কোমল হৃদয় দান করেন, যে হৃদয় আল্লাহর সৃষ্টির প্রতি, আমাদের সন্তানদের প্রতি, আমাদের পিতামাতার প্রতি, মুসলিম ভাই ও বোনদের প্রতি করুণায় ভরা থাকবে… এমনকি যারা মুসলিম নয় তাদের প্রতিও। আমি অমুসলিমদের জন্য আমাদের হৃদয়ে কোমলতা এজন্য চাই যেন আমরা তাদের কাছে যথাযথভাবে হেদায়েতের বাণী পৌঁছাতে পারি। আল্লাহ যেন আমাদের তাঁর কুরআনের দিকে ফিরে আসার ও নিয়মিত তা পাঠ করার, তা বোঝার ও তা থেকে হেদায়েত গ্রহণ করার তাওফীক দেন এবং আমাদের বিনম্র অন্তর দান করেন। আসসালামু আলাইকুম।

মূলঃডঃ আবু আমিনাহ বিলাল ফিলিপস

হালালও হারাম সম্পর্কিত একটি বিখ্যাত হাদীসেমুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহুআলাইহিওয়া সাল্লাম অন্তেরর গুরুত্ব সম্পর্কে আমাদের জানিয়েছেন। তিনিবলেছেন :

আমাদেরশরীরে এমন একটি মাংস পিণ্ড রয়েছে যা সুস্থ থাকলে সারা শরীরসুস্থ থাকে আরযা অসুস্থ হলে সারা শরীর অসুস্থ হয়ে পড়ে। সেটি হচ্ছেহৃদয়।” [সম্পূর্ণ হাদীসটি হচ্ছে : আন-নুমান বিন বাশীর কর্তৃক বর্ণিত :আমি আল্লাহ'র রাসূলকে বলতে শুনেছি, “হালালও হারাম উভয়েই স্পষ্ট, কিন্তু এদুটির মাঝখানে রয়েছে সন্দেহজনকবিষয়সমূহ যা অধিকাংশ লোকই জানেনা।সুতরাং যে নিজেকে সন্দেহজনক বিষয় থেকেবাঁচিয়ে চলে, সে তার দ্বীন ওসম্মানের সংরক্ষণ করে।

আরযে সন্দেহজনক বিষয়ে জড়িয়ে পড়ে, তার উদাহরণ হচ্ছে সেই রাখালের মতযেতার মেষপাল চরায় কোন সংরক্ষিত চারণভূমির কাছাকাছি এমন ভাবে যে, যেকোনমুহূর্তে সে তাতে প্রবেশ করবে। (হে লোকসকল!) সাবধান! প্রত্যেকবাদশাহরইএকটি সংরক্ষিত সীমানা আছে এবং আল্লাহর সংরক্ষিত সীমানা হচ্ছেতাঁর নিষিদ্ধবিষয়সমূহ। সাবধান! আমাদের শরীরে এমন একটি মাংস পিণ্ড রয়েছেযা সুস্থ (পরিশুদ্ধ) থাকলে সারা শরীর সুস্থ থাকে, কিন্তু যদি তা কলুষিতহয়ে যায়সারা শরীর কলুষিত হয় এবং সেটি হচ্ছে হৃদয়।”] (ইংরেজী বুখারী, প্রথমখণ্ড, ৪৯ নং হাদীস)

কথাটিতিনি বলেছেন, প্রথমে একথা ব্যাখ্যা করার পর যে হালাল স্পষ্ট, হারামওস্পষ্ট এবং এদের মাঝখানের ক্ষেত্রটি অস্পষ্ট যা অনেকেই জানেনা।যাহোক, যাএকজন মানুষকে হারাম থেকে বাঁচতে ও হালাল অবলম্বন করতে সাহায্যকরে তা হচ্ছেজ্ঞান ; এবং জ্ঞান ছাড়া আর যা একাজটি করতে পারে, তা হচ্ছেঅন্তেররঅবস্থা। যদি অন্তর পরিশুদ্ধ হয়, জ্ঞানকে ব্যবহার করে তা হারামএড়িয়েচলতে পারে। যদি তা কলুষিত হয়, জ্ঞান কোন উপকারে আসে না এবং মানুষনিষিদ্ধবিষয়ে জড়িয়ে পড়ে।

বিদায়হজ্বে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর সাহাবাদের ওঅনাগতমুসলিম জাতিসমূহের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন যে, কোন অনারবের উপর কোনআরবেরশ্রেষ্ঠত্ব নেই ; কালোর উপর সাদার কোন প্রাধান্য নেই, কিন্তুআল্লাহরদৃষ্টিতে সেই শ্রেষ্ঠ যে আল্লাহকে ভয় করে যে তাকওয়া অর্জনকরেছে। এ বিষয়ে সাক্ষ্য দেওয়ার পর তিনি বলেন, “তাকওয়ার অবস্থান হচ্ছেআমাদের অন্তের।এটি এবং অনুরূপ আরো বক্তব্যে অন্তেরর উপর গুরুত্ব আরোপ করাহয়েছে যাকে আল্লাহ তাঁর সৃষ্ট অন্য সব অঙ্গের উর্ধ্বে স্থান দিয়েছেন।

ঈমানেরঅবস্থান এখানেই। শরীরের অন্য কোন অঙ্গ যদি আল্লাহর আরো কাছেরহতো, তাকওয়াসেখানেই অবস্থান করতো, কারণ মানুষের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদহলো ঈমান। এছাড়া আর কিছুরই মূল্য নেই। যারা আল্লাহকে বিশ্বাস করে, যারাতাঁর বাণীগ্রহণ করেছে এবং যারা জান্নাতকে জাহান্নামের পরিবর্তে বেছেনিয়েছে ঈমান তাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য। ঈমান বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসীর মধ্যেপার্থক্য।দুনিয়ার সব কিছুর চেয়ে ঈমানের মূল্য বেশী। সেজন্য আল্লাহররাসুলমুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যে কোন একজনমানুষকেওইসলামের পথ দেখানো দুনিযার সব কিছুর চেয়ে উত্তম। কারো জন্য অন্যকাউকেঈমান অর্জনে সাহায্য করা যে কোন পার্থিব বস্তুর চেয়ে মূল্যবান।

কাজের শুদ্ধতার বিচার করা হয় হৃদয়ের অবস্থা দিয়ে। নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্ললাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন যে :

কর্মের বিচার করা হয় নিয়ত অনুসারে।নিয়ত বা ইচ্ছার স্থান ঠোঁটেনয়, হৃদয়ে। [হাদীসটির পূর্ণ বক্তব্য : উমর বিন খাত্তাব বর্ণনা করেছেন :আল্লাহর রাসূল বলেছেন, “কর্মফলনিয়তের উপর নির্ভরশীল এবং প্রত্যেকই তাপাবে যা সে চেয়েছে। অতএব, যেআল্লাহ ও তাঁর রাসূলের জন্য হিজরত করেছে, তার হিজরত আল্লাহ ও তাঁর রাসূলেরউদ্দেশ্যেই। আর যে কোন পার্থিব স্বার্থঅর্জন বা কোন মহিলাকে বিয়েরউদ্দেশ্যে হিজরত করেছে, তার হিজরত সে জন্যইযে জন্য সে হিজরত করেছে।”] (বুখারী, প্রথম খণ্ড, ৫১ নং হাদীস)

আমরাযে কাজই বাহ্যিকভাবে করি না কেন, আমাদের হৃদয়ের অবস্থা তখন কিছিল, তাদিয়েই তার বিচার হবে। এগুলি হচ্ছে ভাল কাজ। মন্দ কাজ মন্দই, কিন্তু ভালকাজ বলতে আমরা যা বুঝি তা সেসব কাজ যা ন্যায়পরায়ণতারঅবিচ্ছেদ্য অংশ।আল্লাহ বিচার করবেন সত্যিই সেগুলি ন্যায় কাজ কিনা।

মুহাম্মাদসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের জানিয়েছেন যেপ্রথম যে তিনব্যক্তিকে জাহান্নামের আগুনে ফেলা হবে তারা মানুষের দৃষ্টিতেবড় বড়কল্যাণকর কাজে লিপ্ত ছিল। তারা হচ্ছে জ্ঞানের প্রচারে নিয়োজিতআলেম, ধনীব্যক্তি যে তার সম্পদ থেকে দান করতো এবং আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধকরেশাহাদাৎ বরণকারী। একটি সহীহ হাদীসে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়াসাল্লাম বলেছেন যে তারা প্রথম জাহান্নামে নিক্ষিপ্তদের অন্তর্ভূক্তহবে।কারণ সেই আলেম আল্লাহর সন্তুটির জন্য জ্ঞান প্রচার করতো না, করতোমানুষেরকাছে বড় একজন জ্ঞানী হিসাবে সম্মান ও প্রশংসা পাওয়ার জন্য। আলাহতাকেবলবেন : দুনিয়াতে তুমি যা চেয়েছিলে সেই প্রশংসা তুমি পেয়ে গেছো, আখিরাতে তোমার জন্য কিছু নেই।তারপর তাকে উপুড় করে টেনে নিয়েজাহান্নামে ফেলে দেওয়া হবে। একইভাবে ধনীলোকটিও তার ধন-সম্পদ উদার হস্তেদান করতো যাতে লোকে তাকে মহান দাতা হিসাবেপ্রশংসা করে। কিন্তু আল্লাহবলবেন, “তুমিপ্রশংসার জন্য দান করেছ এবং তা পেয়েছো। তুমি বিশুদ্ধভাবেআল্লাহর জন্য তাকরনি। যতক্ষণ লোকে প্রশংসা করেছে, তুমি বদান্যতাদেখিয়েছো, কিন্তু লোকেযখন তোমার প্রতি মনোযোগ দেয়নি, তুমিও দান করাবন্ধ করে দিয়েছ। তোমারবদান্যতা ছিল শর্তযুক্ত, আলাহর সন্তুষ্টির জন্যনয়।অতঃপর তাকে উপুড় করে টেনে নিয়ে জাহান্নামে ফেলে দেওয়া হবে। আর যেআল্লাহর রাস্তায় শহীদ হয়েছিল, আল্লাহ তাকে বলবেন : তুমি এজন্য যুদ্ধকরেছো যে লোকে তোমাকে বলবে কত বড় একজন শক্তিশালী ও বীর যোদ্ধা তুমি!লোকেতার প্রশংসা করেছে, কিন্তু সে আল্লাহর জন্য যুদ্ধ করেনি, সুতরাং তাকেউপুড় করে টেনে নিয়ে গিয়ে জাহান্নামে ফেলে দেওয়া হবে।

এসবকিছুই আমাদের এই শিক্ষা দিচ্ছে যে যদি হৃদয় অসুস্থ হয়, দুর্নীতিগ্রস্তহয়, বড় বড় সৎকর্মও কোন কাজে আসবে না। সুতরাং হৃদয়েরপ্রতি আমাদের গভীরমনোযোগ দেওয়া উচিত। নিজেদের হৃদয়ের অবস্থা সম্পর্কেসচেতন হওয়া ওপর্যবেক্ষণ করার জন্য আমাদের প্রচুর সময় দিতে হবে। যখনমুহাম্মাদসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আবু বকর সিদ্দীকের উচ্চমর্যাদা সম্পর্কেমানুষকে বলছিলেন, তিনি বলেছিলেন;

সেতোমাদের চেয়ে বেশী সালাত আদায় করে না বা রোযা রাখেনা, তোমাদেরঅনেকেইতার চেয়ে বেশী সালাত আদায় কর ও রোযা রাখ, কিন্তু তার হৃদয়ে এমনকিছু আছেযা গভীরভাবে প্রোথিত তা হচ্ছে তার হৃদয়ে অবস্থিত ঈমান।

এখানেইছিল তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব। অতএব একজন মুমিনের কাছে মানব শরীরে ওঅস্তিত্বে আরকোন যোগ্যতা থাকতে পারে না যে সম্পর্কে সে আরো অধিক সচেতনহবে। আল্লাহযেভাবে চান সেভাবে এই দক্ষতা/যোগ্যতা ক্রিয়াশীল করারব্যাপারে নিশ্চিত হতেহবে। এ সম্পর্কে আমাদের খুব বেশী সচেতন হতে হবে।মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহুআলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রায়ই দুআ শুরু করতেন এভাবে :

হে আল্লাহ, আমি তোমার কাছে আশ্রয় চাই এমন জ্ঞান থেকে যা উপকারী নয় এবং এমন হৃদয় থেকে যা ভীত নয়।

মুহাম্মাদসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অত্যন্ত কোমল হৃদয়েরঅধিকারী ছিলেন।তিনি মানুষের সাথে খুবই নম্র ব্যবহার করতেন। তাঁর স্ত্রীরাবলেছেন যে তাঁরাএমন কোন ঘটনার কথা মনে করতে পারেন না যেখানে তিনি তাঁদেরসাথে কর্কশভাষায় কথা বলেছেন বা তাঁদের আঘাত করেছেন। তিনি তাঁর নম্রতারজন্য সুপরিচিতছিলেন। এবং আল্লাহ এই গুণটিকে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বলেউল্লেখ করেছেন।সূরা আলে-ইমরানে আল্লা বলেছেন :

فَبِمَا رَحْمَةٍ مِّنَ اللَّهِ لِنتَ لَهُمْۖ وَلَوْ كُنتَ فَظًّا غَلِيظَ الْقَلْبِ لَانفَضُّوا مِنْ حَوْلِكَ

আল্লাহর দয়ার কারণেই তুমি তাদের সাথে নম্র। যদি তুমি রূঢ় ওকঠিন-হৃদয় হতে, তাহলে তারা তোমার কাছে থেকে দূরে সরে যেতো।” (সূরাআলে-ইমরান, ৩ : ১৫৯)

নবীদেরবৈশিষ্ট্য ছিল এটাই এবং এই বৈশিষ্ট্য তাদেরও অবশ্যই অর্জন করতেহবে যারামানুষকে আল্লাহর পথ দেখায়। যেহেতু নবীদের জন্য এই গুণটিআবশ্যকীয়, এটিআমাদের জন্যও আবশ্যকীয়। যারা জ্ঞানের সন্ধানী তাদের জন্যএটি দরকারী, সবমানুষের জন্যই এটি দরকারী। আর পিতামাতার জন্যওছেলেমেয়েদের প্রতিকোমল-হৃদয় হওয়া বাঞ্ছনীয়।

হৃদয়েরকোমলতা এমন একটি বিষয় যাতে আমরা প্রচুর সময় দিলেও যথেষ্ট হবেনা। একবারনবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল-আকরা বিনহারিস এরবাড়িতে গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি তার একটি বাচ্চাকে কোলে বসিয়েআদর করেচুমা দিলেন। আল-আকরা বলল : আমার আরও দশটি ছেলেমেয়ে আছে, কিন্তুআমি কখনো তাদের কাউকে চুমা দেইনি।এটি ছিল একটি গর্বের বিষয়, পৌরুষ যাকোমল নয়, কঠোর। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে বললেন, আল্লাহ যদি তোমার অন্তর থেকে দয়ামায়া সরিয়ে নিয়ে থাকেন, তাহলে আমার কি করার আছে!তিনি আরো বললেন, যে অন্যকে দয়া করে না সে দয়া পাবে না।সুতরাং বাচ্চাদের প্রতি কোমল আচরণ করা পিতামাতার জন্য জরুরী। যে ঘরে বাবাছেলেমেয়েদের প্রতি দয়ালু ও ক্ষমাশীল, সে ঘর সুখ ও আনন্দে ভরা থাকে।

দয়াএমন কিছু যা ছাড়া আমরা বাঁচতে পারি না। যারা জ্ঞানের সন্ধানী, যেহেতুদ্বীনের জ্ঞান অর্জন করা আমাদের জন্য বাধ্যতামূলক, জ্ঞানের সাথেযদি সেকোমল হৃদয়ের অধিকারী না হয়, তবে জ্ঞানের সৌন্দর্য্য উপভোগ করাসম্ভব হয়না। যেমন হাসান আল-বসরী বলেছেন, “যদি কেউ জ্ঞান অনুসন্ধান করে, তা তার চেহারা, হাত ও জিহবায় এবং আল্লাহর প্রতি তার বিনয়ে প্রকাশ পাবে।এর বিপরীত কথাটিও সত্য যে কোন কিছুই জ্ঞানকে এবং দ্বীনের প্রতি আহ্বানেরকাজকে ততটা নষ্ট করে না যতটা করে হৃদয়ের কাঠিন্য। যেখানে হৃদয় কঠিন হয়েযায়, সেখানে জ্ঞান ব্যক্তির নিজেরও কোন উপকারে লাগে না বা সে তা দিয়েঅন্যেরও উপকার করতে পারে না।

হৃদয়েরকোমলতা সত্যিকার মুসলিমের বৈশিষ্ট্য। এর অনুপস্থিতিতে জীবনদুর্ভোগ ওঅস্বচ্ছান্দ্যে ভরে যায়। এটা আল্লাহর ওয়াদা। যাদের হৃদয় কোমলনয় তারাদুর্ভোগময় জীবন যাপন করবে। যেমন সূরা আয-যুমারে আল্লাহ বলেছেন :

فَوَيْلٌ لِّلْقَاسِيَةِ قُلُوبُهُم مِّن ذِكْرِ اللَّهِۚ أُولَٰئِكَ فِي ضَلَالٍ مُّبِينٍ

(সে কি তার সমান, যে এরূপ নয়) যাদের অন্তর আল্লাহ স্মরণের ব্যাপারে কঠোর, তাদের জন্যে দূর্ভোগ। তারা সুস্পষ্ঠ গোমরাহীতে রয়েছে।” (সূরা আয-যুমার, ৩৯ : ২২)

তারাসুস্পষ্ট পথভ্রষ্টতার মধ্যে রয়েছে। তাদের জন্য দুর্ভোগ যারাকুরআন শ্রবণকরে কিন্তু তারপরও তারা ভীত ও বিনীত হয় না। দুর্ভোগ তাদেরজন্য যাদেরচোখকে আল্লাহর কথা স্মরণ করিয়ে দিলেও আল্লাহর ভয়ে তা ক্রন্দনকরে না।দুর্ভোগ তাদের জন্য যাদের কাছে আল্লাহর সতর্কবাণী পৌঁছানোর পরওতারা তাঁরবাণীর প্রতি শ্রদ্ধাবনতও হয় না। কঠিন-হৃদয় বিশিষ্ট হওয়া একটিঅভিশাপ আরহৃদয়ের নম্রতা সৌভাগ্যের কারণ। জীবনের সমস্ত কাম্য বস্তুরঅধিকারী হলেওকঠিন হৃদয়-সম্পন্ন ব্যক্তি কষ্ট ভোগ করে। আপাত দৃষ্টিতেসুখময় মনে হলেওতা এক শূন্য জীবন একাকীত্বে পূর্ণ। তারা মনে এবংঅন্তের শান্তি পায় না, কারণ তাদের অন্তর আল্লাহর প্রতি কঠিন আল্লাহকেবিশ্বাসের ব্যাপারে ও তার আনুগত্যের ব্যাপারে। সেজন্যই আল্লাহবলেছেন, যেতাঁর স্মরণ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে সে দুদর্শাগ্রস্ত জীবন যাপনকরবে।

“… যে আমার বাণী থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে তার জন্য রয়েছে সংকীর্ণ জীবন, আর বিচার দিবসে আমরা তাকে উত্থিত করবো অন্ধ করে।” (সূরা তা-হা, ২০ : ১২৪)

এবং তিনি (সুবহানাহু ওয়া তাআলা) বলেছেনম একমাত্র আল্লাহর স্মরণেই হৃদয় শান্ত হয়।

যারা বিশ্বাস করে, এবং যাদের হৃদয় আল্লাহর স্মরণে তৃপ্তি লাভ করে :নিঃসন্দেহে আল্লাহর স্মরণেই হৃদয়সমূহ শান্তি লাভ করে।”(সূরা রা, ১৩ :২৮)

জীবনে সবচেয়ে উপকারী বস্তু হচ্ছে একটি কোমল হৃদয়। আমরা হৃদয়েরকোমলতাঅর্জনে চেষ্টা করবো। কারণ এছাড়া সবকিছুই অর্থহীন ও অপ্রয়োজনীয়হয়েযাবে। কিভাবে আমরা তা অর্জন করতে পারি ?

জীবনে সবচেয়ে উপকারী বস্তু হচ্ছে একটি কোমল হৃদয়। আমরা হৃদয়েরকোমলতাঅর্জনে চেষ্টা করবো। কারণ এছাড়া সবকিছুই অর্থহীন ও অপ্রয়োজনীয়হয়েযাবে। কিভাবে আমরা তা অর্জন করতে পারি ?এটা কোন গোপন বিষয় নয়। এমনকিছুনয় যা অল্প কিছু মানুষ জানে এবং বিশেষ অধিবেশনে এবং জমায়েতে শুধুতাজানানো হয়। যেমন নবী মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামবলেছেন : আমি তোমাদের রেখে যাচ্ছি পরিষ্কার সাদা সমতলে, যার দিন তাররাত্রির মতই। যে কেউ তা থেকে বিচ্যুত হবে, সে ধ্বংস হয়ে যাবে।তাঁর পথআমাদের কাছে স্পষ্ট করে দেয় কিভাবে আমরা হৃদয়ের কোমলতা অর্জন করব।

প্রথম পদ্ধতিদুআ

প্রথমউপায় হচ্ছে দুআ করা।হৃদয়কে কোমল করে দেওয়ার জন্য ও তা দয়ায়পূর্ণ করেদেওয়ার জন্য আল্লাহর কাছে চাওয়ার মতো কার্যকরী আর কিছু নেই।এটাই তাঁরওয়াদা যখন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনযে, “আল্লাহ কে ডাক নিশ্চিত হয়ে যে তিনি তোমার ডাক শুনবেন, কিন্তু একইসাথে জেনে রাখো যে আল্লাহ উদাসীন অন্তেরর দুআ কবুল করেন না।কিন্তু তাতেআমাদের বিশ্বাস রাখতে হবে। যদি আমরা শুধু হাত তুলে বলি, “হে আল্লাহ, আমারহৃদয় কোমল করো!এবং অন্তর থেকে না চাই, তাহলে এটা মৌখিক চাওয়া ছাড়া আরকিছুই নয়!বিশুদ্ধ চিত্তে আল্লাহর কাছে চাইতে হবে, তিনি অন্তরকে কোমলকরে দেবেন, “আমাকে ডাক এবং আমি তোমাদের ডাক শুনি।কুরআনের ভাষায়:

وَإِذَا سَأَلَكَ عِبَادِي عَنِّي فَإِنِّي قَرِيبٌۖ أُجِيبُ دَعْوَةَ الدَّاعِ إِذَا دَعَانِۖ فَلْيَسْتَجِيبُوا لِي وَلْيُؤْمِنُوا بِي لَعَلَّهُمْ يَرْشُدُونَ

আমারবান্দারা যখন তোমাকে আমার সম্পর্কে প্রশ্ন করে, আমি নিঃসন্দেহেতাদেরকাছেই আছি : আমি প্রত্যেক আহ্বানকারীর আহ্বানে সাড়া দেই যখন সেআমাকে ডাকে ; তারাও যেন আমার ডাকে সাড়া দেয় এবং আমাকে বিশ্বাস করে ; যাতে তারা সঠিকপথের অনুসারী হয়।” (সূরা আল বাক্বারাহ, ২ : ১৮৬)

নবীমুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং তাঁর সাহাবাদেরজীবনেআমরা যে বহু ঘটনার উদাহরণ পাই, তা একথাই প্রমাণ করে যে শুধু আল্লাহইঅন্তেরর পরিবর্তন ঘটাতে সক্ষম। আমরা উমর বিন খাত্তাবের (রা) ঘটনাটিচিন্তাকরি।

নবীমুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং ইসলামের প্রতিতাঁরমনোভাব এত কঠোর ছিল যে একদিন তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকেহত্যা করার জন্য বের হন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএঁরপ্রচেষ্টা ও ইসলামের প্রসারে ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে তিনি নিজেইব্যাপারটারএকটা নিষ্পত্তি করে ফেলতে চাইলেন। খোলা তলোয়ার হাতে বেরিয়েগেলেন। পথেএকজনের সাথে দেখা হলো, যিনি প্রথমে তাঁকে তাঁর বোনের ব্যাপারেখোঁজ নিতেবললেন। বিস্মিত হয়ে তিনি বোনের বাড়িতে গেলেন, দরজা ভেঙ্গে ঘরেঢুকে বোনকেও বোনের স্বামীকে প্রহার করে রক্তাক্ত করলেন। তারপর তিনিথামলেন ও দেখলেনতিনি কি করেছেন। ঘরে প্রবেশের পূর্বে তিনি কুরআনের কিছুঅংশ শুনেছিলেন এবংতা তাঁর মনকে স্পর্শ করেছিল, কিন্তু তাঁর ক্রোধ সেইভাবকে অন্তের স্থায়ীহতে দেয়নি। যখন তিনি বোনকে আঘাত করলেন এবং রক্তপ্রবাহিত হল, তাঁর চেতনাফিরে এল। যা তিনি পূর্বে শুনেছিলেন তা তাঁরঅন্তরকে নাড়া দিল। তিনি সেটাআবার শুনতে চাইলেন এবং কুরআনের কিছু অংশতাঁকে পড়ে শোনানো হলো। তিনি বদলেগেলেন। তাঁর আমূল পরিবর্তনের জন্য এটাইযথেষ্ট ছিল। ইনিই উমর। আরেকবার, অন্য কোন সময়ে সাহাবারা তাঁকে দেখলেনতিনি বারবার হাসছেন, তারপর কাঁদছেন।তাঁরা তাঁকে এর কারণ জিজ্ঞাসা করলেন।তিনি বললেন : আমারমনে পড়েছিল জাহেলী যুগে আমার একটি দেবতা ছিল খেজুরেরতৈরি। একদিন আমি এতক্ষুধার্ত হলাম যে তার একটি টুকরা খেয়ে ফেললাম। তারপরআমি কাঁদছিলাম আমারকন্যার কথা মনে করে যাকে আমি জ্যান্ত কবর দিয়েছিলাম।যখন আমি তাকে গর্তেনামিয়ে দিচ্ছিলাম, সে আমার দাড়িতে লেগে থাকা ধূলাঝেড়ে দিচ্ছিল।এবং তিনি তাকে জ্যান্ত কবর দিয়েছিলেন। এটাই ছিল তখনকাররীতিযারা কন্যা সন্তান জন্ম দেওয়াকে অসম্মানজনক মনে করে তাকে হত্যা করতো।তাঁর হৃদয় তখন কত কঠিন ছিলকতকঠিন সেটা হতে পেরেছিল কন্যাটিকে জীবন্তপুঁতে ফেলার সময়। কিন্তু তাঁরহৃদয় পরিবর্তিত হয়েছিল। এতখানি যে উমরযখন সালাতে ইমামতি করতেন, কান্নায়তাঁর কন্ঠ এমনভাবে আটকে যেত যে এমনকিতৃতীয় সারি থেকেও লোকে তাঁর কান্নারআওয়াজ শুনত। ইনিই ছিলেন উমর, এমনএকজন যিনি এত কঠোর, এত শক্তিশালী, এতসাহসী ব্যক্তিকিন্তু ইসলামগ্রহণের সাথে সাথে তাঁর হৃদয় পরিবর্তিত হয়ে গেল। তাইআমাদের উচিত নবীসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এঁর উপদেশ মত আল্লাহরদিকে ফিরে যাওয়া, তাঁর কাছে কোমল হৃদয় চেয়ে দুআ করা এবং নির্ভীক হৃদয়থেকে আল্লাহর কাছেআশ্রয় চাওয়া। এই একই দুআয় তিনি আল্লাহর কাছে এমন চোখথেকে আশ্রয়চাইতেন যা অশ্রুসিক্ত হয় না, যা কখনো কাঁদে না।

দ্বিতীয় পদ্ধতিমৃত্যুকে স্মরণ করা

দ্বিতীয়পথ হচ্ছে আখিরাতকে স্মরণ করা, মৃত্যুকে স্মরণ করা। এটিইএকমাত্র বিষয় যেসম্পর্কে আমরা পুরোপুরি নিশ্চিত যে আমরা অবশ্যইমৃত্যুবরণ করব, যদিও বাআমাদের আল্লাহর অস্তিতে সন্দেহ থাকতে পারে, এমনকিআমাদের নিজেদের অনুসৃত পথঅন্যান্য বহু মত ও বহু পথের ভিতরে সঠিক কিনা তানিয়েও আমাদের সংশয় থাকতেপারে। কিন্তু আমাদের জীবনটা এমন যে আমরা এতেজড়িয়ে পড়ে মৃত্যুর কথাভুলে যাই। যেমন আল্লাহ বলেছেন, সম্পদ জমা করারআগ্রহ তাদেরকে জীবনেরবাস্তবতা তা থেকে এমনভাবে প্রতারিত করে রেখেছে যেকবরে যাওয়ার সময়ই কেবলতাদের চৈতন্যোদয় হয়।

প্রাচুর্যের লালসা তোমাদেরকে মোহাচ্ছন্ন রাখে এমনকি তোমরা কবরে পৌঁছেযাও। কিন্তু না, তোমরা শীঘ্রই জানতে পারবে বাস্তবতা)…” (সূরা আত-তাকাসুর, ১০২:১-৩)

এটিএকটি ভীতিজনক বক্তব্য যে, আমরা মৃত্যু সম্পর্কে অসচেতন থেকেজীবনযাপন করেযাব এবং গতানুগতিক ব্যাপার নিয়ে মেতে থাকব, যা পরবর্তীজীবনে আমাদের কোনকাজেই আসবে না। এই পরিপ্রেক্ষিতেই নবী মুহাম্মাদসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :

ইসলামেরপ্রথম যুগে আমি তোমাদের কবর জিয়ারত করতে নিষেধ করেছি। কিন্তুএখন আমিতোমাদের কবর জিয়ারতের নির্দেশ দিচ্ছি কারণ তা তোমাদের আখিরাতেরকথা মনেকরিয়ে দেবে।” [“আমিএকসময় তোমাদের কবর জিয়ারত করতে নিষেধকরেছিলাম, (এবং এখন আমি বলছি)তোমাদের তা কর, যাতে জিয়ারত মৃত্যুর কথাস্মরণ করিয়ে দিয়ে উপকার করতেপারে।” (মুসলিম ও অন্যান্য)]

[আল হাকিমের এর ভাষ্য : “... কারণ (এরকম জিয়ারত) হৃদয়কে নরম করে, চোখে অশ্রু প্রবাহিত করে এবংআখিরাতকে স্মরণ করিয়ে দেয়, (কিন্তু সতর্কথাক) যাতে নিষিদ্ধ কথা না বলাহয় (অর্থাৎ জিয়ারতের সময়)” (সহীহ আলজামি, ৫৪৮৪)] কবরস্থানে গিয়ে কবরবাসীদের অবস্থা সম্পর্কে চিন্তাভাবনাকরা উচিত (সেই কবরবাসীরা যেই হোক না কেন)। যেমন নবী সাল্লাল্লাহুআলাইহিওয়া সাল্লাম বলেছেন : কারো কবর জান্নাতের বাগানসমূহের মধ্যে একটি বাগানহবে অথবা জাহান্নামের আগুন ভরা গর্তের একটি হবে।কবরে এমন মানুষ আছে যারাসাহায্যের জন্য চিৎকার করছে, কিন্তু সাহায্য করার কেউ নেই। যখন মুনকার ওনকীর এসে তাদের প্রশ্ন করে, “তোমাদের রব কে? তোমাদের দ্বীন কি? সেই নবী কেযাঁকে তোমাদের কাছে পাঠানো হয়েছিল?” তারা কোন উত্তর দিতে পারে না! [সহীহআল বুখারী, দ্বিতীয় খণ্ড, ত্রয়োবিংশপুসক্ত , ৪২২ নং হাদীস : আনাসকর্তৃক বর্ণিত : নবী বলেছেন, “যখনকোন মানুষকে কবরে শোয়ানোর পর তারসঙ্গীরা চলে যায় এবং তাদের পদধ্বনিশোনা যেতে থাকে, দুজন ফেরেশতা এসেতাকে বসিয়ে জিজ্ঞাসা করে : মুহাম্মাদ সম্পর্কে তুমি কি বলতে?’ সে বলবেআমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে তিনি আল্লাহর বান্দা ও রাসূল।তখন তাকে বলা হবে, ‘জাহান্নামে তোমার জন্য তৈরি ঘরটি দেখ, এর পরিবর্তে আল্লাহ তোমাকে জান্নাতেএকটি ঘর দিয়েছেন।’” নবী আরো বললেন, মৃত ব্যক্তি তার দুটো বাসস্থানই দেখতেপাবে। কিন্তু একজন অবিশ্বাসী বা মুনাফিক ফেরেশতাদের বলবে, ‘আমি জানি না, কিন্তু লোকে যা বলতো আমিও তাই বলতাম!তাকে বলা হবে, ‘তুমি জানতে না এবংতুমি হিদায়াত গ্রহণও করোনি (কুরআন পাঠের মাধ্যমে)।তারপর তাকে একটিলোহার হাতুড়ি দিয়ে দুই কানের মর্ধবর্তী স্থানে আঘাত করাহবে, এবং সেচিৎকার করবে, তার সেই চিৎকার মানুষ ও জ্বিন ছাড়া আর সবাইশুনতে পাবে।]

এসবপ্রশ্নের উত্তর আমাদের জানা আছে কি নেই তাতে কিছু আসে যায় না, কারণবিষয়টি সেটা নয়। পরবর্তী জীবনে লাঞ্ছনার অংশ হিসাবে আমরা প্রশ্নেরউত্তরদিতে ব্যর্থ হব। আমরা জানি যে উত্তরটি হচ্ছে পরবর্তী জীবনের চাবি, কিন্তুচাবিটি আমরা ব্যবহার করতে জানি না। এ জীবনে আমাদের অন্তরে তা গ্রহণকরিনি, তাই পরবর্তী জীবনে আমাদের প্রবেশাধিকার নেই। যদি আমাদের হৃদয়ে এইবোধ এজীবনে না আসে যে আল্লাহ আমাদের রব, মুহাম্মাদ আমাদের নবী এবং ইসলামআমাদেরদ্বীন, তাহলে এই জ্ঞান আখিরাতে আমাদের কাজে লাগবে না।তাইনারী-পুরুষনির্বিশেষে আমাদের সকলকে এরই ভিত্তিতে কবর জিয়ারত করতে বলাহয়েছে, কারণএর উপকারিতা শুধু পুরুষদের জন্য নয়, নারীদের জন্যও আছে। তবেনারীদেরপ্রকৃতির আবেগ প্রবণতার জন্য কিছু সংখ্যক আলেম বার বার জিয়ারতকরতে নিষেধকরেছেন। যদিও তাদের কবর জিয়ারত করা নিষিদ্ধ নয়। তাই নিয়মিতনা হলেওতাদেরও পুরুষের মতই মৃত্যুকে স্মরণের জন্য অনিয়মিত জিয়ারত করারপ্রয়োজনরয়েছে। আখিরাতের স্মরণ যাদের উপর প্রভাব ফেলে আল্লাহ কুরআনেতাদের কথাবলেছেন। রাতেই এর প্রকাশ ঘটে।

“…তারা রাত্রিতে সামান্যই ঘুমাতো, রাতের শেষ প্রহরে তাদেরকে পাওয়া যেত ক্ষমা প্রার্থনারত অবস্থায়।” (সূরা আয যারিয়াত, ৫১:১৫-১৮)

পরবর্তীজীবন, কবরের পরীক্ষা এবং আসন্ন বিচারের চিন্তায় রাতে তারাজেগে ওঠে। তারাসেসময়ে তাদের বিছানা ত্যাগ করে যখন ঘুম সবচেয়ে মধুর ওগাঢ় হয়। ভাই ওবোনেরা, আসুন আমরা পরবর্তী জীবন নিয়ে চিন্তা করি।মৃত্যুর পর কি হয় তানিয়ে চিন্তা করি ; মৃত্যুর সময়ে কি হয় তানিয়ে-কিভাবে মুমিনের দেহ থেকে রুহ নিয়ে যাওয়া হয়, যেমন নবীসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “পাত্রের নল দিয়ে পানির ফোঁটাযেভাবে করে পড়ে” ; কিন্তু অবিশ্বাসীদের জন্য, “কাঁটার উপর দিয়ে রেশমীকাপড় টেনে নিয়ে যাওয়ার মত”-ছিন্নভিন্নকরে। আল্লাহর ভয়ে ভীত রুহকেআসমানের উপরে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখানকারফেরেশতারা তার প্রশংসা করে।পরে তাকে তার দেহে ফিরিয়ে দেওয়া হয় এবংজান্নাতের বাগানের একটি দরজাতার দিকে খুলে দেওয়া হয় পুনরুত্থান পর্যন্ত।কিন্তু যাদের অন্তত আল্লাহরস্মরণের ব্যাপারে কঠিন, তাদের আত্মা আসমানেআরোহণের সময় বাধাগ্রস্থ হবে।তার দেহে তাকে ছুঁড়ে ফেলা হবে। তাদের মন্দকাজ কুৎসিত জীবের আকারে তাদেরসামনে উপস্থিত হবে এবং তারা যন্ত্রণা ভোগকরবে। জাহান্নামের একটি জানালাতাদের দিকে খুলে দেওয়া হবে এবং পুনরুত্থানপর্যন-তারা সেই উত্তাপে দগ্ধহবে। এবং পুনরুত্থান দিবসে কি ঘটবে যখন আমরাআল্লাহর সম্মুখে দণ্ডায়মানহয়ে আমাদের কৃত প্রতিটি কাজের জবাবদিহি করবো, যখন কিছুই আল্লাহর দৃষ্টিএড়াতে পারবে না, যখন জীবনের কোন কিছুই আমাদেরকোন কাজে আসবে না? আল্লাহরসামনে দাঁড়ানোর সময় কেবল একটি জিনিসই আমাদেরকাজে লাগবে, একটি সুস্থহৃদয়।

তৃতীয় পদ্ধতিঃ কুরআন পাঠ

তৃতীয় যে উপায়ে আমরা আমাদের হৃদয়কে নরম করতে পারি, তা হচ্ছে কুরআন পাঠ আল্লাহ কুরআনে বলছেন :

যারা মুমিন, তাদের জন্য কি আল্লাহর স্মরণে এবং যে সত্য অবতীর্ণহয়েছে, তার কারণেহৃদয় বিগলিত হওয়ার সময় আসেনি? তারা তাদের মতো যেন নাহয়, যাদেরকেপূর্বে কিতাব দেয়া হয়েছিল। তাদের উপর সুদীর্ঘকালঅতিক্রান্ত হয়েছে, অতঃপর তাদের অন্তঃকরণ কঠিন হয়ে গেছে। তাদের অধিকাংশইপাপাচারী।” (সূরা হাদীদ, ৫৭ : ১৬)

যদিআমরা কুরআন নিয়ে গভীর চিন্তা করি, তা আমাদের হৃদয়কে বিগলিত করারক্ষমতারাখে। আলল্লাহ সেই জ্বিনের সম্পর্কে বলেছেন, যে কুরআন শুনেছিল,

নিশ্চয়ইআমরা শুনেছি এক অত্যাশ্চর্য কুরআন ; তা আমাদের আল্লাহর দিকেপথ নির্দেশকরে এবং আমরা তাতে বিশ্বাস করি এবং আমরা আল্লাহর সাথে কোন শরীককরব না।” (সূরা আল-আহকাফ, ৪৬ : ২৯-৩২)

আল্লাহ সৎকর্মশীলদের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছেন : যদিতারা (খৃস্টানদেরমধ্য থেকে) শোনে যা নাযিল হয়েছে রাসূলের উপর, তুমিদেখবে তাদের চক্ষুঅশ্রুপূর্ণ তারা যা সত্য বলে জানে তা আনয়নের জন্য।ইথিওপিয়ার শাসকেরঅবস্থা ছিল তাই। যখন মুসলিমরা সেখানে আশ্রয় চেয়েছিলএবং কুরআনের এক অংশপাঠ করে শুনিয়েছিল, তারা দেখেছিল তাঁর চোখ অশ্রুতেপরিপূর্ণ। আমাদের এমনইহওয়া উচিত। কুরআন শোনার সময় আমাদের এর অর্থেরপ্রতি লক্ষ্য রাখা উচিত।কুরআন যেন আমাদের কাছে পপ গান শোনার বিকল্প নাহয়। মানুষ কণ্ঠস্বরে মুগ্ধহয়ে প্রিয় তেলাওয়াতকারীর রেকর্ড কেনে। কুরআনশোনাটা যেন সঙ্গীত শোনারসমতুল্য হয়ে গেছে। আমরা এতে এতই মুগ্ধ যে যখনক্বারী তেলাওয়াত করেন, পিছনের লোকজনকে বলতে শোনা যায় আল্লাহ! আল্লাহ!পপ শোতে যেমন হয়, মানুষপিছনে নানা ধরনের কথাবার্তা বলতে থাকে। এটা কুরআন নয়। আল্লাহ আমাদেরবলেছেন, তারা কি এর অর্থের প্রতি লক্ষ্য করে না?” কুরআনএকটি পথ নির্দেশিকা এবং এর অর্থ অনুধাবন করেই আমরা এ থেকে উপকার পেতেপারি, এজন্য কুরআনকে আমরা কিভাবে ব্যবহার করি তা পুনরালোচনা করা উচিত।রমযানে পড়ার জন্য রেখে না দিয়ে নিয়মিত আমাদের কুরআন পাঠ করা উচিত। আমরাযেন গভীরভাবে চিন্তা করিরমযানে সম্পূর্ণ কুরআন পড়ে শেষ করবার জন্য নাপড়ি। রমযানে কুরআন খতম হলোকি না হলো তাতে কিছু যায় আসে না। বেশীর ভাগরমযানে নবী সাল্লাল্লাহুআলাইহি ওয়া সাল্লাম কুরআন খতম করেন নি। অধিকাংশসাহাবারাও করেন নি।বর্তমানে, কুরআন খতম ছাড়া আমাদের রমযান সম্পূর্ণ হয়না।আমরা হাফিজ ভাড়া করে আনি৯৯ মাইলবেগে কুরআন তিলাওয়াতের জন্য, একজন আরবী ভাষী লোকের বুঝতে কষ্ট হয় যে কুরআনের কোন্‌ জায়গা হাফিজ পাঠ করছেন!এটাইনজীর হয়ে দাঁড়িয়েছে-রমযানে কুরআন খতম করা, পারলে দুবার! কিন্তু কুরআনএজন্য নয়। কুরআন চিন্তা-ভাবনা করার জন্য, যাতে যখন আমরা কুরআন শুনি তখনআল্লাহ যেমন বর্ণনা করেছেন তেমনি, মুমিনদের মত, তিলাওয়াত শুনে আমাদের শরীরযেন শিউরে উঠে। যা তাদের মন ছুঁয়ে যায় এবং হৃদয়ে কম্পন সৃষ্টি করে। (আযযুমার ৩৯ : ২৩)

যখনআমরা কুরআন শুনব, তখন তার প্রতিক্রিয়ায় আমাদের চোখে পানি না এলেওআমরাকান্নার চেষ্টা করবো। কারণ এভাবে কুরআনের ডাকে সাড়া দেওয়া উচিত।যদি আমরাতা না করি, আমরা ক্ষতিগ্রস্থ হব! এটা আল্লাহর কথা, যা আদম থেকেবর্তমানপর্যন্ত সমস্থ অবতীর্ণ গ্রন্থ মূহের মধ্যে একমাত্র সংরক্ষিত বাণী!এটাআল্লাহর সংরক্ষিত বাণী! কুরআন পাঠের সময় আমাদের বিশ্বাস রাখতে হবেযেআল্লাহ আমাদের সাথে কথা বলছেন, কারণ তা তাই। আল্লাহই সরাসরি আমাদেরসাথেকথা বলছেন।

যখনতিনি ইহুদীদের সম্পর্কে আমাদের কিছু বলেন, আমরা সেটাকে শুধুমাত্রএকটিতথ্য হিসাবে গ্রহণ করবো না যে ইহুদীরা এমন বা তারা তেমন ছিল। না! যখনআল্লাহ তাদের সম্পর্কে আমাদের কিছু বলেন, সেটা আমরা একটা সতর্কবাণীহিসাবেনেব-যাতে আমরা তাদের মতো না হয়ে যাই। আল্লাহ সূরা ফাতিহায়বলেছেন, “… গাইরিল মাগদুবি আলাইহিম ওয়া লা দ্বাল্লিন…”, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ব্যাখ্যা করেছেন যে আল-মাগদুবিআলাইহিম হচ্ছে ইহুদিরা এবং আদ-দ্বাল্লিন হচ্ছে খৃষ্টানরা। যাদের উপর আল্লাহক্রুদ্ধ তারা ইহুদী এবং যারা পথভ্রষ্ট, তারা খৃষ্টান। ইহুদিদের উপরআল্লাহএ কারণে ক্রুদ্ধ যে তারা সত্যকে জানে কিন্তু মেনে চলে না।তোমরা মানুষকে সৎকর্মের প্রতি আহ্বান জানাও কিন্তু নিজেরা তা করতে ভুলে যাও।তারা কিতাবের পরিবর্তন করেছিল। খৃষ্টানদের সঠিক জ্ঞান ছিল না, তারা ছিলবিভ্রান-। তারা মনে করে আল্লাহ একজন মানুষ! এটা আমাদের জন্য সাবধানবাণী।যখনই আমরা এই আয়াতগুলি পাঠ করি, আল্লাহ আমাদের সতর্ক করে দেন যেন আমরাতাদের মত না হই-আমাদের কাছে সত্য আছে, কিতাব আছে, কিন্তু আমরা তা অনুসরণকরি না। আমরা যদি জ্ঞান অনুসন্ধান না করি, জানতে চেষ্টা না করি আল্লাহআমাদের কাছে কি চান, তাহলে আমরা পথভ্রষ্ট হয়ে যাব। যখনই আমরা পড়ি“… গাইরিল মাগদুবি আলাইহিল ওয়া লা দ্বাল্লিন..এটা যেন আমাদের স্পর্শ করে। আমরা যেন চিন্তা ভাবনা করি এ নিয়ে। সারাকুরআনে ছড়িয়ে থাকা বহু আয়াত আমাদের আখিরাতের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, বিচার দিনের লক্ষণগুলি মনে করিয়ে দেয়। কুরআনের যে কোন অংশ খুলে পড়লেইআমরা তা জানতে পারব। প্রায় প্রতিটি অধ্যায়েই আল্লাহ পরবর্তী জীবনের কথাবলেছেন। যা অন্তরের নম্রতা অর্জনের দ্বিতীয় উপায়ের সাথে সম্পর্কিত-কবরজিয়ারত করা এবং আখিরাতকে স্মরণ করা। কুরআন তা নিয়ে চিন্তা করতে বলে।

চতুর্থ পদ্ধতিঃ সৎকর্ম

হৃদয়নরম করার চতুর্থ পথ হলো সৎকর্মের মাধ্যমে। আল্লাহর জন্যবিশ্বস্তভাবে যেসৎকর্ম করা হয়, তা হৃদয়কে বিনীত করে। প্রাথমিক পর্যায়েআমরা হয়তো তাবুঝতে পারবো না, কিন্তু আমাদের আস্থার সাথে লেগে থাকতেহবে। যেমন নবীসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আল্লাহ কর্তৃকঅবশ্যকরণীয়কাজগুলো সম্পাদনের মাধ্যমে বান্দা তাঁর যতটা নিকটবর্তী হয়, ততটা আর কোনকিছুতে হয় না। সেগুলো হচ্ছে প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত সালাত, রোযা ইত্যাদি।প্রার্থনার সময় প্রায়ই আমাদের মনে হয়, “কি লাভ হচ্ছে? পরিবর্তন কোথায় হচ্ছে?” আমাদের বুঝতে হবে যে লেগে থাকতে পারলে উপকারপাওয়া যাবে। তাৎক্ষণিক ফলাফলহয়তো পাওয়া যাবে না। এটা একটা ধারাবাহিকব্যাপার, অনেকটা একজন মানুষেরবেড়ে ওঠার মতো। বাচ্চারা চিন্তা করে কখনতারা বড় হবে এবং দেওয়ালে দাগদিয়ে রাখে এই আশায় যে একদিন ততটুকু লম্বাহবে। তারা নিজেদের বেড়ে ওঠাকেবুঝতে পারে না, কারণ সেটা ঘটছে তাদেরশরীরের অভ্যন্তরে।

সৎকর্মের ব্যপারেও একই কথাএবং প্রথম সৎকর্ম হচ্ছে যা আল্লাহ আদেশকরেছেন। প্রাথমিক অবশ্যকরণীয়কাজগুলি ত্যাগ করে অন্য কাজে আমাদের লিপ্তহওয়া যা আল্লাহ আমাদের করতেবলেননি, একটি ভুল পদক্ষেপ। আমরা যদি প্রতিদিনযথাসময়ে পাঁচবার সালাতপ্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হই, তাহলে আমরা আর যাকিছুই করি না কেন তাতে কিছুযায় আসে না। সেটা অর্থহীন। এটা ভিত্তি-যদিআমরা আল্লাহ যা করতে বলেছেন, যাআমাদের কাছে দাবী করছেন তা করতে না পারি, তবে কিভাবে অন্য কিছু করে আমরাতাঁকে খুশি করতে পারি? অর্থাৎ তখন আল্লাহকেআমরা নিজের মত করে খুশি করতেচাই-যা আমাদের খুশি করে তাই আল্লাহকে খুশিকরবে। এটা আল্লাহকে খুশি করানয়।

আমাদের মনে রাখতে হবে যে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “জাহান্নামেরআগুনকে আমাদের পছন্দনীয় বস্তু দ্বারা পরিবেষ্টন করা হয়েছেএবং জান্নাতকেআমাদের অপছন্দনীয় কাজ দ্বারা পরিবেষ্টন করা হয়েছে।” “যাআমাদের অপছন্দনীয়বলতে যে মন্দ কিছু বোঝাচ্ছে তা নয়, এগুলো তাই যাআমাদের নফস করতে পছন্দকরে না, কারণ এতে পরিশ্রম ও চেষ্টার প্রয়োজন। আমরাসহজ কিছুই পছন্দ করি।সুতরাং সালাত আমাদের অপছন্দনীয় এবং কেউ যদি বলতোযে সালাতের দরকার নেই, আমরা খুশি হয়েআলহামদুলিল্লাহউচ্চারণ করতাম। এটা আমাদের স্বভাব, এতে আমরা খুশি হই। কিন্তু আমাদের দুঃখহওয়া উচিত এজন্য যে আমরা শুধু এ জীবনেই সালাত আদায়ের সুযোগ পাব, পরবর্তীজীবনে নয়। সালাত আমাদের কাজে লাগবে এখানেই। পরবর্তী জীবনে আমরা সালাতআদায় করতে চাইব, আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করবো। আল্লাহ তাদের বর্ণনাদিয়েছেন যাদেরকে বিচারের জন্য তাঁর সামনে আনা হবে :

"যখনতারা তাদের কর্মসমূহ দেখবে এবং জানবে যে তারা নিজেদেরকেজাহান্নামেপাঠানোর জন্য তৈরি করেছে। তারা কি করবে? তারা কি আল্লাহর সাথেতর্ক করবেকেন তাদের জাহান্নামে পাঠানো হবে? না, তারা আল্লাহর কাছেআরেকবার দুনিয়ায়ফিরে যাওয়ার সুযোগ পেতে চাইবে, যাতে তারা সেখানে গিয়েআল্লাহর নির্দেশিতসৎকাজ করতে পারে এবং আরো বেশি করে "(সূরা আরাফ, ৭ :৫৩)।

কিন্তুআল্লা জানেন যে তারা মিথ্যা বলছে, তারা তাই করবে যা তারা আগেকরেছে। কারণযদি আল্লাহ আমাদের আবার দুনিয়াতে ফেরৎ পাঠান, তাহলে নবলব্ধএই সচেতনতা ওজ্ঞান সহ পাঠাবেন না। আমরা আগে যা ছিলাম তেমনি ভাবেইপাঠাবেন। সালাত হচ্ছেআমাদের উপকারের জন্য। এতে করে আমরা আল্লাহকে উপকৃতকরছি না। যদি পৃথিবীরসমস্থ মানুষ সালাত আদায় করতো, তা আল্লাহর কোনউপকারে আসতো না। তেমনি কেউযদি সালাত আদায় না করতো, তাতে আল্লাহর কোনক্ষতি বা হ্রাস ঘটতো না। সালাতআমাদের নিজেদের জন্য। সেজন্যই নবীসাল্লাল্লাহু ওয়া সাল্লাম বলতেন, “বেলাল, আযানের মাধ্যমে আমাদের শান্তিদাও।সালাতকে আনন্দের সময় বলে বিবেচনা করা হয়, অথচ আমাদের কাছে তা বোঝামাত্র। যত তাড়াতাড়ি তা আদায় করা যাবে, ততই ভাল, তাহলে আমরা আবারআমাদেরজীবনের ব্যস্ততায় ফিরে যেতে পারব। এটা একটা ভুলআমাদের অন্তর কঠিনহয়ে গেছে। ইহুদিদের সম্পর্কে আল্লাহ বলেছেন :

"তাদেরকেসমস্থ নিদর্শন দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু সময়ের সাথে সাথে তাদেরহৃদয় কঠিনহয়ে গেছে। আমাদের হৃদয়ও কঠিন হয়ে গেছে। আমরা ইসলাম গ্রহণকরেছি, আমরাইসলামের প্রতি সজাগ হয়েছি এবং ইসলামের বিধি নিষেধ মেনে চলারচেষ্টা করছি, কিন্তু সময়ের সাথে সাথে আমাদের হৃদয় কঠিন হয়ে গেছে। "(সূরা হাদীদ, ৫৭ :১৬)

সালাতআমাদের কাছে আনন্দদায়ক না হলেও আমাদের চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবেএবং বুঝতেহবে যে এটাই স্বাভাবিক। ঈমান বাড়ে ও কমে। অন্তর কঠিন হয়ে যায়এবং আমরাতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করি ও তা নরম হয়মৃত্যু পর্যন্তধারাবাহিকভাবে এই সংগ্রাম চলবে। আমরা শুধু এই দুআ করি যেনআমরা ভীত ওবিনীত হৃদয় সহ মৃত্যুবরণ করতে পারি। আমরা সংগ্রাম করতে থাকবএবং এর মাঝেইঈমানের স্বাদ পাব, সালাত আদায়ের বিধান কেন দেওয়া হয়েছে তাবুঝতে পারব, আমাদের জীবনে আল্লাহর স্মরণ বলতে কি বোঝায় তা উপলব্ধি করতেপারব। নবীসাল্লাল্লাহু ওয়া সাল্লাম তাদের কথা বলেছেন, যারা কিয়ামতের দিনআল্লাহরআরশের ছায়ায় আশ্রয় পাবে-যেদিন কোথাও কোন ছায়া থাকবে না : তারাহচ্ছেযারা আল্লাহর স্মরণে কাঁদে, তাদের হৃদয় বিনম্র। [বুখারী, অষ্টমখণ্ড, পুসিক- া ৭৬, ৪৮৬ নং হাদীস : আবু হুরায়রা কর্তৃক বর্ণিত : নবীবলেছেন, “আল্লাহসাতজনকে পুনরুত্থান দিবসে তাঁর ছায়ায় আশ্রয় দেবেন। তাদেরঅন্যতম হচ্ছেসে যে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং তার চোখ অশ্রুতে ভেসে যায়।”] [বুখারী, প্রথম খণ্ড, একাদশ পুস্তিকা ৬২৯ নং হাদীস : আবু হুরায়রা কর্তৃকবর্ণিত : নবী বলেছেন : আল্লাহসাতজনকে তাঁর ছায়ায় আশ্রয় দেবেন সেইদিন, যেদিন তাঁর ছায়া ছাড়া আরকোন ছায়া থাকবে না। (এই সাতজন হলো)ন্যায়পরায়ণ শাসক, সেই যুবক যে আল্লারইবাদতের মধ্যে বড় হয়েছে (অর্থাৎশিশুকাল থেকে বিশ্বস্তভাবে আল্লার ইবাদতকরছে), সেই ব্যক্তি যার অন্তরমসজিদের সাথে লেগে থাকে (অর্থাৎ জামাতেসালাত আদায়ের জন্য ব্যাকুল থাকে), সেই দুই ব্যক্তি যারা পরস্পরকে আল্লাহরজন্য ভালবাসে এবং তারা আল্লাহরজন্যই পরস্পর মিলিত হয় এবং বিচ্ছিন্ন হয়, এমন এক ব্যক্তি যে কোন সুন্দরীউচ্চবংশীয়া মহিলার আহ্বানকে উপেক্ষা করে এইবলে : আমি আল্লাহকে ভয় করি, এমন ব্যক্তি কে এত গোপনে দান করে যে তার ডানদান করলে বাঁ হাত সেটা জানতেপারে না (অর্থাৎ কেউ জানে না সে কত দানকরেছে), এবং সে ব্যক্তি যেনির্জনে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং তার চোখঅশ্রুসিক্ত হয়।”]

সুতরাংসৎকাজ থেকে আমরা দূরে থাকব না, যা আমাদের অন্তর কে বিনম্র করবে।নবীসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন যে, হাসিমুখে মুসলিম ভাইবোনদেরসম্ভাষণ জানানো হচ্ছে সাদকা। কোন কাজকেই আমরা ছোট মনে করবো না, কোনসৎকাজইছোট নয়। আমরা যে কোন ভাল কাজ করার চেষ্টা করবো। কিন্তু প্রথমেআমরা সেসবকাজ দিয়ে শুরু করবো যা আল্লাহ আমাদের জন্য বাধ্যতামূলক করেছেন।যেভাবেআল্লাহ বলেছেন সেভাবে আমরা সালাত প্রতিষ্ঠা করবো, যেভাবে দেওয়াউচিতসেভাবে যাকাত দেবো, রোযা রাখবো যেভাবে রাখা উচিত এবং সক্ষম হলে হজ্ব ওওমরাপালন করবো। এই মৌলিক বিষয়গুলো আল্লাহর উদ্দেশ্যেই প্রতিষ্ঠা করতেহবে, এগুলোই আমাদের অন্তর বিনম্র করার ভিত্তি। এই কাজগুলো নিয়মিত করা এবংএরসাথে আরও অতিরিক্ত কিছু করার মাধ্যমে আমরা ক্রমান্বয়ে আল্লাহর কাছেআসতেপারবো, তখন আল্লাহর বক্তব্য অনুসারে তাঁর চোখ আমাদের চোখ হয়ে যাবেযাদিয়ে আমরা দেখবো, বাস্তবে আমরা কেবল এতটুকুই দেখয যা আল্লাহ চান যেআমরাদেখি। আমরা আল্লাহ যা পছন্দ করেন না তা দেখা হতে বিরত থাকবো, আমরাকেবলততটুকুই নেব যা আল্লাহ চান, সেখানেই যাব যেখানে আল্লাহ চান যে আমরাযাইযদি আমরা আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তন করি ও আল্লাহকে ডাকি, তিনিআমাদের ডাকশুনবেন। এটা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওয়াদা।

আমারভাই ও বোনেরা, আমি আপনাদের ও আমার নিজেকে আহ্বান জানাই আমাদেরঅন্তরের কথাস্মরণে রাখতে, আমাদের হৃদয়ের অবস্থান নিয়ে চিন্তা করতে। যখনআমরা সময়পাই আমরা যেন প্রশ্ন করি, আমাদের অবস্থা কি? যাতে আমরা আমাদেরহৃদয়কে নরমকরার কাজে সফল হতে পারি আল্লাহর রহমত ও ক্ষমার মাধ্যমে।আল্লাহর দিকেপ্রত্যাবর্তনের মাধ্যমে আমরা এই কাজ শুরু করবো। আজ রাত্রেরপরবর্তী সালাতে, আসুন আমরা আল্লাহর দিকে ফিরি ও আন্তরিকভাবে আমাদেরহৃদয়ের কোমলতার জন্যদুআ করি। এতে যদি আমরা বিশ্বস্ত হই, আমাদের অন্তরবিগলিত হতে থাকবে। এটারাসূলুলল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এঁরওয়াদা। আমাদের উচিতকুরআন পাঠ করা ও যথাসম্ভব সৎকাজ করা। কবর জিয়ারতেরমাধ্যমে ও তাদের জন্যনির্ধারিত দুআ পাঠ করে ও পরবর্তী জীবন সম্পর্কেরাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহুআলাইহি ওয়া সাল্লাম যা কিছু বলেছেন তা পড়েআমাদের উচিত আখিরাতের চিন্তায়গভীর মনোনিবেশ করা। আমি আগে যেমন বলেছি, এরপরও যদি আমরা আমাদের অন্তরেরকোমলতার সন্ধান না পাই, আমরা কাঁদতে চেষ্টাকরবো। আমরা জোর করেই কাঁদতেচেষ্টা করবো যাতে আমরা আমাদের ভিতরেরঅনুভূতিগুলোকে সরিয়ে দিতে ও মুক্তকরে দিতে পারি, তা নাহলে অন্তর নরম হবেনা।

সুতরাংআমি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি ও চাই যে আল্লাহ যেন আমাদেরসকলকে কোমলহৃদয় দান করেন, যে হৃদয় আল্লাহর সৃষ্টির প্রতি, আমাদেরসন্তানদের প্রতি, আমাদের পিতামাতার প্রতি, মুসলিম ভাই ও বোনদের প্রতিকরুণায় ভরা থাকবেএমনকি যারা মুসলিম নয় তাদের প্রতিও। আমি অমুসলিমদেরজন্য আমাদের হৃদয়েকোমলতা এজন্য চাই যেন আমরা তাদের কাছে যথাযথভাবেহেদায়েতের বাণী পৌঁছাতেপারি। আল্লাহ যেন আমাদের তাঁর কুরআনের দিকে ফিরেআসার ও নিয়মিত তা পাঠকরার, তা বোঝার ও তা থেকে হেদায়েত গ্রহণ করারতাওফীক দেন এবং আমাদেরবিনম্র অন্তর দান করেন। আসসালামু আলাইকুম।

ব্যবসা-বাণিজ্যে সততা

$
0
0

লেখকঃ ড. মুহাম্মাদ আজিবার রহমান | ওয়েব সম্পাদনাঃ শাবাব শাহরিয়ার খান

Pics 3

জীবিকা নির্বাহের প্রয়োজনে মানুষকে উপার্জনের নানাবিধ পথ বেছে নিতে হয়। ইসলামের দিকনির্দেশনা হ’ল হালাল পথে জীবিকা উপার্জন করা। হারাম পথে উপার্জিত অর্থ-সম্পদ ভোগ করে ইবাদত-বন্দেগী করলে তা আল্লাহ্র নিকট গৃহীত হবে না। কারণ ইবাদত কবুলের আবশ্যিক পূর্বশর্ত হ’ল হালাল উপার্জন। [১] ক্বিয়ামতের ময়দানে বনু আদমকে পাঁচটি প্রশ্ন করা হবে এবং এর যথাযথ উত্তর না দেওয়া পর্যন্ত কোন মানুষ সামান্য পরিমাণ সামনে অগ্রসর হ’তে পারবে না। তান্মধ্যে একটি হ’ল ‘সে কোন পথে অর্থ উপার্জন করেছে’। [২] বুঝা গেল, অর্থ-সম্পদ হালাল পথে উপার্জন করতে হবে, অন্যথা ক্বিয়ামতের ভয়াবহ দিনে মুক্তির কোন পথ খোলা থাকবে না। আর হালাল পথে অর্থ-সম্পদ উপার্জনের একটি অন্যতম মাধ্যম হ’ল সততার সাথে ব্যবসা-বাণিজ্য করা। রাসূলুল­াহ (ছাঃ)-কে সর্বোত্তম উপার্জন সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হ’লে তিনি বলেন,

 أَطْيَبُ الْكَسْبِ عَمَلُ الرَّجُلِ بِيَدِهِ، وَ كُلُّ بَيْعٍ مَبْرُوْرٍ 

‘নিজ হাতে কাজ করা এবং হালাল পথে ব্যবসা করে যে উপার্জন করা হয় তা-ই সর্বোত্তম’। [৩]

ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহের গুরুত্ব ইসলামে অনস্বীকার্য। সততা ও ন্যায়-নিষ্ঠার সাথে বৈধ পথে ব্যবসা-বাণিজ্য করে জীবিকা নির্বাহ করতে ইসলাম বিশেষভাবে উৎসাহিত করেছে। মহান আল্লাহ বলেন,

 يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا لَا تَأْكُلُوْا أَمْوَالَكُمْ بَيْنَكُمْ بِالْبَاطِلِ إِلاَّ أَنْ تَكُوْنَ تِجَارَةً عَنْ تَرَاضٍ مِنْكُمْ

‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা একে অপরের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভক্ষণ করো না। কেবলমাত্র তোমাদের পরস্পরের সম্মতিক্রমে যে ব্যবসা করা হয় তা বৈধ’ (নিসা ২৯)

আল্ল­াহ আরো বলেন,

 فَإِذَا قُضِيَتِ الصَّلَاةُ فَانْتَشِرُوْا فِي الْأَرْضِ وَابْتَغُوْا مِنْ فَضْلِ اللهِ 

‘যখন ছালাত শেষ হয়ে যাবে তখন তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড় এবং আল্লাহ্র অনুগ্রহ (জীবিকা) তালাশ কর’ (জুম‘আ ১০)

সুতরাং জীবিকা উপার্জনের উত্তম পেশা হিসাবে ব্যবসা-বাণিজ্যের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। উল্লিখিত আয়াতে ছালাতের ন্যায় গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতের পরই ব্যবসা-বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ার ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে।
সততার সাথে ব্যবসা-বাণিজ্য করলে পরকালীন জীবন কল্যাণময় হবে মর্মে হাদীছে বর্ণিত হয়েছে। রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,

التَّاجِرُ الصَّدُوْقُ الْأَمِيْنُ مَعَ النَّبِيِّيْنَ والصِّدِّقِيْنَ وَ الشُّهَدَاءِ،

‘সত্যবাদী আমানতদার ব্যবসায়ী ক্বিয়ামতের দিন নবী, ছিদ্দীক্ব এবং শহীদগণের সাথে থাকবে’ [৪]

ব্যবসা-বাণিজ্য জীবিকা উপার্জনের সর্বোত্তম পেশা হওয়ায় মহানবী (ছাঃ), খুলাফায়ে রাশেদীনসহ অধিকাংশ ছাহাবী এর মাধ্যমেই জীবিকা নির্বাহ করতেন। কুরআনের বাণী এবং মহানবী (ছাঃ)-এর হাদীছ দ্বারা উৎসাহিত হয়ে ছাহাবীগণ জীবন-জীবিকার সন্ধানে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েন। এমনকি ভারতীয় উপমহাদেশে সর্বপ্রথম ঐ সকল ব্যবসায়ী ছাহাবীর মাধ্যমেই অবিমিশ্র-নির্ভেজাল ইসলামের আগমন ঘটে। মুসলমানদের ঐতিহ্যবাহী পেশা ব্যবসা-বাণিজ্য। সুতরাং ব্যবসা-বাণিজ্যে সততা, ন্যায়-নিষ্ঠা, বিশ্বস্ততা, আমানতদারী ইত্যাদির উপস্থিতি অতীব যরূরী।

সততার সাথে হালাল উপার্জনের মাধ্যম হিসাবে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রতি উৎসাহিত করে মহান আল্লাহ বলেন,

 وَأَحَلَّ اللهُ الْبَيْعَ وَحَرَّمَ الرِّبَا،

 ‘আল্ল­াহ ব্যবসাকে হালাল এবং সূদকে হারাম করেছেন’ (বাক্বারাহ ২৭৫)

এ আয়াত থেকে বুঝা যায়, ইসলাম উপার্জনের পেশা হিসাবে হালাল পথে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে যেমন উৎসাহ দিয়েছে, তেমনি অবৈধ পথে অর্থ-সম্পদ উপার্জন করতেও নিষেধ করেছে। মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে অবৈধ উপায়ে সম্পদ উপার্জন করে সাময়িকভাবে লাভবান হওয়া গেলেও এর শেষ পরিণতি অত্যন্ত ভয়াবহ। কাজেই অন্যায়, যুলুম, ধোঁকাবাজি, প্রতারণা, মুনাফাখোরী, কালোবাজারী, মওজুদদারী ইত্যাদি অবৈধ ও ইসলাম বিরোধী কার্যাবলী পরিহার করে সততার সাথে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে হবে। রাসূলুল­াহ (ছাঃ) বললেন,

 إِنَّ التُّجَّارَ يُبْعَثُوْنَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ فُجَّارًا إِلاَّ مَنِ اتَّقَى اللهَ وَبَرَّ وَصَدَقَ 

‘ক্বিয়ামতের দিন ব্যবসায়ীরা মহা অপরাধী হিসাবে উত্থিত হবে। তবে যারা আল্ল­াহকে ভয় করবে, নেকভাবে সততা ও ন্যায়নিষ্ঠার সাথে ব্যবসা করবে তারা ব্যতীত’। [৫]

ক্বিয়ামতের ময়দানে কঠিন শাস্তি হ’তে মুক্তি পেতে হ’লে আল্ল­াহভীতি সহকারে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে হবে। কাউকে সামান্যতম ঠকানোর মানসিকতা অন্তরে পোষণ করা যাবে না। তাছাড়া মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি মওজুদ করে রেখে পণ্যমূল্য বাড়িয়ে মুনাফা লাভের প্রবণতা থেকেও বেঁচে থাকতে হবে। কেননা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,

 مَنِ احْتَكَرَ فَهُوَ خَاطِئٌ 

‘যে মওজুদদারী করে সে পাপী’ [৬]

ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে মিথ্যার আশ্রয় গ্রহণ করলে ব্যবসায়ী এবং ক্রেতা উভয়ই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ব্যবসায়ীদেরকে মিথ্যা পরিহার করার জন্য বিশেষভাবে নির্দেশ দিয়েছেন। বিশিষ্ট ছাহাবী ওয়াসিলা ইবনুল আকওয়া (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্ল­াহ (ছাঃ) আমাদের কাছে আসতেন এবং বলতেন,

 يَا مَعْشَرَ التُّجَّارِ إِيَّاكُمْ وَالْكَذِبَ

 ‘হে বণিক দল! তোমরা মিথ্যা কথা ও মিথ্যা কারবার থেকে অবশ্যই দূরে থাকবে’। [৭]

পণ্য ক্রয়-বিক্রয়ের সময় সকল ব্যবসায়ীকে মিথ্যা কসম বর্জন করতে হবে। কারণ তা ইসলামে নিষিদ্ধ। আবু কাতাদা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,

إِيَّاكُمْ وَكَثْرَةَ الْحَلِفِ فِى الْبَيْعِ فَإِنَّهُ يُنَفِّقُ ثُمَّ يَمْحَقُ

 ‘ব্যবসার মধ্যে অধিক কসম খাওয়া হ’তে বিরত থেকো। এর দ্বারা মাল বেশী বিক্রি হয়, কিন্তু বরকত বিনষ্ট হয়ে যায়’ [৮]

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আরো বলেন,

‘অধিক কসম খাওয়ার প্রবণতা ব্যবসায়ের কাটতি বাড়ায়, কিন্তু বরকত দূর করে দেয়’। [৯]

মিথ্যা কসমকারী ব্যবসায়ীদের কঠোর পরিণতি সম্পর্কে অন্য আরেকটি হাদীছে সাবধান বাণী উচ্চারিত হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,

 ثَلاَثَةٌ لاَ يُكَلِّمُهُمُ اللهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَلاَ يَنْظُرُ إِلَيْهِمْ وَلاَ يُزَكِّيْهِمْ وَلَهُمْ عَذَابٌ أَلِيْمٌ، قَالَ أَبُوْ ذَرٍّ خَابُوْا وَخَسِرُوْا مَنْ هُمْ يَا رَسُوْلَ اللهِ قَالَ الْمُسْبِلُ وَالْمَنَّانُ وَالْمُنَفِّقُ سِلْعَتَهُ بِالْحَلِفِ الْكَاذِبِ

 ‘তিন শ্রেণীর লোকের সাথে আল্ল­াহ কিবয়ামতের দিন কথা বলবেন না ও তাদের প্রতি দৃষ্টি দিবেন না এবং তাদেরকে পবিত্রও  করবেন না।  তাদের  জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।

আবূ যার বললেন, হে আল্লাহ্র রাসূল! কারা নিরাশ ও ক্ষতিগ্রস্ত?

তিনি বললেন, টাখনুর নীচে কাপড় পরিধানকারী, উপকার করে খোটা প্রদানকারী এবং ঐ ব্যবসায়ী যে মিথ্যা শপথ করে তার পণ্য বিক্রি করে’। [১০]

মিথ্যা কসমকারী ব্যবসায়ী এতই ঘৃণিত যে, ক্বিয়ামতের দিন আল্ল­াহ তার দিকে ফিরেও তাকাবেন না। প্রখ্যাত ছাহাবী আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন,

জনৈক বেদুঈন একটি ছাগী নিয়ে যাচ্ছিল। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কি ছাগীটি তিন দিরহামে বিক্রি করবে? লোকটি বলল, আল্লাহ্র কসম! বিক্রি করব না। কিন্তু সে পরে সেই মূল্যেই ছাগীটি বিক্রি করে দিল। আমি এ বিষয়টি রাসূলুল্লাহ্র (ছাঃ)-এর কাছে এসে উল্লে­খ করলাম। তিনি আমার কথাগুলো শুনে বললেন,

بَاعَ آخِرَتَهُ بِدُنْيَاهُ 

‘লোকটি  দুনিয়ার বিনিময়ে তার পরকালকে বিক্রি করে দিয়েছে’ [১১]

ব্যবসা-বাণিজ্যের ন্যায় একটি জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ধোঁকা ও প্রতারণা থেকে অবশ্যই বিরত থাকতে হবে। দ্রব্যের কোন দোষ-ত্রুটি থাকলে ক্রেতার সম্মুখে তা প্রকাশ করতে হবে। সেক্ষেত্রে ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয়ই লাভবান হবে এবং তাদের ক্রয়-বিক্রয়ে বরকত হবে। কোন প্রকার গোপনীয়তার আশ্রয় গ্রহণ করা যাবে না।  রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) পণ্যে ভেজাল দিয়ে প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে দ্রব্যের মূল্য বাড়িয়ে দিতে নিষেধ করেছেন। আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত,

أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَرَّ عَلَى صُبْرَةِ طَعَامٍ فَأَدْخَلَ يَدَهُ فِيْهَا فَنَالَتْ أَصَابِعُهُ بَلَلاً فَقَالَ مَا هَذَا يَا صَاحِبَ الطَّعَامِ، قَالَ أَصَابَتْهُ السَّمَاءُ يَا رَسُوْلَ اللهِ، قَالَ أَفَلاَ جَعَلْتَهُ فَوْقَ الطَّعَامِ كَىْ يَرَاهُ النَّاسُ مَنْ غَشَّ فَلَيْسَ مِنِّىْ

 ‘একদা নবী করীম (ছাঃ) কোন এক খাদ্যস্তূপের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি খাদ্যস্তূপে হাত ঢুকিয়ে দিয়ে দেখলেন তার হাত ভিজে গেছে। তিনি বললেন, হে খাদ্যের মালিক! ব্যাপার কি? উত্তরে খাদ্যের মালিক বললেন, হে আল্লাহ্র রাসূল (ছাঃ)! বৃষ্টিতে উহা ভিজে গেছে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে বললেন, ‘তাহ’লে ভেজা অংশটা শস্যের উপরে রাখলে না কেন? যাতে ক্রেতারা তা দেখে ক্রয় করতে পারে। নিশ্চয়ই যে প্রতারণা করে সে আমার উম্মত নয়’। [১২]

রাসূলুল্ল­াহ (ছাঃ) আরো বলেন,

اَلْبَيِّعَانِ بِالْخِيَارِ مَا لَمْ يَتَفَرَّقَا أَوْ قَالَ حَتَّى يَتَفَرَّقَا فَإِنْ صَدَقَا وَبَيَّنَا بُوْرِكَ لَهُمَا فِي بَيْعِهِمَا وَإِنْ كَتَمَا وَكَذَبَا مُحِقَتْ بَرَكَةُ بَيْعِهِمَا

 ‘ক্রেতা বিক্রেতা যতক্ষণ বিচ্ছিন্ন হয়ে না যায়, ততক্ষণ তাদের চুক্তি ভঙ্গ করার ঐচ্ছিকতা থাকবে। যদি তারা উভয়েই সততা অবলম্বন করে ও পণ্যের দোষ-ত্রুটি প্রকাশ করে, তাহ’লে তাদের পারস্পরিক এ ক্রয়-বিক্রয়ে বরকত হবে। আর যদি তারা মিথ্যার আশ্রয় নেয় এবং পণ্যের দোষ গোপন করে তাহ’লে তাদের এ ক্রয়-বিক্রয়ে বরকত শেষ হয়ে যাবে’ [১৩]

প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে দ্রব্যের মূল্য বাড়িয়ে দেওয়া যাবে না। ক্রয়ের ইচ্ছা না থাকলে কেবলমাত্র আসল ক্রেতাকে প্রতারিত করার উদ্দেশ্যে পণ্যের মূল্য ঊর্ধ্বমুখী করে দেওয়া ইসলামে মারাত্মক অপরাধ। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,

 لاَ تَنَاجَشُوْا 

 ‘তোমরা ক্রেতাকে ধোঁকা দেওয়ার লক্ষ্যে ক্রেতার মূল্যের উপর মূল্য বৃদ্ধি করে ক্রেতাকে ধোঁকা দিয়ো না’। [১৪]

কারণ তা ধোঁকাবাজির অন্তর্ভুক্ত, যা ইসলামে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। প্রতারণা ও ধোঁকাবাজি যত সামান্যই হোক ক্রয়-বিক্রয়ের সময় তা বর্জন করা উচিত। ব্যবসা-বাণিজ্যের ন্যায় একটি মহৎ পেশায় নিয়োজিত লোকদের বৈশিষ্ট্য তেমন হওয়াই বাঞ্ছনীয়। এ ব্যাপারে হাসান বিন ছালিহর ক্রীতদাসী বিক্রয়ের ঘটনাটি একটি অনন্য উদাহরণ।

হাসান বিন ছালিহ একটি ক্রীতদাসী বিক্রয় করলেন। ক্রেতাকে বললেন, মেয়েটি একবার থুথুর সাথে রক্ত ফেলেছিল। তা ছিল মাত্র একবারের ঘটনা। কিন্তু তা সত্ত্বেও তার ঈমানী হৃদয় তা উল্লে­খ না করে চুপ থাকতে পারল না, যদিও তাতে মূল্য কম হওয়ার আশংকা ছিল। [১৫]

সুতরাং ক্রেতা বিক্রেতা উভয়কে ধোঁকাবাজি ও প্রতারণার আশ্রয় নেওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। তাহ’লে ইহ-পরকালে কল্যাণ ও মুক্তিলাভ সম্ভব হবে।
ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ওযন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। নেওয়ার সময় বেশী নেওয়া এবং দেওয়ার সময় কম দেওয়া ইসলামে মারাত্মক অপরাধ। এ ধরনের ব্যবসায়ীদের ধ্বংস অনিবার্য। মহান আল্লাহ বলেন,

وَيْلٌ لِلْمُطَفِّفِيْنَ، اَلَّذِيْنَ إِذَا اكْتَالُوْا عَلَى النَّاسِ يَسْتَوْفُوْنَ، وَإِذَا كَالُوْهُمْ أَوْ وَزَنُوْهُمْ يُخْسِرُوْنَ، أَلاَ يَظُنُّ أُولَئِكَ أَنَّهُمْ مَبْعُوْثُوْنَ، لِيَوْمٍ عَظِيْمٍ، يَوْمَ يَقُوْمُ النَّاسُ لِرَبِّ الْعَالَمِيْنَ

‘যারা ওযনে কম দেয় তাদের জন্য ধ্বংস। তারা যখন লোকদের কাছ থেকে কিছু মেপে নেয়, তখন পুরাপুরি নেয়। আর যখন তাদের মেপে বা ওযন করে দেয় তখন কম করে দেয়। তারা কি ভেবে দেখে না যে, তারা সেই কঠিন দিনে পুনরুত্থিত হবে, যেদিন সকল মানুষ স্বীয় প্রতিপালকের সম্মুখে দন্ডায়মান হবে’ (মুতাফ্ফিফীন ১-৫)

 আল্ল­াহ অনত্র বলেন,

 وَأَقِيْمُوا الْوَزْنَ بِالْقِسْطِ وَلاَ تُخْسِرُوا الْمِيْزَانَ

‘তোমরা ন্যায্য ওযন কায়েম কর এবং ওযনে কম দিয়ো না’ (আর-রহমান ৯)

 বুঝা গেল যে, ব্যবসা-বাণিজ্যে ওযনে কম-বেশী করা গুরুতর অপরাধ। এতে এক শ্রেণীর মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আর এক শ্রেণীর মানুষ সাময়িকভাবে লাভবান হয়, যা ইসলামে কাম্য নয়।
পরিশেষে বলা যায়, ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীকে সততা, ন্যায়-নিষ্ঠা ও বিশ্বস্ততার সাথে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে হবে, অবৈধ উপার্জন ও লোভ-লালসাকে সংবরণ করতে হবে। আর এটাই ইসলামের দাবী। মহান আল্লাহ আমাদেরকে সততার সাথে ব্যবসা-বাণিজ্য করে ইহকালে আর্থিক স্বচ্ছলতা অর্জন ও পরকালে মুক্তি লাভের তাওফীক দান করুন। আমীন!!

 . মুসলিম; মিশকাত হা/২৭৬০ ‘ক্রয়-বিক্রয়’ অধ্যায়।
 . তিরমিযী, হা/২৪১৬, হাদীছ ছহীহ।
 . আহমাদ, মিশকাত হা/২৭৮৩; সিলসিলা ছহীহাহ হা/৬০৭।
 . তিরমিযী, হা/১২০৯; হাদীছ ছহীহ, ছহীহ আত-তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/১৭৮২।
 .  তিরমিযী, হা/১২১০; ইবনু মাজাহ হা/২১৪৬; সিলসিলা ছহীহাহ হা/১৪৫৮।
 . মুসলিম হা/৪২০৬।
 . ছহীহ আত-তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/১৭৯৩।
 . মুসলিম, মিশকাত হা/১৬০৭, ২৭৯৩।
 . মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/২৭৯৪।
 ১০. মুসলিম, হা/১০৫; মিশকাত হা/২৭৯৫।
 ১১. সিলসিলা ছহীহাহ হা/৩৬৪।
 ১২. মুসলিম; মিশকাত হা/২৮৬০।
 ১৩. বুখারী, হা/২০৭৯; মুসলিম হা/১৫৩২।
 ১৪. বুখারী, মুসলিম, রিয়াযুছ ছালেহীন, হা/১৫৮১।
 ১৫. ইসলামে হালাল হারামের বিধান, পৃঃ ৩৪০।

মানুষ কষ্ট দিলে মনের ক্ষত সারাবেন যেভাবে

$
0
0

colorful-flowers-wallpaper_422_84115

মূল প্রবন্ধ : ইয়াসমিন মোজাহেদ | ভাষান্তর : মোঃ মুনিমুল হক |  সম্পাদনা : আব্‌দ আল-আহাদ

যখন ছোট ছিলাম, পৃথিবীটাকে মনে হতো একেবারেই নির্ঝঞ্ঝাট এবং খুব পরিপাটি একটা জায়গা। কিন্তু বড় হয়ে দেখলাম ব্যাপারটা মোটেও সেরকম নয়। ভাবতাম সবকিছুই ন্যায়নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত। অর্থাৎ আমার মনে হতো, কারও প্রতি কখনো কোনোরূপ অন্যায় করা যাবে না। কোনো অন্যায় যদি হয়েই যায়, তাহলে সকল ক্ষেত্রেই সুবিচারের জয় হবে। নিজের এই নীতিবোধ অনুযায়ী, সবকিছু যেমনটি হওয়া উচিত তেমনটি ঠিক রাখার জন্য অনেক সংগ্রাম করেছি জীবনে। কিন্তু এই সংগ্রাম করতে গিয়ে জীবনের একটি মৌলিক সত্যকে উপেক্ষা করছিলাম আমি। আমার শিশুসুলভ আদর্শবাদের কারণে আমি বুঝতেই পারিনি, সৃষ্টিগতভাবেই এই পার্থিব জগতটা ত্রুটিযুক্ত। ঠিক যেভাবে আমরা মানুষরা সৃষ্টিগতভাবে অপূর্ণ, ত্রুটিযুক্ত। সবসময় অঘটন আর ঝামেলা লেগেই থাকে আমাদের জীবনে। এসব ঝামেলাই জড়িয়ে, জেনেই হোক, না-জেনেই হোক, ইচ্ছা কি অনিচ্ছায় হোক, অনিবার্যভাবেই আমরা মানুষের মনে কষ্ট দিয়ে ফেলি। বাস্তব হলো, পৃথিবীটা সবসময় ন্যায়নীতি দিয়ে চলে না।

তার মানে কি এই যে, আমরা অবিচারের বিরুদ্ধে লড়াই থামিয়ে দেবো, সত্যের পক্ষে হাল ছেড়ে দেবো? অবশ্যই না। এর মানে হলো, আমরা অবশ্যই এই পৃথিবী এবং আর সবকিছুকে কোনো কাল্পনিক বা অবাস্তব মানদণ্ডে বিচার করতে যাবো না। তবে এমনটি না-করাও সহজ না। কীভাবে আমরা এতো ত্রুটিময় এই পৃথিবীতে টিকে থাকবো, যেখানে মানুষ প্রতিনিয়ত পরস্পরকে হতাশায় ডুবাচ্ছে, এমনকি নিজ পরিবারের লোকেরাই মনে আঘাত দিয়ে মনটা ভেঙ্গে দিচ্ছে? সবচেয়ে কঠিন বিষয়টি হলো, আমাদের প্রতি কেউ অন্যায় করলে কীভাবে আমরা সেই অপরাধকে ক্ষমা করতে শিখব? কীভাবে আমরা নিষ্ঠুর না হয়েও দৃঢ় হতে পারি? অথবা কীভাবে দুর্বল না হয়েও মনের কোমলতাকে বজায় রাখতে পারি? কখন আমরা কোনো কিছুকে আঁকড়ে ধরে রাখবো? আর কখন সেটিকে বন্ধন থেকে মুক্ত করে দেবো? কখন বেশি বেশি যত্ন দেখালে তা বাড়াবাড়ি হয়ে যায়? কারও প্রতি মাত্রাতিরিক্ত ভালোবাসা বলে কি কোনো জিনিস আছে?

এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে আমাদেরকে প্রথমে নিজেরদের জীবনের গণ্ডি থেকে বের হয়ে আসতে হবে। আমাদের খুঁজে দেখতে হবে, আমরাই প্রথম বা শেষ কিনা, যারা কষ্ট এবং অন্যায়ের শিকার। যে মানুষগুলো আমাদের আগে পৃথিবীতে ছিল তাদের জীবনের দিকে দৃষ্টিপাত করতে হবে। তাদের সংগ্রাম এবং তাদের বিজয় নিয়ে আমাদের চিন্তাভাবনা করতে হবে। আমাদের বুঝতে হবে, কষ্ট ছাড়া কখনোই কোনো অগ্রগতি আসেনি এবং সাফল্যের একমাত্র পথ হলো সংগ্রাম। উপলব্ধি করতে হবে, জীবন সংগ্রামের অবিচ্ছেদ্য অংশ হলো কষ্টভোগ করা এবং অন্যদের দেওয়া দুঃখকষ্ট এবং ক্ষতিকে জয় করা।

আমাদের নবীদের উজ্জ্বল দৃষ্টান্তসমূহ স্মরণ করলে আমরা দেখতে পাই যে, দুঃখকষ্ট ভোগ করা শুধু আমাদের জন্য কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। মনে রাখবেন, নূহ (আ) তাঁর জাতির লোকদের দ্বারা ৯৫০ বছর ধরে অত্যাচারীত হয়েছিলেন। কুরআন আমাদের বলে :

“তাদের পূর্বে নূহের সম্প্রদায়ও অস্বীকার করেছিল। তারা আমার বান্দাকে অস্বীকার করেছিল এবং এবং বলেছিল, ‘পাগল।’ আর তাকে হুমকি দেওয়া হয়েছিল।”
[সূরা আল-কামার; ৫৪ : ৯]

নূহের (আ) উপর এত বেশী অত্যাচার করা হয়েছিল যে:

“তিনি তার পালনকর্তাকে ডেকে বললেনঃ আমি পরাভূত, অতএব, তুমি সাহায্য করো।” [আল-কামার; ৫৪ : ১০]

নবীর (সা) কথাই মনে করে দেখুন, কীভাবে তাঁকে পাথর মেরে রক্তাক্ত করা হয়েছিল। কীভাবে তাঁর সাহাবীদের প্রহার করা হয়েছিল। কীভাবে তারা অনাহারে দিন পার করেছিলেন। অন্য মানুষরাই তাদেরকে এভাবে কষ্ট দিয়েছিল। এমনকি আমরা অস্তিত্বে আসার পূর্বেই ফেরেশতারা মানুষের এই ধরণের চারিত্রিক দিকটি বুঝতে পেরেছিল। আল্লাহ্‌ যখন বললেন যে, তিনি মানুষ সৃষ্টি করতে যাচ্ছেন, তখন ফেরেশতারা প্রথম যে প্রশ্নটি করেছিল তা ছিল মানুষের ক্ষতিকর সম্ভাবনা সম্পর্কে। আল্লাহ্‌ রাব্বুল ‘আলামীন বলেন :

“আর স্মরণ করুন, যখন আপনার রব ফেরেশতাদের বললেন : ‘নিশ্চয়ই আমি যমিনে একজন খলিফা সৃষ্টি করছি’, তারা বলল, আপনি কি সেখানে এমন কাউকে সৃষ্টি করবেন, যে তাতে ফাসাদ করবে এবং রক্ত প্রবাহিত করবে? আর আমরা তো আপনার প্রশংসায় তাসবীহ্‌ পাঠ করছি এবং আপনার পবিত্রতা ঘোষণা করছি। তিনি বললেন, ‘নিশ্চয়ই আমি জানি যা তোমরা জানো না।’ ” [আল-বাকারাহ্‌; ২ : ৩০]

মানুষ জাতির একে অপরের বিরুদ্ধে ঘৃণিত অপরাধ সংঘটনের এই প্রবণতা একটি দুঃখজনক বাস্তবতা। তবে আমাদের অনেকেই অনেক সৌভাগ্যবান। আমাদের অধিকাংশকেই কখনো এমন কোনো দুঃখকষ্টের শিকার হতে হয়নি অন্যরা প্রতিনিয়তই যার শিকার হচ্ছে। আমাদেরকে অনেককেই কোনোদিন নিজের চোখে দেখতে হবে না যে, আমাদের পরিবার পরিজনের কাউকে নির্যাতন করে খুন করা হচ্ছে। তারপরও এমন মানুষ খুব কমই আছে, যারা বলতে পারে, তারা কোনোদিনও কোনোভাবে অন্য কারও দ্বারা কষ্ট পায়নি। সুতরাং, যদিও আমাদের অনেকেই কোনোদিন জানবে না অনাহারে ক্ষুধার যন্ত্রণায় মরার কষ্টটা কী; নিজের চোখের সামনে নিজের বাড়িঘর ধ্বংস করতে দেখার অনুভূতিটা কেমন, তথাপি আমার অনেকেই জানি আহত হৃদয়ের কান্নার অনুভূতিটা কেমন।

আচ্ছা, এসব কি এড়ানো সম্ভব? আমার মনে হয়, কিছুটা হলেও সম্ভব। আমরা কখনোই সকল দুঃখকষ্টকে এড়াতে পারব না। তবে আমদের প্রত্যাশা, আমাদের প্রতিক্রিয়া এবং আমাদের মনোযোগকে পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নেওয়ার মাধ্যমে অনেক ধ্বংসযজ্ঞই এড়ানো সম্ভব।

উদাহারনস্বরূপ বলা যায়, আমদের আশা, ভরসা, বিশ্বাস — সবকিছুকে অন্য একজন মানুষের উপর সমর্পণ করাটা একেবারেই অবস্তবিক এবং ডাহা বোকামি। আমদের মনে রাখতে হবে, ভুল করা মানুষের সৃষ্টিগত স্বভাব। তাই আমাদের চূড়ান্ত বিশ্বাস, আস্থা, এবং প্রত্যাশা শুধুমাত্র আল্লাহ্‌র প্রতি সমর্পণ করা উচিত। আল্লাহ্‌ বলেন :

“যে ব্যক্তি তাগূতকে অস্বীকার করে এবং আল্লাহ্‌র প্রতি ঈমান আনে, অবশ্যই সে মজবুত রশি আঁকড়ে ধরে, যা ছিন্ন হবার নয়। আর আল্লাহ্‌ সর্বশ্রোতা এবং সর্বজ্ঞ।” [আল-বাকারাহ্‌; ২ : ২৫৬]

“আল্লাহ্‌র প্রতি ঈমান এমন মজবুত এক রশি যা ছিন্ন হবার নয়।” — শুধু এই কথাটি যদি আমরা স্মরণে রাখি, তাহলে অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত হতাশা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।

একথা বলার অর্থ কিন্তু এই নয় যে, আমরা ভালোবাসবো না বা ভালোবাসলেও কম করে বাসবো। তবে কীভাবে ভালোবাসবো সেটাই হলো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আল্লাহ্‌ ছাড়া অন্য কাউকেই বা কোনো কিছুকেই সর্বোচ্চ ভালোবাসা যাবে না। অন্তরে আল্লাহ্‌ ব্যতীত আর কোনো কিছুকেই অগ্রাধিকার দেওয়া যাবে না। আর আল্লাহ্‌ ব্যতীত কোনো কিছুকেই এত বেশী ভালোবাসা যাবে না যাতে করে ওই বস্তু ছাড়া জীবন চলা আমাদের জন্য অসম্ভব হয়ে পড়ে। এই ধরনের “ভালোবাসা” ভালোবাসাই নয়। এটা এক ধরনের পূজা করা। এই ভালোবাসায় কষ্ট ছাড়া আর কিছু নেই।

তারপরও যদি কেউ এমন করে ভালোবাসে এবং অন্যের দ্বারা আঘাত বা কষ্ট পায়, তাহলে অনিবার্য পরিণতিটা কী দাঁড়ায়? সবচেয়ে কঠিন কাজটা আমরা কীভাবে করতে পারি? কীভাবে আমরা অন্যকে ক্ষমা করতে শিখব? কীভাবে মনের ক্ষতগুলোকে সারিয়ে তুলে, তাদের সাথে সদাচরণ বজায় রাখব যারা নিজেরাই আমাদের সাথে ভালো ব্যবহার করে না?

আবূ বাক্‌র (রা) এর ঘটনাটি ঠিক এমন পরিস্থিতির একটি চমৎকার উদাহরণ। যখন তাঁর মেয়ে, ‘আয়েশা (রা) সম্পর্কে জঘন্যতম অপবাদ রটানো হলো, তিনি জানতে পারলেন, এই অপবাদটা রটিয়েছিল মিস্‌তাহ্‌ নামে তারই এক চাচাতো ভাই যাকে তিনি বহুদিন ধরে আর্থিকভাবে সাহায্য সহযোগিতা করে আসছিলেন। সঙ্গত কারণেই আবূ বাক্‌র অপবাদ আরোপকারীর সাহায্য বন্ধ করে দিলেন। সামান্য সময় পরেই আল্লাহ্‌ নিম্নোক্ত আয়াত অবতীর্ণ করলেন :

“আর তোমাদের মধ্যে যারা মর্যাদা ও প্রাচুর্যের অধিকারী, তারা যেন এমন কসম না করে যে, তারা নিকটাত্মীয়দের, মিসকীনদের ও আল্লাহ্‌র পথে হিজরতকারীদেরকে কিছুই দেবে না। আর তারা যেন তাদের ক্ষমা করে এবং তাদের দোষক্রটি উপেক্ষা করে। তোমরা কি কামনা করো না যে, আল্লাহ্‌ তোমাদের ক্ষমা করে দেন? আর আল্লাহ্‌ বড়ই ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।” [আন-নূর; ২৪:২২]

এই আয়াত শুনেই আবূ বাক্‌র (রা) বুঝতে পারলেন যে, তিনি নিজেই আল্লাহ্‌র ক্ষমা চান। তাই তিনি শুধু সেই লোককে সাহায্য দেওয়া চালুই করলেন না, এখন আগের চেয়ে বেশি করে দিতে লাগলেন।

মু’মিন হওয়ার মূলেই হলো এইভাবে ক্ষমা করে দেওয়া। এই ধরণের মু’মিনদের বর্ণনা দিয়ে আল্লাহ্‌ বলেন :

“আর যারা গুরুতর পাপ ও অশ্লীল কার্যকলাপ থেকে বেঁচে থাকে এবং যখন রাগান্বিত হয় তখন তারা ক্ষমা করে দেয়।” [আশ-শূরা; ৪২:৩৭]

‘আমি নিজেও  ভুল করি, অন্যদের কষ্ট দেয়’ — নিজের সম্পর্কে এই ধরণের সচেতনতা বোধ দ্বারা অন্যকে তাৎক্ষনিকভাবে ক্ষমা করে দেওয়ার ক্ষমতাটা উদ্বুদ্ধ হওয়া উচিত। সবচেয়ে বড় কথা হলো, এই বিষয়টির মাধ্যমেই আমাদের বিনম্রতা উজ্জীবিত হওয়া উচিত যে, আমারা প্রতিদিন পাপ করার মাধ্যমে আল্লাহ্‌র প্রতি অন্যায় করছি। আল্লাহ্‌র সাথে তুলনা করলে মানুষ তো কিছুই না। তারপরও বিশ্বজগতের প্রতিপালক, আল্লাহ্‌ আমাদের প্রতিনিয়ত ক্ষমা করে দিচ্ছেন। তাহলে ক্ষমা না করে মানুষকে বেঁধে রাখার আমরা কে? নিজেরা যদি আল্লাহ্‌র কাছে ক্ষমা পাওয়ার আশা করি, তাহলে আমরা অন্যদেরকে ক্ষমা করতে পারি না কেন? আর এ কারণেই নবী (সা) আমাদেরকে শিক্ষা দিয়েছেন :

“যারা অন্যের প্রতি দয়া করে না, আল্লাহ্‌ও তাদের প্রতি দয়া করবেন না।” [মুসলিম; অধ্যায় ৩০, হাদীস নং ৫৭৩৭]

আল্লাহ্‌র দয়া লাভের আশা যেন আমাদের অন্যদের প্রতি দয়া করতে উদ্বুদ্ধ করে এবং একদিন সেই দুনিয়ার নিয়ে যায় যা বাস্তবিক অর্থেই নিখুঁত, ত্রুটিহীন, পরিপূর্ণ, অনুপম, অতুলনীয়।

পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার

$
0
0

respectyourparentsঅনুবাদ ও গ্রন্থনা: আব্দুল্লাহিল হাদী

দীর্ঘ দিন সীমাহীন কষ্ট ও অবর্ণনীয় যাতনা সহ্য করে মা সন্তানকে গর্ভে ধারণ করেন। মায়ের পেটে সন্তান যতই বৃদ্ধি পেতে থাকে তার কষ্টের মাত্রা ততই বাড়তে থাকে। মৃত্যু যন্ত্রনা পার হয়ে যখন সন্তান ভূমিষ্ট হয় তখন এ নবজাতককে ঘিরে মায়ের সব প্রত্যশা এবং স্বপ্ন ঘুরপাক খেতে থাকে। এই নবজাতকের ভিতর সে দেখতে পায় জীবনের সব রূপ এবং সৌন্দর্য। যার ফলে দুনিয়ার প্রতি তার আগ্রহ এবং সম্পর্ক আরো গভীরতর হয়। পরম আদর-যত্নে সে শিশুর প্রতিপালনে ব্যাস্ত হয়ে পড়ে। নিজের শরীরের নির্যাস দিয়ে তার খাবারের ব্যাবস্থা করে। নিজে কষ্ট করে তাকে সুখ দেয়। নিজে ক্ষুর্ধাত থেকে তাকে খাওয়ায়। নিজে নির্ঘূম রাত কাটায় সন্তানের ঘুমের জন্য। মা পরম আদর আর সবটুকু ভালোবাসা দিয়ে সন্তানকে ঘিরে রাখে সর্বক্ষণ। সন্তান কোথাও গেলে আল্লাহর নিকট দুআ করে যেন তার সন্তান নিরাপদে ঘরে ফিরে আসে। সন্তানও যে কোন বিপদে ছুটে আসে মায়ের কোলে। পরম নির্ভরতায় ভরে থাকে তার বুক। যত বিপদই আসুক না কেন মা যদি বুকের সাথে চেপে ধরে কিংবা স্নেহ মাখা দৃষ্টিতে একবার তাকায় তাহলে সব কষ্ট যেন নিমিষেই উধাও হয়ে যায়। এই হল মা।

আর পিতা? তাকে তো সন্তানের মুখে এক লোকমা আহার তুলে দেয়ার জন্য করতে হয় অক্লান্ত পরিশ্রম। মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হয়। সহ্য করতে হয় কতধরণের কষ্ট এবং ক্লেশ। সন্তানের জন্যই তো তাকে কখনো কখনো কৃপনতা করতে হয়। কখনো বা ভীরুতার পরিচয় দিতে হয়। সন্তান কাছে গেলে হাঁসি মুখে তাকে বুকে টেনে নেয়। তার নিরাপত্তা ও শান্তির জন্য সে যে কোন ধরণের বিপদের সম্মুখীন হওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকে। ইত্যাদি কারণে আমাদের অস্তিতের প্রতিটি কোণা পিতা-মাতার নিকট ঋণী। আর তাই তো আল কুরআনে আল্লাহ তা’আলার ইবাদতের পরই পিতা-মাতার প্রতি সদাচারণ করার কথা উচ্চারিত হয়েছে বার বার। ইরশাদ হচ্ছেঃ

وَقَضَى رَبُّكَ أَلَّا تَعْبُدُوا إِلَّا إِيَّاهُ وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَاناً إِمَّا يَبْلُغَنَّ عِنْدَكَ الْكِبَرَ أَحَدُهُمَا أَوْ كِلاهُمَا فَلا تَقُلْ لَهُمَا أُفٍّ وَلا تَنْهَرْهُمَا وَقُلْ لَهُمَا قَوْلاً كَرِيماً

“তোমার প্রতিপালক নির্দেশ দিয়েছেন যে, তোমরা তিনি ছাড়া অন্য কারো ইবাদত করবে না এবং পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার করবে; তাদের একজন অথবা উভয়ে উভয়েই তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হলেও আদেরকে বিরক্তি সূচক কিছু বলো না। এবং তাদেরকে ভর্র্ৎসনা করো না; তাদের সাথে কথা বলো সম্মান সূচক নম্র কথা।” [সূরা বনী ইসরাঈলঃ ২৩]

আল কুরআনের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষ্যকার, প্রখ্যাত সাহাবী অবদুল্লাহ ইবন আব্বাস (রাঃ) বলেনঃ আল কুরআনে এমন তিনটি আয়াত আছে যেখানে তিনটি জিনিস তিনটি জিনিসের সাথে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। একটি ছাড়া অন্যটি অগ্রহণযোগ্য। সে তিনটি আয়াত হলঃ

১) আল্লাহ তাআলা বলেন,

"হে মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর এবং আনুগত্য কর তার রাসূলের। এবং (তাদের বিরুদ্ধাচারণ করে) নিজেদের আমল বিনষ্ট কর না।" [সূরা মুহাম্মাদ: ৩৩]

কেউ যদি আল্লাহর আনুগত্য করে কিন্তু রাসূলের আনুগত্য না করে তাহলে তা আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না।

২) আল্লাহ তায়ালা বলেন,

"এবং তোমরা সালাত (নামায) আদায় কর এবং যাকাত দাও।" [সূরা বাক্বারাঃ ৪৩]

কেউ যদি নামায পড়ে কিন্তু যাকাত দিতে রাজী নয় তাহলে তাও আল্লাহর দরবারে গ্রহণীয় নয়।

৩) আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ

“আমার কৃতজ্ঞতা এবং তোমার পিতা-মাতার কৃতজ্ঞতা আদায় কর।” [সূরা লোকমানঃ ১৪]

কেউ যদি আল্লাহর কৃতজ্ঞতা আদায় করে কিন্তু পিতা-মাতার কৃতজ্ঞতা আদায় না করে তবে তা আল্লাহর নিকট প্রত্যাখ্যাত।

সে কারণেই মহাগ্রন্থ আল কুরআনে একাধিকবার আল্লাহর আনুগত্যের নির্দেশের সাথে সাথে পিতা-মাতার আনুগত্য করার প্রতি নির্দেশ এসেছে। ধ্বনীত হয়েছে তাদের সাথে খারাপ আচরণ করার প্রতি কঠিন হুশিয়ারী। তা যে কোন কারণেই হোক না কেন। ইরশাদ হচ্ছেঃ

وَاعْبُدُوا اللَّهَ وَلا تُشْرِكُوا بِهِ شَيْئاً وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَاناً

“তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর। এবং তার সাথে কাউকে শরীক কর না আর পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার কর।” [সূরা নিসাঃ ৩৬]

আল্লাহ তাআলা আরো ইরশাদ করেনঃ

وَوَصَّيْنَا الْأِنْسَانَ بِوَالِدَيْهِ حُسْناً

“আমি মানুষকে নির্দেশ দিয়েছি তার পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার করতে।” [সূরা আনকাবূতঃ ৮]

তিনি আরও বলেনঃ

وَوَصَّيْنَا الْأِنْسَانَ بِوَالِدَيْهِ حَمَلَتْهُ أُمُّهُ وَهْناً عَلَى وَهْنٍ وَفِصَالُهُ فِي عَامَيْنِ أَنِ اشْكُرْ لِي وَلِوَالِدَيْكَ إِلَيَّ الْمَصِيرُ

“আর আমি তো মানুষকে তার পিতা-মাতার প্রতি সদাচারণের নির্দেশ দিয়েছি। তার জননী তাকে (সন্তানকে) কষ্টের পর কষ্ট বরণ করে গর্ভে ধারণ করে এবং তার দুধ ছাড়ানো হয় দুই বছরে। সুতরাং আমার প্রতি ও তোমার পিতা-মাতার প্রতি কৃতজ্ঞ হও। প্রত্যাবর্তন তো আমারই নিকট।” [সূরা লোকমানঃ ১৪]

উল্লেখিত আয়াতগুলোতে স্পষ্টভাবে পিতা-মাতার মর্যাদা এবং তাদের প্রতি সন্তানদের অধিকারের প্রমান বহন করছে।

প্রিয় নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হাদীস থেকেঃ নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর হাদীস থেকেও এ ব্যাপারে স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়ঃ

১) পিতা-মাতার সন্তুষ্টিতে আল্লাহর সন্তুষ্টিঃ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ

“পিতা-মাতার সন্তুষ্টির উপরই আল্লাহর সন্তুষ্টি আর পিতা-মাতার অসন্তষ্টির উপরই আল্লাহর সন্তুষ্টি নির্ভর করছে।” (ত্ববারানী কাবীর-সহীহ)

২) ফিরে যাও, তাদের মুখে হাঁসি ফোটাওঃ আবদুল্লাহ ইবন আমর ইবন আস (রাঃ) থেকে বর্ণিত,

জনৈক সাহাবী নবী করীম (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর নিকট এসে বললেন, আমি আপনার কাছে এসেছি হিজরত করার জন্য শপথ করতে। আমি যখন আসি আমার পিতা-মাতা কাঁদছিলেন। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, “তাদের কাছে ফিরে যাও, এবং যেমন তাদেরকে কাঁদিয়েছিলে এখন তাদেরকে গিয়ে হাঁসাও।” (আবু দাউদ, নাসাঈ,ইবন মাজাহ-সহীহ)

৩) তার পা ধর, ওখানেই তোমার জান্নাতঃ মুয়া’বিয়া ইবন জাহাম সুহামী নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সাথে জিহাদে যাওয়ার অনুমতি চাইলে তিনি তাকে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে বললেন, “যাও, তোমার আম্মার সেবা কর।” কিন্তু তিনি জিহাদে যাওয়ার জন্য বার বার অনুরোধ জানাতে থাকলে তিনি বললেন, “হায় আফসোস! তোমার মার পা ধরে থাক। ওখানেই তোমার জান্নাত।” (মুসনাদ আহমাদও ইবন মাজাহ্)

৪) পিতার তুলনায় মার অধিকার তিনগুণ বেশীঃ সর্বাধিক হাদীস বর্ণনাকারী সাহাবী আবূ হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত,

একলোক রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর নিকট এসে বলল, হে আল্লাহর রাসূল, আমার উত্তম সংশ্রব পাওয়ার জন্য কে সবচেয়ে বেশী উপযুক্ত? তিনি বললেন, তোমার মা।” লোকটি আবার প্রশ্ন করল, তারপর কে? তিনি বললেন, তোমার মা। সে আবার প্রশ্ন করল, তারপর কে? তিনি বললেন, “তোমার মা।” সে আবার প্রশ্ন করল, তারপর কে? তিনি বললেন, “তোমার পিতা।” (বুখারী-মুসলিম)

অত্র হাদীস প্রমাণ বহন করে, পিতার তুলনায় মা তিনগুণ সদাচারণ পাওয়ার অধিকারী। কারণ, গর্ভে ধারণ, ভুমিষ্ট ও দুগ্ধদানের ক্ষেত্রে কেবল মাকেই অবর্ণনীয় কষ্ট সহ্য করতে হয়। পিতা কেবল সন্তান প্রতিপালনে স্ত্রীর সাথে অংশ গ্রহণ করে। এদিকে ইঙ্গিত করে আল্লাহ ত।আলা ইরশাদ করেনঃ

وَوَصَّيْنَا الْأِنْسَانَ بِوَالِدَيْهِ إِحْسَاناً حَمَلَتْهُ أُمُّهُ كُرْهاً وَوَضَعَتْهُ كُرْهاً وَحَمْلُهُ وَفِصَالُهُ ثَلاثُونَ شَهْراً

“আমি তো মানুষকে তার পিতা-মাতার প্রতি সদাচারণের নির্দেশ দিয়েছি। তার জননী তাকে (সন্তানকে) গর্ভে ধারণ করেছে কষ্টের সাথে এবং প্রসব করেছে কষ্টের সাথে। তাকে গর্ভে ধারতে ও তার স্তন ছাড়াতে সময় লাগে ত্রিশ মাস।” [আহক্বাফঃ ১৫]

৫) পিতা-মাতার অবাধ্য সন্তানের প্রতি আল্লাহ তা’আলা কিয়ামতের দিন তাকাবেন নাঃ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইরশাদ করেনঃ

তিন শ্রেণীর লোকের প্রতি আল্লাহ তা’আলা তাকাবেন না। তাদের মধ্যে একজন হল, পিতা-মাতার অবাধ্য সন্তান। (সহীহ-নাসঈ, আহমাদ, হাকেম)

৬) পিতা-মাতার অবাধ্য সন্তান জান্নাতে প্রবেশ করবে নাঃ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইরশাদ করেনঃ

তিন শ্রেণীর লোক জান্নাতে প্রবেশ করবে না। তাদের মধ্যে একজন হল, পিতা-মাতার অবাধ্য সন্তান। (সহীহ-নাসঈ, আহমাদ, হাকেম)

৭) তবুও অবাধ্যতা নয়ঃ মু’য়ায (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাকে দশটি বিষয়ে উপদেশ দিয়ে গেছেন। তা হলো, আল্লাহর সাথে শিরক করবে না যদিও তোমাকে কেটে টুকরো টুকরো করে দেয়া হয় এবং আগুনে পুড়িয়ে ছারখার করে দেয়া হয়। এবং পিতা-মাতার অবাধ্য হবে না যদিও তারা তোমাকে তোমার পরিবার, এবং সম্পদ ছেড়ে চলে যেতে বলে…। (মুসনাদ আহমাদ)

নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এবং তাঁর মাঃ

পিতা-মাতার সাথে কিরূপ আচরণ করতে হবে সে ব্যাপারে ইতোপূর্বে প্রিয় নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর একাধিক হাদীস উল্লেখ করা হয়েছে। এখন দেখব নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তার মা-জননীর প্রতি বাস্তব জীবনে আমাদের জন্য কী আদর্শ রেখে গেছেন।

সহীহ্ মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে, হুদায়বিয়া সন্ধির সময় প্রিয় নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাহাবীদের সাথে নিয়ে যাচ্ছিলেন। সাথে আছে এক হাযার ঘোড় সাওয়ার। মক্কা ও মদীনার মাঝে আবওয়া নামক স্থানে তাঁর প্রাণ প্রিয় মা-জননী চির নিদ্রায় শায়িত আছেন। সে পথ দিয়ে যাওয়ার সময় তিনি যাত্রা বিরতী করে তাঁর মা’র কবর যিয়ারত করতে গেলেন। কবরের কাছে গিয়ে তিনি কাঁন্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। তার চর্তুদিকে দাঁড়িয়ে থাকা সাহাবীগণও কাঁদতে লাগলেন। অতঃপর তিনি বললেন, আমি আল্লাহর দরবারে আমার মা’র জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করার অনুমতি চেয়েছিলাম কিন্তু অনুমতি দেয়া হয়নি। কিন্তু তার কবর যিয়ারতের জন্য অনুমতি প্রার্থনা করলে তিনি তাতে অনুমতি দেন। সুতরাং তোমরা কবর যিয়ারত কর। কারণ, কবর যিয়ারত করলে পরকালের কথা স্মরণ হয়।”(সহীহ মুসলিম)

ইবরাহীম (আঃ) এবং তার পিতা-মাতাঃ

ইবরাহীম (আঃ) এর পিতা-মাতা কাফের ছিল। তারপরও তিনি তাদের সাথে অত্যন- বিনয় ও ভদ্রতা সুলোভ আচরণ করতেন। তিনি তার পিতাকে শিরক পরিত্যাগ করে এক আল্লাহর ইবাদত করার জন্য আহবান জানাচ্ছেনঃ

يَا أَبَتِ لِمَ تَعْبُدُ مَا لا يَسْمَعُ وَلا يُبْصِرُ وَلا يُغْنِي عَنْكَ شَيْئاً

আব্বাজান, আপনি কেন এমন জিনিসের ইবাদত করছেন যা শুনে না, দেখে না এবং আপনার কোন উপকারও করতে পারে না? কিন্তু সে তা শুধু প্রত্যাখ্যানই করল না বরং তাকে মেরে-পিটে তাড়িয়ে দেয়ার হুমকি দিল। তখন তিনি শুধু এতটুকুই বলেছিলেনঃ

قَالَ سَلامٌ عَلَيْكَ سَأَسْتَغْفِرُ لَكَ رَبِّي إِنَّهُ كَانَ بِي حَفِيّاً

“আপনাকে সালাম। আমি আপনার জন্য আল্লাহর জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করব।” [সূরা মারইয়ামঃ ৪৭]

ইয়াহয়া (আঃ): আল্লাহ তা’আলা তার প্রশংসা করে বলেনঃ

"সে তার পিতা-মাতার প্রতি সদাচারী ছিল।” [সূরা মারইয়ামঃ ১৪]

এভাবে অনেক নবীর কথা আল কুরআনে উল্লেখ করে আল্লাহ তা’আলা বিশ্ববাসীর সামনে অনুকরণীয় আদর্শ উপস্থাপন করেছেন।

আমাদের পূর্ব পুরুষগণ পিতা-মাতার সাথে সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার করে বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। এসমস্ত মহামনিষীদের মধ্যে আবু হুরাইরা (রাঃ), আবদুল্লাহ্ ইবন্ মাসঊদ (রাঃ), ইবন্ হাসান তামীমী (রহঃ), ইবন আউন মুযানী (রহঃ) প্রমুখের নাম ইতিহাসখ্যাত।

পিতা-মাতার অবাধ্যতার বিভিন্ন রূপঃ পিতা-মাতার অবাধ্যতার বিভিন্ন রূপ হতে পারে যা হয়ত অনেক মানুষের কাছেই অজানা।

১) পিতা-মাতার উপর নিজেকে বড় মনে করা। অর্থ-সম্পদ, শিক্ষা-দীক্ষা, সম্মান-প্রতিপত্তিতে পিতা-মাতার চেয়ে বেশী অথবা অন্য যে কোন কারণেই হোক না কেন নিজেকে বড় বড় মনে করা।

২) পিতা-মাতাকে পিতা-মাতাকে সহায়-সম্বলহীন এবং নিঃস্ব অবস্থায় ফেলে রাখা এবং যার কারণে তারা মানুষের দ্বারে দ্বারে হাত পাততে বাধ্য হয়।

৩) বন্ধু-বান্ধব, স্ত্রী-পুত্র বা অন্য কাউকে, এমনকি নিজের প্রয়োজনকেও পিতা-মাতার উপর অগ্রাধিকার দেয়া তাদের নাফরমানীর অন্তর্ভূক্ত।

৪) পিতা-মাতাকে শুধু নাম ধরে বা এমন শব্দ প্রয়োগে ডাকা যা তাদের অসম্মান ও মর্যাদাহানীর ইঙ্গিত দেয়।

৫) পিতা-মাতার সাথে চোখ রাঙ্গিয়ে ধমকের সাথে কথা বলা।

৬) তাদের সেবা-শশ্রুসা না করা এবং শারিরীক বা মানষিক দিকের প্রতি লক্ষ না রাখা। বিশেষ করে বৃদ্ধ বয়সে বা রোগ-ব্যধিতে তাদের প্রতি অবহেলা প্রদর্শন করা।

পরিশেষেঃ প্রতিটি জ্ঞানবান মানুষের আছে আহবান জানাবো, আসুন, পিতা-মাতার ব্যাপারে অবহেলা করার ব্যাপারে সাবধানত হই। তাদের প্রতি প্রর্দশন করি সর্বোচ্চ সম্মান জনক আচরণ। কারণ এর মাধ্যমেই আমাদের পার্থিব জীবন সুন্দর হবে। গুনাহ-খাতা মাফ হবে। পরকালে মিলবে চির সুখের নিবাস জান্নাত।

মহিমাময় আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা জানাই হে পরওয়ারদেগার, আমাদেরকে আমাদের পিতা-মাতার সাথে চির শান্তির নীড় জান্নাতে একত্রিত করিও। এটাই আমাদের জীবনের সবচেয়ে বড় প্রত্যাশা।

সচ্চরিত্রের সুফল

$
0
0

সংকলনে: শাইখ জাহিদুল ইসলাম | সম্পাদনায়: আব্দুল্লাহিল হাদী

সকল প্রশংসা একমাত্র আল্লাহর জন্য। দরূদ ও সালাম বর্ষিত হোক প্রিয় নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, তাঁর বংশধর, সহচর বৃন্দ ও তাঁর বন্ধুদের উপর। এ লেখাটি ঐ সমস্ত যুবক ও যুবতীদের খিদমতে উপস্থিত করছি, যারা নিজেদেরকে সমস্ত প্রকার কু প্রবৃত্তির চাহিদা এবং নিষিদ্ধ বস্তু থেকে বিরত রাখেছে অথবা বিরত রাখতে চায়। আশা করি তারা এটি পাঠ করে নির্দেশন এবং উৎসাহ পাবে এবং সচ্চরিত্রের উপর প্রতিষ্ঠিত থেকে জীবন পরিচালিত করতে সক্ষম হবে। আল্লাহই একমাত্র সাহায্য কারী।

চরিত্র সৎ ও পবিত্র রাখার ফলাফলগুলো নিম্ন রূপঃ

১) সচ্চরিত্র বান ব্যক্তি জান্নাতে যাবে: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন:

(مَنْ يَضْمَنْ لِي مَا بَيْنَ لَحْيَيْهِ وَمَا بَيْنَ رِجْلَيْهِ أَضْمَنْ لَهُ الْجَنَّةَ)

“যে ব্যক্তি তার দুই চোয়ালের মধ্যবর্তী স্থান (জিহ্বা) এবং দুই উরুর মধ্যবর্তী স্থান (লজ্জা স্থান) হেফাজতের দায়িত্ব নিবে, আমি তার জন্যে জান্নাতের জামিন হলাম।” (বুখারী, অনুচ্ছেদ: জিহ্বার হেফাজত)

২) সচ্চরিত্র বান ব্যক্তি আল্লাহর আরশের ছায়া পাবে:

আবু হুরায়রা (রা:) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন:

سَبْعَةٌ يُظِلُّهُمُ اللَّهُ تَعَالَى فِي ظِلِّهِ يَوْمَ لَا ظِلَّ إِلَّا ظِلُّهُ إِمَامٌ عَادِلٌ وَشَابٌّ نَشَأَ فِي عِبَادَةِ اللَّهِ وَرَجُلٌ قَلْبُهُ مُعَلَّقٌ فِي الْمَسَاجِدِ وَرَجُلَانِ تَحَابَّا فِي اللَّهِ اجْتَمَعَا عَلَيْهِ وَتَفَرَّقَا عَلَيْهِ وَرَجُلٌ دَعَتْهُ امْرَأَةٌ ذَاتُ مَنْصِبٍ وَجَمَالٍ فَقَالَ إِنِّي أَخَافُ اللَّهَ وَرَجُلٌ تَصَدَّقَ بِصَدَقَةٍ فَأَخْفَاهَا حَتَّى لَا تَعْلَمَ شِمَالُهُ مَا تُنْفِقُ يَمِينُهُ وَرَجُلٌ ذَكَرَ اللَّهَ خَالِيًا فَفَاضَتْ عَيْنَاهُ

“যে দিন আল্লাহর ছায়া ছাড়া কোন ছায়া থাকবেনা সে দিন সাত ব্যক্তিকে আল্লাহ তাঁর আরশের নীচে ছায়া দান করবেন। তারা হলেন:

  • (১) ন্যায় পরায়ণ শাসক
  • (২) যে যুবক তাঁর প্রভুর ইবাদতের মাঝে প্রতিপালিত হয়ে বড় হয়েছে।
  • (৩) যে ব্যক্তির মন সর্বদা মসজিদের সাথে সম্পৃক্ত থাকে।
  • (৪) এমন দুই ব্যক্তি, যারা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যে একে অপরকে ভালবাসে। আল্লাহর জন্য তারা পরস্পরে একত্রিত হয় এবং আল্লাহর জন্য পরস্পরে বিচ্ছিন্ন হয়।
  • (৫) এমন পুরুষ যাকে একজন সুন্দরী ও সম্ভ্রান্ত বংশের মহিলা নিজের দিকে আহবান করে, আর সে পুরুষ বলে: আমি আল্লাহকে ভয় করি। (তাই তোমার ডাকে সাড়া দেয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়)।
  • (৬) যে দানশীল ব্যক্তি এমন গোপনে দান করে, ডান হাত দিয়ে যা দান করে, বাম হাত তা অবগত হতে পারেনা। অর্থাৎ তিনি কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্যেই দান করেন। তাই মানুষকে শুনানো বা দেখানোর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেনা।
  • (৭) যে ব্যক্তি নির্জনে বসে আল্লাহকে স্মরণ করে চোখের পানি প্রবাহিত করে।” (সহীহ বুখারী, অনুচ্ছেদ: ডান হাতে সদকা করা)

৩) সচ্চরিত্রতা পরিবারকে পবিত্র রাখে:

যে ব্যক্তি মানুষের সম্মান-মর্যাদা নষ্ট করবে আল্লাহ তা’আলা তার সম্মান-মর্যাদা নষ্ট করে দিবেন এবং তার গোপনীয়তাকে প্রকাশ করে দিবেন। যেমন ইমাম শাফে’য়ী (রহ:) বলেন, যদি তুমি পবিত্র থাকো তাহলে বাড়িতে তোমাদের পরিবারগণও পবিত্র থাকবে। অত:এব তোমরা সকল অশ্লীল কর্ম-কাণ্ড থেকে দূরে থাক । জিনা একটি ঋণস্বরূপ। তুমি যদি তা কাউকে ঋণ দাও তাহলে জেনে রেখো, তোমার পরিবার দ্বারা হলেও সে ঋণ শোধ করা হবে। যে ব্যক্তি জিনা করবে সেও জিনার শিকার হবে, যদিও তার বাড়ির দেওয়ালের দ্বারাও হয়ে থাকে।

৪) চারিত্রিক পবিত্রতা বিপদ-আপদ থেকে নিরাপদ রাখার মাধ্যম:

চরিত্র পবিত্র রাখার মাধ্যমে যাবতীয় অন্যায়, ফ্যাসাদ ও বিভিন্ন প্রকার ধ্বংসাত্মক রোগ-ব্যাধি, যেমন এইডস, সিফিলিস, গনোরিয়া আর ইত্যাদি যৌন রোগ থেকে নিরাপদ থাকার অন্যতম মাধ্যম।

৫) চারিত্রিক পবিত্রতা আল্লাহর গজব থেকে দূরে রাখে:

উমর (রা:) থেকে বর্ণিত আছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:

(لَمْ تَظْهَرِ الْفَاحِشَةُ فِيْ قَوْمٍ قَطُّ حَتَّى يَعْمَلُوْا بِهَا إَلَّا ظَهَرَ فِيْهُمُ الطَّاعُوْنُ وَالْأَوْجَاعُ الَّتِيْ لَمْ تَكُنْ مَضَتْ فِيْ أَسْلَافِهِمْ)

“যখনই কোন জাতির মাঝে অশ্লীলতা দেখা দিয়েছে, আর উহাতে তারা প্রকাশ্যে ও গোপনে লিপ্ত হয়েছে, তখনই সেই জাতির মধ্যে দেখা দিয়েছে প্লেগ ও এমন এমন জটিল রোগ, যা তাদের পূর্ববর্তী জাতিদের মধ্যে ছিল না” (হাকেম, হাসান, সিলসিলাহ সহীহা)

৬) চরিত্রবান ব্যক্তি দ্বিগুণ সোয়াব পাবে:

কেননা যখনই কোন ফিতনা-ফ্যাসাদ এবং অন্যায় বৃদ্ধি পায়, তখনই তাকওয়া ও ধৈর্যের মাধ্যমে উহা হতে একধাপ উপরে উঠে উক্ত অন্যায় থেকে বেঁচে থাকা আবশ্যক হয়ে যায়, যা সেই ব্যক্তিকে মহান সুবিচারকের পাল্লায় পরিপূর্ণ সোয়াব ও প্রতিদানে বাধিত করে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:

العِبَادَةُ فِى الْهَرْجِ كَهِجْرَةٍ إِلَيّ

“ফিতনার মধ্যে ইবাদত করা আমার দিকে হিজরত করার ন্যায়। (মুসলিম, অনুচ্ছেদ, ফিতনার সময় ইবাদত করা)  আরও উল্লেখ আছে, ঐ অবস্থায় একজন আমলকীকে পঞ্চাশ জন আমলকারীর আমলের সমপরিমাণ সোয়াব দেয়া হবে।

৭) চরিত্রবান ব্যক্তি ইবাদতে উৎসাহ পায়:

সংযমতা ও পবিত্রতার মাধ্যমে মনোবল ও তাকওয়া বৃদ্ধি পায় এবং কু প্রবৃত্তি পরাভূত হয়। মহান আল্লাহ বলেন:

وَأَمَّا مَنْ خَافَ مَقَامَ رَبِّهِ وَنَهَى النَّفْسَ عَنِ الْهَوَى. فَإِنَّ الْجَنَّةَ هِيَ الْمَأْوَى

“পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি নিজ প্রতিপালকের সামনে দাঁড়ানোর ভয় রেখেছে এবং কু প্রবৃত্তি হতে নিজেকে বিরত রেখেছে, অবশ্যই জান্নাতই হবে তার প্রকৃত ঠিকানা।” (সুরা আন্-নাযিয়াহঃ ৪১)

দৃঢ় ইচ্ছাশক্তিই হল চরিত্র গঠনের মূলভিত্তি। আর ইহাই একজন মুসলিম ব্যক্তিকে সকল নিকৃষ্ট চরিত্র থেকে মুক্ত করে উত্তম চরিত্রে ভূষিত করে। সেই সাথে সকল প্রকার ভাল গুণ অর্জনে সহযোগিতা করে ও সর্ব প্রকার নিকৃষ্ট গুণ থেকে দূরে রাখে। আল্লাহ তা’আলা বলেন:

وَمَنْ أَرَادَ الْآخِرَةَ وَسَعَى لَهَا سَعْيَهَا وَهُوَ مُؤْمِنٌ فَأُولَئِكَ كَانَ سَعْيُهُمْ مَشْكُوراً

“যারা বিশ্বাসী হয়ে পরলোক কামনা করে এবং ওর জন্যে যথাযথ চেষ্টা করে তাদের চেষ্টা স্বীকৃত হয়ে থাকে”। (সূরা বানী ইসরাঈলঃ ১৯)

৮) বিপদাপদ থেকে মুক্তি:

যেমনটি অর্জিত হয়েছিল গুহাবাসী তিন ব্যক্তির জন্যে। যখন পাথর গড়িয়ে এসে তাদের গুহার মুখ বন্ধ করে দিয়েছিল। তখন তাদের একজন বলল, হে আল্লাহ! আমার একটি চাচাতো বোন ছিল। তাকে আমি সকল মানুষের চেয়ে বেশী ভাল বাসতাম। এক সময় আমি তার সাথে আমার মনের বাসনা পূরণ করতে ইচ্ছা পোষণ করলে সে প্রত্যাখ্যান করল। কোন এক বছর ভীষণ দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে সে আমার কাছে আসল, তখন আমি তাকে ১২০ দিনার দিতে রাজি হলাম। এই শর্তে যে, সে আমার মনের বাসনা পূরণ করার লক্ষ্যে সব ধরনের রাস্তা খুলে দিবে। তখন সে সম্মতি জানাল।অ:পরযখন আমি তার সাথে কাম বাসনায় লিপ্ত হওয়ার পুরাপুরি প্রস্তুত তখন সে আমাকে বলল, আল্লাহকে ভয় কর এবং আমার সতীত্ব নষ্ট করো না। একথা শুনে আমি তাকে ছেড়ে দিলাম। অথচ সে ছিল আমার কাছে সকল মানুষের চেয়ে অধিক প্রিয়। আমি তাকে যে স্বর্ণ-মুদ্রা প্রদান করেছিলাম, তাও ছেড়ে চলে আসি। অতএব হে আল্লাহ! আমি যদি এই কাজটি আপনার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে করে থাকি, তাহলে আমরা যেই সংকটের মধ্যে রয়েছি, সেই সমস্যা-সংকট থেকে আমাদেরকে পুরাপুরি উদ্ধার করুন। তখন পাথরটি তাদের গুহার মুখ থেকে সরে গেল। অতঃপর তারা গুহা থেকে বের হয়ে চলে আসল।

পরিশেষে আল্লাহ তা’আলার কাছে প্রার্থনা জানাই, তিনি যেন আমাদেরকে তাঁর সৎ ও যোগ বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত করেন।

হে আল্লাহ আমাদেরকে উপকারী ইলম ও সৎ আমলের তাওফিক দান করুন।সমস্ত মুসলমানদের আমলসমূহ সংশোধন করুন ও তাদের পথ ভ্রষ্টদের সঠিক পথে পরিচালিত করুন ।তাদেরকে পুরাপুরি হেদায়েতের পথে ফিরিয়ে দিন। দরূদ, সালাম ও শান্তি বর্ষিত হউক আমাদের নবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর পরিবার বর্গ এবং সমস্ত সাহাবাদের উপর। আমিন।

দাঁড়িয়ে সম্মান প্রদর্শনের ব্যাপারে ইসলামের বিধান

$
0
0

flower-game-screenshot-2

শাইখ সালিহ আল মুনাজ্জিদ

প্রশ্নঃ কারও আগমনের সাথে উঠে দাঁড়িয়ে সম্মান প্রদর্শনের ব্যাপারে ইসলামের বিধান কি?

সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্যে

কারও আগমনের সাথে উঠে দাঁড়ানোর ব্যাপারে শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়াহ একটি বিস্তারিত উত্তর প্রদান করেছেন, শরীয়াহর দলীলের উপর ভিত্তি করে, তাঁর এ মতামত উল্লেখ করা হলঃ

“রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কিংবা খোলাফায়ে রাশেদীনের সমকালীন সালাফগণের কারোরই এই রীতি বা অভ্যাস ছিল না যে তাঁরা প্রতিবার নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে) দেখামাত্রই উঠে দাঁড়িয়ে যেতেন, যেটা অনেক মানুষ করে থাকে । বরং আনাস বিন মালিক রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, “সাহাবায়ে কিরামের নিকট রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অপেক্ষা কোন ব্যক্তিই অধিক প্রিয় ছিলো না। অথচ তাঁরা যখন তাঁকে দেখিতেন তখন দাঁড়াতেন না। কেননা, তাঁরা জানতেন যে, তিনি ইহা পছন্দ করেন না”। ( তিরমিযি ২৭৫৪, সহীহ তিরমিযিতে হাদীসটি আলবানী কর্তৃক সহীহ) কিন্তু তাঁরা তাঁর জন্যে দাঁড়াতে পারতেন যে বাইরে থেকে ফিরত, তাকে স্বাগত জানানোর জন্যে, যেমন বর্ণিত হয়েছে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইকরিমা’র জন্য উঠে দাঁড়ান, এবং তিনি আনসারগণকে বলেছিলেন যখন সা’দ বিন মুয়াজ এসেছিলেন, “তোমরা তোমাদের সর্দারের জন্য উঠে দাঁড়াও”; (বুখারী ৩০৪৩, মুসলিম ১৭৬৮)। আর এই ঘটনাটি ছিল যখন তিনি বনু কুরাইজার ব্যাপারে বিচারের রায় প্রদান করতে এসেছিলেন কারণ তারা বলেছিল যে তাঁর রায় তারা গ্রহণ করবে।

মানুষের যা করা উচিত তা হল রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সমকালীন সালাফগণের রীতি-পদ্ধতি অনুসরণ করা, কারণ তারা হলেন সর্বোত্তম প্রজন্ম এবং সর্বোত্তম বাণী হল আল্লাহর বাণী, এবং সর্বোত্তম পথ নির্দেশনা হল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর পথ নির্দেশনা। কেউ যেন মানব জাতির শ্রেষ্ঠ ব্যক্তির পথ নির্দেশনা থেকে মুখ ফিরিয়ে না নেয়, কিংবা শ্রেষ্ঠ প্রজন্মের পথ নির্দেশনা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে এর থেকে নিকৃষ্ট কিছু অনুসরণ করে। এবং নেতা কিংবা প্রধানগণ যেন সাধারণের মাঝে এমন কোন কিছুর অনুমোদন প্রদান না করেন যে তাকে দেখামাত্রই সাধারণ লোকদের উঠে দাঁড়াতে হবে, বরং মানুষের উচিত হল সহজ-সাধারণ আচরণের দ্বারা তাকে স্বাগত জানানো।

আর দূর থেকে ভ্রমণ করে ফিরে এসেছে এমন লোকের ব্যাপারে উঠে দাঁড়ানোর উদ্দেশ্য যদি হয় তাকে স্বাগত জানানো তাহলে তা সুন্দর আচরণ। আর জনসাধারণের রীতিনীতি যদি এমন হয় যে, উঠে দাঁড়ানোর মাধ্যমে আগত ব্যক্তিকে সম্মান দেখানো হয় এবং যদি তারা উঠে না দাঁড়ায় তাহলে সে ব্যক্তি অপমানিত বোধ করে কিংবা সে ব্যক্তি সুন্নাহ অনুসারে আচরণ জানে না, সেক্ষেত্রে আগত ব্যক্তির জন্যে উঠে দাঁড়ানোই অপেক্ষাকৃত ভালো আচরণ, কারণ এর দ্বারা তাদের মধ্যে একটি ভালো সম্পর্ক তৈরি হতে পারে এবং তাদের অন্তর থেকে ঘৃণা ও বিদ্বেষ দূর করে দিবে। কিন্তু লোকটি যদি সুন্নাহ অনুসারে আচরণ সম্পর্কে অভ্যস্ত থাকে তাহলে উঠে না দাঁড়ানো তাকে অপমানিত করবে না।

নবাগত ব্যক্তির জন্যে উঠে দাঁড়ানোর ব্যাপারে সেই কথা বলা হয়নি যা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এভাবে বলেছেন, “যে ব্যক্তি ইহাতে আনন্দ পায় যে, লোকজন তাহার জন্য দাঁড়ানো অবস্থায় স্থির হয়ে থাকুক, তবে সে যেন নিজের জন্য জাহান্নামে বাসস্থান নির্ধারণ করে নেয়”। (আবু দাউদ,তিরমিযি ২৭৫৫, আলবানী কর্তৃক সহীহ তিরমিযি)। এর মানে হল (একথা বলা হয়েছে সেই ব্যক্তির জন্যে) কারও জন্য উঠে দাঁড়ানো হল অথচ সেই ব্যক্তি নিজে বসে আছে, নবাগত ব্যক্তিকে স্বাগত জানানোর জন্য উঠে দাঁড়ানোর ব্যাপারে এই কথা বলা হয়নি। একারণেই উলামাগণ এই দুই ধরণের উঠে দাঁড়ানোর মধ্যে পৃথকীকরণ করেছে্‌ন, কারণ যারা নবাগত ব্যক্তিকে স্বাগত জানানোর জন্যে উঠে দাঁড়ায় তারা তার সাথে একইভাবে (দাঁড়ানো) অবস্থায় আছে কিন্তু কোন ব্যক্তি নিজে বসে আছে অথচ লোকেরা তার জন্যে উঠে দাঁড়ায় উভয় ঘটনা এক নয়।

সহীহ মুসলিমে প্রমাণিত আছে, যখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অসুস্থতার দরুণ বসা অবস্থায় সালাতের ইমামতি করলেন, তাঁরা দাঁড়িয়ে সালাত আদায় করলেন, তিনি তাঁদের বসতে বললেন এবং বললেন, “পারসিরা যেভাবে একে অপরকে সম্মান দেখায় সেভাবে আমাকে সম্মান প্রদর্শন করো না” [১]। আর তিনি নিজে বসা অবস্থায় তাদেরকে দাঁড়িয়ে সালাত আদায় করতে নিষেধ করলেন, যেন সাহাবাগণের সাথে এতটুকু সাদৃশ্যও না থাকে যেভাবে পারস্য দেশের লোকেরা তাদের নেতাদের জন্য দাঁড়িয়ে অথচ তাদের নেতারা বসে থাকে।

পরিশেষে, যত বেশি সম্ভব সালাফগণের আচরণ ও রীতিনীতি অনুসরণ করাই হল সর্বোত্তম আচরণ।

যদি কোন ব্যক্তি এতে বিশ্বাস স্থাপন না করে এবং এই ধরণের আচরণে অভ্যস্ত না হয়, এবং যেভাবে (প্রচলিত পদ্ধতিতে) লোকেরা তাকে সম্মান দেখায় সেভাবে সম্মান প্রদর্শন না করাতে যদি সে আরও মন্দ কোন পরিণতির দিকে নিয়ে যায় তবে সেক্ষেত্রে আমরা কম ক্ষতির কাজটি করে বেশি ক্ষতির থেকে নিজেদের রক্ষা করব এবং তাই করব যা ছোট উপকারের চেয়ে বড় উপকার করে থাকে ”।

- ইমাম ইবনে তাইমিয়াহ’র উক্তি সমাপ্ত।

যে বিষয়টি এই আলোচনা আরও স্পষ্ট করে তুলতে পারে তা হল, সহীহাইনে আলোচিত কা’ব ইবন মালিকের ঘটনাটি, যখন আল্লাহ্‌ তাঁর এবং তাঁর দুইজন সঙ্গীর তাওবা কবুল করলেন, যেখানে বর্ণিত আছে, যখন কা’ব মসজিদে প্রবেশ করলেন, তালহা ইবন উবাইদাল্লাহ উঠে দাঁড়ালেন, তাঁর দিকে দৌড়ে গেলেন এবং স্বাগত জানালেন অভিনন্দিত করলেন আল্লাহর ক্ষমার কারণে এবং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই ঘটনাকে প্রত্যাখান করেননি। এই ঘটনা নির্দেশ করে যে, আগত ব্যক্তির জন্যে উঠে দাঁড়ানো, তার সাথে হাত মিলানো এবং স্বাগত জানানো অনুমোদিত। এই বর্ণণাটিও অনুরূপ যেখানে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর কন্যা ফাতিমার ঘরে প্রবেশ করলেন তিনি তাঁর জন্যে উঠে দাঁড়ালেন এবং তাঁর হাত ধরলেন এবং তার নিজের বসার স্থানে তাকে বসালেন। এবং যখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে ফাতিমা রদিয়াল্লাহু আনহা আসতেন তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর হাত ধরতেন এবং তাঁর নিজের বসার স্থানে তাকে বসাতেন। তিরমিযিতে সহীহ রূপে চিহ্নিত।

আল্লাহ্‌ সবচেয়ে ভালো জানেন।
Islam Q&A

যুবকদের প্রতি ৭৫টি নসীহত

$
0
0

অনুবাদ: মুহাঃ আবদুল্লাহ্‌ আল কাফী বিন আব্দুল জলীল

সম্পাদনা: আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল

সকল প্রশংসা সেই আল্লাহ তায়ালার জন্য যিনি বলেন: “তোমাদের পূর্বে যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছিল তাদেরকে আমি নসীহত করেছি এবং তোমাদেরকেও নসীহত করছি যে, তোমরা আল্লাহকে ভয় কর।” (সূরা নিসা-১৩১)

দরুদ ও সালাম বর্ষিত হোক তাঁর ও রাসূল মুহাম্মদের উপর। যিনি বলেন: আমি তোমাদেরকে নসীহত করছি আল্লাহ ভীতির জন্য, ধর্মীয় নেতার কথা শোনা ও তাঁর আনুগত্য করার জন্য। আল্লাহ ভীতি হলো তাঁর আদেশ মান্য করা নিষেধ থেকে দূরে থাকা। তাকওয়াই হলো দুনিয়া ও আখিরাতে সৌভাগ্যের চাবিকাঠি।

নিম্নে কতিপয় মূল্যবান ইসলামী নসীহত সন্নিবেশিত করা হল। নছীহতগুলো দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ের সাথে সংশ্লিষ্ট। যেমন- ইবাদত-বন্দেগী, লেন-দেন, আদব-শিষ্টাচার, চরিত্র-ব্যবহার ইত্যাদি। যে মুসলিম যুবক প্রয়োজনীয় ও উপকারী বিষয় সম্পর্কে জানতে আগ্রহী, আমরা সে যুবকের প্রতি তার স্মরণের উদ্দেশ্যে এ নছীহতগুলো পেশ করছি। আর স্মরণ মুমিনদের উপকারে আসবে। আমরা আল্লাহর দরবারে আশা রাখি- যে ব্যক্তি এগুলো শুনবে বা পাঠ করবে আল্লাহ তাকে উপকৃত করুন। যে ব্যক্তি এগুলো লিখবে বা প্রচার করবে বা আমল করবে তাকে সুমহান প্রতিদান ও পুরস্কারে ভূষিত করুন। তিনি আমাদের জন্য যথেষ্ট এবং তিনিই সর্বোত্তম কর্ম সম্পাদনকারী।

নছীহতগুলো নিম্নরূপ:

  1. আল্লাহ তায়ালার জন্য নিয়তকে পরিশুদ্ধ করবে। কথায় ও কাজে মানুষের প্রশংসা পাওয়া কিংবা দুনিয়ার কোন স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্য রিয়া পরিত্যাগ করবে।
  2. যাবতীয় কথা, কাজ ও আচার-আচরণে মুহাম্মদ মাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর আদর্শ অনুসরণ করবে।
  3. আল্লাহ তায়ালাকে ভয় করবে। যাবতীয় নির্দেশ পালন এবং নিষেধ থেকে দূরে থাকতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হবে।
  4. আল্লাহর নিকট খাঁটি ভাবে তওবা করবে। বেশী বেশী ক্ষমা প্রার্থনা করবে।
  5. তোমার কথা ও কাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে আল্লাহর সূক্ষ্ম দৃষ্টির কথা স্মরণ রাখবে। জেনে রাখ আল্লাহ্‌ তোমাকে দেখেন এবং তোমার হৃদয়ের গোপন খবরও তিনি জানেন।
  6. আল্লাহর প্রতি, তাঁর ফেরেশতাকুল, কিতাবসমূহ, নবী-রসূলগণের প্রতি এবং শেষ দিবস ও তকদীরের ভাল-মন্দের প্রতি দৃঢ়ভাবে ঈমান পোষণ করবে।
  7. বিনা দলীলে কারো তাক্বলীদ বা অন্ধ অনুকরণ করবে না।
  8. ভাল কাজে প্রতিযোগিতা করবে।
  9. (রিয়াযুস্‌ সালেহীন) কিতাবটি সংগ্রহ করবে। নিজে পড়বে পরিবারের অন্যদেরকেও  পড়ে শোনাবে। ইমাম ইবনুল কাইয়েমের (যাদুল মাআদ) গ্রন্থটিও সংগ্রহ করার চেষ্টা করবে। (কিতাব দুটি বাংলায় পাওয়া যায়।)
  10. প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য সকল নাপাকি থেকে সর্বদা পবিত্র থাকবে।
  11. জামাতের সাথে মসজিদে গিয়ে প্রথম ওয়াক্তে নামায আদায় করতে সচেষ্ট থাকবে। বিশেষ করে এশা ও ফযর নামায।
  12. দুর্গন্ধযুক্ত খাদ্য পরিত্যাগ করবে। যেমন- কাঁচা পিয়াজ, কাঁচা রসূন। এবং ধুমপান করে নিজেকে এবং মুসলমানদেরকে কষ্ট দিবে না।
  13. জামায়াতের বিশেষ ফজিলত হাসিলের লক্ষ্যে সর্বদা জামায়াতে নামায আদায় করবে।
  14. ফরয যাকাত আদায় করবে। যাকাত দেয়ার ক্ষেত্রে হক্বদারেদের ব্যাপারে কৃপণতা করবে না।
  15. আগে ভাগে জুমআর নামাযে যাওয়ার চেষ্টা করবে। দ্বিতীয় আযানের পর মসজিদে আসার অভ্যাস পরিত্যাগ করবে।
  16. ঈমানের সাথে আল্লাহর নিকট প্রতিদান পাওয়ার আশায় রমযানের রোযা পালন করবে। এর মাধ্যমে তোমার পূর্বাপর যাবতীয় পাপ ক্ষমা করে দেয়া হয়।
  17. শরীয়ত সম্মত কোন ওজর ব্যতীত রমযান মাসের কোন একটি রোযাও পরিত্যাগ করবে না। অন্যথা গুনাহগার হয়ে যাবে।
  18. রমযানের রাতগুলোতে কিয়াম করবে বিশেষ করে লায়লাতুল ক্বাদরে-ঈমান ও প্রতিদানের আশায় কিয়াম করবে। যাতে করে তোমার পূর্বকৃত পাপসমূহ ক্ষমা করে দেয়া হয়।
  19. যদি সামর্থবান হয়ে থাক তবে দ্রুত হজ্ব-ওমরার উদ্দেশ্যে বায়তুল্লাহর দিকে সফর কর। দেরী করা থেকে সাবধান হও।
  20. পবিত্র কুরআন অর্থসহ পড়ার চেষ্টা কর। কুরআনের আদেশ পালন কর, নিষেধ থেকে দূরে থাক। যাতে করে প্রভুর দরবারে কুরআন তোমার পক্ষে দলীল হয় এবং কিয়ামত ময়দানে তোমার জন্য সুপারিশ করে।
  21. সর্বদা আল্লাহ তায়ালার জিকিরে মশগুল থাকবে- প্রকাশ্যে-গোপনে, দাঁড়ানো, বসা ও শোয়াবস্থায়-সর্বদাই। আল্লাহর জিকির থেকে কখনো গাফেল হবে না।
  22. যিক্‌রের মজলিসে (ইলমী অনুষ্ঠানে) বসবে। কেননা এধরণের মজলিস জান্নাতের বাগান।
  23. হারাম এবং গোপন বিষয় দেখা থেকে তোমার দৃষ্টিকে নত রাখবে। সেদিকে দৃষ্টিপাত থেকে সর্বদা সাবধান থাকবে। কেননা নিষিদ্ধ দৃষ্টি হল শয়তানের পক্ষ থেকে একটি বিষাক্ত তীর।
  24. টাখনুর নীচে কাপড় ঝুলিয়ে পরবে না। চলাফেরায় কখনো অহংকারী ভাব প্রকাশ করবে না।
  25. রেশমের কাপড় বা স্বর্ণের কোন কিছু পরিধান করবে না। কেননা তা পুরুষদের জন্য হারাম।
  26. মহিলাদের সাদৃশ্য অবলম্বন করবে না। আর তোমার পরিবারের কোন মহিলাকেও পুরুষের সাদৃশ্য অবলম্বন করতে দেবে না।
  27. দাড়ি ছেড়ে দাও। কেননা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: “তোমার গোঁফ কাট এবং দাড়ি ছেড়ে দাও।” (বুখারী ও মুসলিম)
  28. হালাল ছাড়া অন্য কিছু ভক্ষণ করবে না এবং হালাল ব্যতীত অন্য কিছু পান করবে না। তাহলে তোমার দুয়া কবুল হবে।
  29. খানা-পিনার সময় বিসমিল্লাহ্‌ বলবে। শেষ করলে আলহামদু লিল্লাহ বলবে।
  30. ডান হাতে খানা-পিনা করবে। লেন-দেনের ক্ষেত্রে ডান হাতে গ্রহণ করবে এবং ডান হাতেই প্রদান করবে।
  31. কারো প্রতি জুলুম করবে না। কেননা কিয়ামত দিবসে জুলুম অন্ধকার হয়ে দেখা দিবে।
  32. মুমিন ব্যক্তি ব্যতীত অন্য কাউকে সাথী হিসেবে গ্রহণ করবে না। আর তোমার খানা যেন ভাল মানুষ ব্যতীত অন্যে না খায়।
  33. সাবধান! ঘুষ খাবে না। নিবেও না দিবেও না, এ ব্যাপারে মধ্যস্থতাও করবে না। কেননা এরূপ যে করে সে অভিশপ্ত।
  34. আল্লাহ্‌কে নাখোশ করে মানুষের সন্তুষ্টি চেও না। কেননা আল্লাহ তাতে অসন্তুষ্ট হয়ে যাবেন।
  35. শরীয়ত সম্মত প্রতিটি বিষয়ে নেতৃবৃন্দের আনুগত্য করবে এবং তাদের সংশোধনের জন্য আল্লাহর কাছে দুআ করবে।
  36. সাবধান! কখনো মিথ্যা সাক্ষ্য দেবে না। আর সত্য সাক্ষ্যও গোপন করবে না। (যে ব্যক্তি উহা গোপন করবে তার অন্তর পাপী। আর তোমাদের আমল সম্পর্কে আল্লাহ পরিজ্ঞাত। (সূরা বাকারা-২৮৩)
  37. (সৎকাজের আদেশ করবে এবং অসৎকাজ থেকে নিষেধ করবে। আর এক্ষেত্রে বিপদের সম্মুখীন হলে ধৈর্য ধারণ করবে।) (সূরা লোকমান-১৭।) আল্লাহ্‌ এবং তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যা আদেশ করেছেন তাই সৎকাজ এবং তাঁরা যা নিষেধ করেছেন তাই অসৎকাজ।
  38. ছোট-বড় সব ধরণের হারাম কাজ পরিত্যাগ কর। কখনো আল্লাহ তায়ালার নাফরমানী করবে না। এক্ষেত্রে কাউকে সহযোগিতাও করবে না।
  39. কোন ভাল কাজকেই ছোট মনে করবে না। রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক কোন বস্তু পরিত্যাগ করাটাও একটা ঈমানী কাজ। লজ্জাবোধ ঈমানের অংশ।
  40. ব্যভিচারের নিকটবর্তী হবে না। আল্লাহ বলেন: ”তোমরা ব্যভিচারের নিকটবর্তী হয়ো না। কেননা উহা অশ্লীলতা এবং খুবই নিকৃষ্ট কাজ।” (সুরা বানী ইসরাইল-৩২)
  41. পিতামাতার সাথে সাদাচার করবে। সাবধান! তাদের কথা অমান্য করবে না যদি না তারা ইসলাম বিরোধী নির্দেশ প্রদান করে। কিন্তু তারা যদি ইসলাম বিরোধী কাজের নির্দেশ দেয় তবে অবস্থায়ও ভদ্রতা বজায় রেখে তাদের সে নির্দেশ পালন থেকে বিরত থাকবে।)
  42. আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখবে। এবং তাদের সাথে সম্পর্ক ছিন্নের ব্যাপারে সাবধান হবে।
  43. প্রতিবেশীর সাথে ভাল ব্যবহার করবে। তাকে কষ্ট দিবে না। সে কষ্ট দিলে তাতে ধৈর্য ধারণ করবে।
  44. সৎ ব্যক্তি এবং ঈমানী ভাইদের সাথে ঘন ঘন সাক্ষাৎ করবে।
  45. শুধুমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যেই কাউকে ভালবাসবে। আল্লাহর উদ্দেশ্যেই কাউকে ঘৃণা করবে। কেননা এটা হল – ঈমানের সর্বাধিক মজবুত হাতল।
  46. সৎব্যক্তিদের সাথে সময় কাটানোর চেষ্টা করবে। অসৎ সঙ্গ পরিত্যাগ করবে।
  47. কোন মুসলিমকে বিপদগ্রস্থ অবস্থায় দেখলে যত তাড়াতাড়ি পারা যায় তার সাহায্যের জন্য এগিয়ে যাবে এবং তাদেরকে আনন্দিত রাখার চেষ্টা করবে।
  48. নম্রতা, ধীর স্থিরতা এবং ধৈর্যাবলম্বন করবে। তাড়াহুড়া পরিত্যাগ করবে।
  49. অন্যের কথার মাঝে বাধা সৃষ্টি করবে না। সুন্দরভাবে তা শোনার চেষ্টা করবে।
  50. জানা-অজানা সকল মুসলিম ভাইকে সালাম দিবে।
  51. সুন্নতি সালাম দিবে। বলবে: আসসালামু ওয়া আলাইকুম। হাত বা মাথা দিয়ে ইশারা করাকেই যথেষ্ট মনে করবে না।
  52. কাউকে গালিগালাজ করবে না। খারাপ ভাবে কারো বর্ণনা দিবে না।
  53. কাউকে অভিশাপ দেবে না। এমনকি তা যদি চতুষ্পদ জন্তু বা কোন জড় বস্তুও হয়।
  54. কোন মানুষের ইজ্জতে কোন প্রকার অপবাদ দিবে না বা তার কুৎসা রটনা করবে না। কেননা এরূপ করা কবিরা গুনাহ।
  55. চুগলখোরি করবে না। অর্থাৎ ফ্যাসাদ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে একজনের কথা অন্যজনকে বলবে না।
  56. গীবত করবে না। (গীবত হল তোমার মুসলিম ভায়ের দোষের কথা তার অসাক্ষাতে কারো কাছে বলা)।
  57. কোন মুসলিমকে ভয় দেখাবে না এবং তাকে কোন প্রকার কষ্ট দিবে না।
  58. মানুষের মাঝে সমঝোতা করার চেষ্টা করবে। কেননা এটা হল একটি উত্তম আমল।
  59. জবানের হেফাজত করবে। ভাল কথা বা কাজের কথা বলবে, অন্যথা চুপ থাকবে।
  60. সত্যবাদী হও মিথ্যা পরিত্যাগ কর। কেননা মিথ্যা পাপ কাজের রাস্তা দেখায় আর পাপ জাহান্নামে নিয়ে যায়।
  61. দুমুখো হয়ো না। একই বিষয়ে এদের কাছে এক কথা অন্যদের কাছে আর এক কথা বলবে না।
  62. আল্লাহ ছাড়া অন্যের নামে শপথ করবে না। আর সত্য বিষয় হলেও বেশী বেশী কসম করার অভ্যাস করবে না।
  63. কাউকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করবে না। কেননা তাকওয়ার মানদণ্ড ছাড়া কারো উপর কারো প্রাধান্য নেই।
  64. কোন জ্যোতির্বিদ, গণক বা যাদুকরের কাছে যাবে না। তাদের কোন কথা বিশ্বাস করবে না। এতে ঈমানের ক্ষতি হয়।
  65. কোন মানুষ বা প্রাণীর চিত্রাঙ্কন করবে না। কেননা কিয়ামত দিবসে চিত্রকরদেরকে সবচেয়ে কঠিন শাস্তি দেয়া হবে।
  66. তোমার বাড়িতে কোন প্রাণীর ছবি রাখবে না। কেননা তাতে রহমতের ফেরেশতা প্রবেশ করে না।
  67. কেউ হাঁচি দেয়ার পর আলহামদু লিল্লাহ বললে তার জবাবে ইয়ারহামু কাল্লাহ বলবে।
  68. কোন ক্রমেই তাবিজ-কবচ, তাগা ইত্যাদি  ব্যবহার করবে না। কেননা এগুলো ব্যবহার করা শিরক।
  69. প্রতিটি পাপকাজের জন্য অনতিবিলম্বে তওবা করবে। খারাপ কাজ হয়ে গেলেই ভাল কাজ করবে, যাতে উক্ত পাপ মোচন হয়ে যায়। এরূপ বলবে না অচিরেই তওবা করব।
  70. আল্লাহ্‌ তায়ালার ক্ষমা ও করুণার আশাবাদী হও। আল্লাহর প্রতি সুধারণা রাখ।
  71. আল্লাহ্‌র শাস্তির ব্যাপারে ভীত-সন্ত্রস্ত থাক। তার শাস্তি থেকে নিজেকে নিরাপদ ভেবো না।
  72. বিপদাপদে ধৈর্য ধারণকারী হও। এবং সুখের কালে আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ হও।
  73. অধিকহারে সৎকাজ করবে। যাতে করে মৃত্যুর পরেও তার ছওয়াব জারি থাকে। যেমন মসজিদ তৈরি করা, ইসলামী জ্ঞানের প্রচার ও প্রসার করা।
  74. আল্লাহর কাছে জান্নাত পাওয়ার প্রার্থনা করবে এবং জাহান্নাম থেকে আশ্রয় কামনা করবে।
  75. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর প্রতি অধিকহারে দরূদ পাঠ করবে।

 

ওয়া ছাল্লাল্লাহু আলা নাবিয়্যেনা মুহাম্মাদিন ওয়ালা আলিহি ওয়াছাহবিহি ওয়া সাল্লাম।

কিয়ামত দিবস পর্যন্ত আল্লাহ তাঁর পরিবার ও সকল সাহাবীদের প্রতি অবিরাম ধারায় রহমত ও শান্তি নাযিল করুন। আমীন।

মিথ্যা থেকে বাঁচার উপায়

$
0
0

লেখক: আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া

(ইবনুল কাইয়্যেমের “ইগাছাতুল লাহফান” অবলম্বনে রচিত)

মিথ্যা যে একটি বদ অভ্যাস তাতে কেউ সন্দেহ করে বলে আমি মনে করি না, কারণ মিথ্যাকে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ধ্বংসকর বলে মন্তব্য করেছেন। আরো বলেছেন, মিথ্যা মুনাফেকীর নিদর্শন। মানুষ মিথ্যা বলতে বলতে এক সময় আল্লাহর দরবারে মিথ্যাবাদী বলে সাব্যস্ত হয়। আর সত্য বলা ও সত্য বলার প্রচেষ্টায় রত থাকলে আল্লাহ্ তাকে সত্যবাদী বলে লিখে নেন; এখানে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের একটি হাদীসের ভাষ্যই উদ্ধৃত করলাম।

কথা উঠেছিল আমাদের এক শিক্ষককে নিয়ে যিনি মিথ্যা কথা বলতে ছাত্রদেরকে নিষেধ করতেন। একদা আমরা তার বৈঠকখানায় অবস্থান করছিলাম, এমতাবস্থায় সেখানে এমন এক লোক এসে উপস্থিত যাকে তিনি পছন্দ করতেন না। আসা মাত্রই লোকটি প্রশ্ন করলো: “তোমাদের গুরুমশাই কোথায়”? আমরা জানতাম যে, উস্তাদজী তার সাথে দেখা করতে চান না; অথচ আমাদেরকে মিথ্যা বলতে নিষেধ করেছেন। এ পরিস্থিতিতে আমাদের মধ্যকার সর্বকনিষ্ঠ জন সভয়ে বলে ফেললো যে, তিনি পাশের ফ্লাটে আছেন। উস্তাদজীকে তার কথামত ডাকা হলো, তিনি আসলেন এবং তার সাথে জরুরী কথাবার্তা সারলেন। কিছুক্ষণ পর লোকটি বিদায় নিলো। আমরা পরস্পর মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলাম। আমাদের অবস্থা দেখে তিনি বুঝতে পারলেন যে, তার অবস্থান বলে দেয়ায় তিনি যে খুশী হননি, এটা আমরা বুঝতে সক্ষম হয়েছি, কিন্তু আমরা অপরাগ ছিলাম, কারণ মিথ্যা বলা যাবে না। তিনি ব্যাপারটা সহজ করে নিতে নিতে বললেন, তোমরা এমনটি বললেই পারতে যে, “তিনি এখানে নেই”।

আমরা বলে উঠলাম: এটা কি মিথ্যা নয়?

তিনি বললেন: না, এটা মিথ্যা নয়; বরং معاريض বা বলার কৌশল। সাহাবী ইমরান ইবন হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, إن في المعاريض لمندوحة عن الكذب অর্থাৎ, “বাচনভঙ্গী ও কথার কৌশলের মাধ্যমে মিথ্যা থেকে বাঁচা যায়”। [বুখারী, আল-আদাবুল মুফরাদ: ৮৫৭]

আমরা জানতে চাইলাম: কুরআন, হাদীস বা সালফে সালেহীনের জীবনে এ প্রকার বাচনভঙ্গীর ব্যবহার আছে কি?

তিনি বললেন: তোমাদের এ প্রশ্নটি আমার কাছে ভালো লেগেছে। আসলে দ্বীনী ব্যাপারে কোন কিছু বলার পূর্বে আমাদের জানা আবশ্যক যে, আমাদের কথাটা কুরআন-সুন্নাহ্ অনুযায়ী হয়েছে কি না। আর যে আয়াত বা হাদীসকে আমি বা আমরা দলীল হিসেবে পেশ করবো, সে আয়াত বা হাদীস দ্বারা আমাদের সালফে সালেহীন তথা সাহাবা, তাবেয়ীন ও তাবেতাবেয়ীনের অনুসারীগণ আমরা যে রকম বুঝেছি সে রকম বুঝেছেন কি না? নাকি আমরা আয়াত ও হাদীসের ব্যাখ্যায় নতুন কোন কথা সংযোজন করেছি? কেননা জগতে যত ফেৎনা-ফ্যাসাদ সৃষ্টি হয়েছে আর যত ফির্কার উৎপত্তি হয়েছে, সবাই দলীল হিসেবে কুরআন ও হাদীসের বাণী উদ্ধৃত করে থাকে, যদি সব ব্যাখ্যাই গ্রহণযোগ্য হতো তাহলে দ্বীনের অস্তিত্ব টিকে থাকা মুশকিল হয়ে পড়ত। তাই সালফে-সালেহীনের ব্যাখ্যা অনুসারেই কুরআন বা হাদীসকে আমাদের বুঝতে হবে।

এখন আসা যাক তোমাদের প্রশ্নের উত্তরে-

তোমারা জানতে চেয়েছ কুরআন, সুন্নাহ্ এবং সালফে-সালেহীনের জীবনে এ প্রকারের معاريض বা বাচনভঙ্গির ব্যবহার হয়েছে কি না? আমি বলবো: হাঁ। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ্ তা’আলা ইব্রাহীম ‘আলাইহিস্ সালামের ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন: فَنَظَرَ نَظْرَةً فِي النُّجُومِ অর্থাৎ, “তিনি ক্ষণিকের জন্য তারকারাজির প্রতি দৃষ্টিপাত করে বললেন: ‘আমি অসুস্থ’।” এখানে ইব্রাহীম ‘আলাইহিস্ সালামকে তার জাতির লোকেরা মূর্তিপূজা করতে আহ্বান করেছিল। তাঁকে আহ্বান করেছিল মেলায় মূর্তি বিক্রয় করার জন্য। কিন্তু তিনি এ থেকে বাঁচার জন্য চমৎকার এক বাচনভঙ্গি ব্যবহার করলেন যাতে মিথ্যাও হয়নি আবার শির্কেও লিপ্ত হতে হয়নি। তার জাতির লোকেরা বিশ্বাস করত যে, নক্ষত্ররাজি মানুষের রোগ, শোক, আরোগ্য এসব দিয়ে থাকে। তাই ইব্রাহীম ‘আলাইহিস্ সালাম তাদেরকে বোকা বানানোর জন্য তারকারাজির দিকে ক্ষণিকের জন্য দৃষ্টি নিবদ্ধ করলেন, তারপর বললেন যে, “আমি অসুস্থ হয়ে যাবো”, তাঁর জাতির লোকেরা বুঝলো যে, ইব্রাহীম তারকার অবস্থান দেখে বুঝেছে সে অসুস্থ হয়ে যাবে তাই সে মেলায় যাচ্ছে না। অথচ ইব্রাহীম ‘আলাইহিস্ সালামের উদ্দেশ্য ছিল তাদেরকে বোকা বানানো আর “আমি রোগগ্রস্ত” কথার দ্বারা উদ্দেশ্য ছিল যে, আমি মানসিক ভাবে তোমাদের কর্মকাণ্ডে খুশী নই।

অনুরূপভাবে আইয়ূব ‘আলাইহিস্ সালাম তাঁর স্ত্রীকে একশ’ বেত্রাঘাত করার শপথ করেছিলেন। আল্লাহ্ তাঁকে সে শপথ পূর্ণ করার কৌশল এভাবে বাতলে দিয়েছিলেন যে,

﴿ وَخُذۡ بِيَدِكَ ضِغۡثٗا فَٱضۡرِب بِّهِۦ وَلَا تَحۡنَثۡۗ إِنَّا وَجَدۡنَٰهُ صَابِرٗاۚ نِّعۡمَ ٱلۡعَبۡدُ إِنَّهُۥٓ أَوَّابٞ ٤٤ ﴾ [ص: ٤٤]

তুমি তোমার হাতে (একশ’) ছড়ির এক আঁটি বানিয়ে তা দিয়ে এক বেত্রাঘাত করো, শপথ ভঙ্গ করো না।” [সূরা সদ: ৪৪]

তদ্রূপ ইউসুফ ‘আলাইহিস্ সালামও তাঁর ভাইকে আটকে রাখার জন্য এক প্রকার ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন। আল্লাহ্ তা‘আলা সে ঘটনা বর্ণনা করার পর বলেন:

﴿ فَبَدَأَ بِأَوۡعِيَتِهِمۡ قَبۡلَ وِعَآءِ أَخِيهِ ثُمَّ ٱسۡتَخۡرَجَهَا مِن وِعَآءِ أَخِيهِۚ كَذَٰلِكَ كِدۡنَا لِيُوسُفَۖ مَا كَانَ لِيَأۡخُذَ أَخَاهُ فِي دِينِ ٱلۡمَلِكِ إِلَّآ أَن يَشَآءَ ٱللَّهُۚ﴾ [يوسف: ٧٦]

তখন সে তার ভাইয়ের ভাণ্ডের আগে অন্যদের ভাণ্ডে খোঁজা শুরু করল। এভাবে আমি ইউসুফের জন্য কৌশল করেছি, নতুবা সে কোনভাবেই আল্লাহ না চাইলে রাষ্ট্রীয় আইন মোতাবেক তার ভাইকে আটকে রাখতে পারে না।” [সূরা ইউসুফ: ৭৬]

রাসূল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীসেও এসেছে, বদরের যুদ্ধে তিনি (সা) কাফেরদের অবস্থান বুঝার জন্য অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছিলেন। তারপর সেখানকার লোকদের কাছ থেকে তাদের অবস্থান জানার পর লোকেরা প্রশ্ন করেছিল: তোমরা কোথা থেকে এসেছ? রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম জবাব দিলেন: نحن من ماء অর্থাৎ “আমরা পানি হতে”। লোকেরা বুঝে নিল যে, তারা কোন পানির কুপের কাছে থাকে, সেখান থেকে এসেছে। অথচ রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের উদ্দেশ্য ছিল একথা বলা যে, আমরা পানি থেকে সৃষ্ট; কারণ সব সৃষ্টির মূলেই রয়েছে পানি।

তদ্রূপ আমাদের সালফে-সালেহীনের জীবনেও এ প্রকার معاريض ব্যবহারের নজির রয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ আমি কয়েকটি ঘটনা উদ্ধৃত করছি-

প্রখ্যাত সাহাবী আব্দুল্লাহ্ ইবনে রাওয়াহা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু একবার তাঁর স্ত্রীর অনুপস্থিতিতে তার ক্রিতদাসীর সাথে সহবাসে লিপ্ত হয়। তাঁর স্ত্রী হঠাৎ তাদেরকে ঐ অবস্থায় দেখে ফেলেন এবং রাগের মাথায় দা নিয়ে কোপাতে আসে। কিন্তু ইত্যবসরে তিনি তাঁর কর্ম সম্পাদন করে ফেলেছেন। তাঁর স্ত্রী এসে বললেন যে, যদি আমি তোমাদেরকে ঐ অবস্থায় পেতাম তাহলে তোমার মাথা কেটে ফেলতাম। তিনি বললেন: আমি কি করেছি? তাঁর স্ত্রী বললেন: যদি সত্যিই তুমি কিছু না করে থাক, তাহলে এখন এ অবস্থায় কুরআন পাঠ করতে পারবে কি? আব্দুল্লাহ্ ইবনে রাওয়াহা সাথে সাথে পড়া শুরু করলেন:

شهدت بأن وعد الله حق = وأن النار مثوى الكافرينا

وأن العرش فوق الماء طاف = وفوق العرش رب العالمينا

وتحمله ملائكة كرام = ملائكة الإله مقربينا[1]

মূলতঃ এটা ছিল একটি কবিতার কিছু অংশ। কিন্তু তাঁর স্ত্রী এর মাঝে আর কুরআনের মাঝে পার্থক্য বুঝতেন না। বরং যখন তিনি পড়ছিলেন তখন তাঁর স্ত্রী মনে করেছিলেন যে, কুরআন পড়ছে। আর যদি সে এ অবস্থায় কুরআন পড়তে পারে তাহলে নিশ্চয় সে কাউকে স্পর্শ করে নি। অবশেষে তাঁর স্ত্রী বললেন যে, আমি আল্লাহর কিতাবের উপর বিশ্বাস স্থাপন করলাম এবং আমার দেখাটাকে মিথ্যা সাব্যস্ত করলাম। এরপর সাহাবী আব্দুল্লাহ্ ইবনে রাওয়াহা যখন রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে এ ঘটনা সবিস্তারে বর্ণনা করলেন, তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমন ভাবে হাসলেন যে, তাঁর মাড়ির দাঁত পর্যন্ত দৃস্টিগোচর হয়েছিল।

উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণনা করা হয়, তিনি বলেছেন যে, আমি আশ্চর্য হই এই ভেবে যে, “কোন ব্যক্তি معاريض বা কথা বলার কৌশল জানার পরেও মিথ্যা বলার দিকে ধাবিত হয় কি করে?” [মুসান্নাফ ইবন আবী শাইবাহ]

আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুকে একবার খাবার খেতে ডাকা হলো, সেখানে তিনি কোনো কারণে খাওয়া অপছন্দ করলেন, তাই তিনি বললেন: ‘আমি রোযাদার’। তারপর তারা তাকে খেতে দেখলো। তারা বললো: ‘আপনি কি বলেন নি যে, আপনি রোযাদার? তিনি জবাবে বললেন: ‘রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম কি বলেননি যে, প্রত্যেক মাসে তিনদিন রোযা রাখা মানে চিরদিন রোযা রাখা?’ (অর্থাৎ ‘সে অনুসারে আমি রোযাদার’। কারণ তিনি প্রত্যেক মাসের ১৪, ১৫, ১৬ এ তিনদিন রোযা রাখতেন।)

প্রখ্যাত তাবেয়ী মুহাম্মাদ ইবন সিরীন রাহিমাহুল্লাহর নিকট যদি কোন ঋণদাতা তার ঋণ চাইত এবং তার কাছে দেওয়ার মত কিছু না থাকত, তবে তিনি বলতেন: ‘তোমাকে আমি দু’দিনের একদিনে পরিশোধ করব। ঋণদাতা মনে করত যে, আজ বা কাল দিয়ে দিবে অথচ তাঁর উদ্দেশ্য হলো দুনিয়ার দিনে বা আখেরাতের দিনে আমি তোমার ঋণ পরিশোধ করে দেব’।

ইবনে সিরীন থেকে আরো বর্ণিত আছে যে, কোন এক লোকের ভীষণ চোখ লাগতো (নযর লাগা)। কাজী সুরাইহ্ রাহিমাহুল্লাহ্ তার খচ্চরটি নিয়ে ঐ লোকের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন, লোকটি খচ্চরটির উপর চোখ লাগাতে চাইল। কাজী সুরাইহ্ রাহিমাহুল্লাহ্ সবকিছু বুঝতে পেরে সাথে সাথে বললেন: ‘আমার এই খচ্চরটা এমন বাজে যে, একবার বসে পড়লে আবার দাঁড় করিয়ে না দেয়া পর্যন্ত উঠবে না’। লোকটি বলল: ‘ধ্যাৎ, এমন বাজে জিনিস?’ এভাবে সুরাইহ্ রাহিমাহুল্লাহ্ লোকটির চোখ লাগানো থেকে তাঁর খচ্চরটাকে হেফাযত করলেন। অথচ কাজী সুরাইহ্-এর কথা ‘বসে পড়লে উঠিয়ে না দেয়া পর্যন্ত উঠে না’-এর অর্থ এ নয় যে, সত্যি সত্যিই সেটি উঠে না; বরং উদ্দেশ্য ছিল আল্লাহ্ যতক্ষণ না উঠান ততক্ষণ সেটি উঠতে পারে না।

ইব্রাহীম নাখয়ী রাহিমাহুল্লাহ্ থেকে বর্ণিত আছে যে, একবার তার স্ত্রী তাকে কোন একটা কিছু দেয়ার বিষয়ে খুব পীড়াপীড়ি করছিল, তখন তার হাতে একটা পাখা ছিল। তিনি পীড়াপীড়িতে অতিষ্ট হয়ে বলে উঠলেন: ‘আল্লাহর শপথ করে বলছি এটা তোমার!’ তার স্ত্রী শান্ত হলে তিনি তার শিষ্যদের জিজ্ঞাসা করলেন: ‘তোমরা কি বুঝলে?’ তারা বলল: ‘আপনি আপনার স্ত্রীকে ঐ বস্তুটা দিয়ে দিলেন’। তিনি বললেন: ‘কখখনো নয়! তোমরা কি দেখনি যে, আমি পাখাটির দিকেই ইঙ্গিত করছিলাম? আমার উদ্দেশ্য ছিল পাখাটা দেয়া।’

প্রখ্যাত মুহাদ্দিস হাম্মাদ বিন যায়েদ রাহিমাহুল্লাহ্-এর কাছে যদি এমন কোন লোক আসত যার সাথে তিনি সাক্ষাৎ করতে চাইতেন না, সাথে সাথে তিনি তাঁর হাতটা মাড়ির দাঁতের উপর রেখে বলতেন: ’হায় আমার দাঁত! হায় আমার দাঁত! এভাবে বলতে থাকতেন। লোকটি মনে করত তাঁর বুঝি দাঁতে ব্যাথা তাই কথা বলবেন না, অথচ তিনি দাঁতে ব্যাথা হয়েছে এমন কথা বলেন নি।’

ইমাম আহমাদ রাহিমাহুল্লাহ্-এর নিকট তাঁর শিষ্য মাররূযী রাহিমাহুল্লাহ্ বসেছিলেন, ইত্যবসরে সেখানে এক লোক এসে জিজ্ঞাসা করল: ‘এখানে মাররূযী আছে?’ ইমাম আহমাদ রাহিমাহুল্লাহ্ চাইলেন যে, মাররূযী লোকটির সাথে বের না হোক, তাই তিনি সাথে সাথে তাঁর আঙ্গুলকে হাতের কব্জির উপর রাখলেন এবং বললেন: ‘মাররূযী এখানে নেই, সে এখানে কি করবে?’

এ প্রকারের শত শত معاريض বা কথা বলার কৌশলের মাধ্যমে উপস্থিত পরিস্থিতিতে সুন্দর সমাধানের নজীর সাফলে সালেহীনের জীবনে রয়েছে।

এ পর্যন্ত বলে উস্তাদজী চুপ করলেন; আমরা সমস্বরে বলে উঠলাম: উস্তাদজী! এটা কি হিলা বা বাহানা করা নয়? আর হিলা বা বাহানা করা তো হারাম।

তিনি জবাবে বললেন: এটা যে এক প্রকার হিলা বা বাহানা তাতে সন্দেহ নেই। তবে জগতে যতপ্রকার গন্ডগোলের সূত্রপাত হয়েছে তার প্রধান কারণগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে, ‘কোন কিছুকে বিচার-বিশ্লেষণ না করে তার ব্যাপারে তড়িৎ হুকুম প্রদান করা’।

মনে রাখবে, এটা একটা হিলা বা বাহানা, কিন্তু সব হিলা-ই নিষিদ্ধ নয়; কারণ, হিলা তিন প্রকার- (১) এক প্রকার হিলা করা অত্যন্ত সওয়াবের কাজ। যেমনটি করেছিলেন ইব্রাহীম ‘আলাইহিস্ সালাম শির্ক থেকে বাঁচার জন্য। (২) আরেক প্রকার হিলা করা জায়েয। তবে ধর্মীয় স্বার্থের দিকে লক্ষ্য রেখে কখনো তা করা ভালো বলে বুঝায়, আবার কখনো ত্যাগ করা ভালো বলে প্রতীয়মান হয়। যার কিছু উদাহরণ আগেই পেশ করেছি। (৩) তৃতীয় আরেক প্রকার হিলা বা বাহানা আছে যা করা হয় শরীয়তের কোন ফরদ্ব কাজ ত্যাগ করার জন্য বা কোন হারাম কাজকে হালাল করার জন্য অথবা অত্যাচারীকে নির্দোষ আর নির্দোষকে অত্যাচারী বানানোর জন্য, হককে বাতিল আর বাতিলকে হকের রূপে রূপদান করার জন্য; এ প্রকার হিলা বা বাহানা করা সম্পূর্ণরূপে হারাম। এ প্রকারের হিলাকারীরা আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের লা’নতের ভাগীদার হওয়ার পথের পথিক। যেমনটি কোন কোন দেশের কিছু মুসলমানদের মধ্যে দেখা যায় তিন তালাকের মাসআলাতে অন্যস্থানে বিয়ে দেয়ার নামে মৌখিক বিয়ে ও সাথে সাথে মৌখিক তালাকের প্রচলন কিংবা এক রাতের জন্য চুক্তি করে ও পরদিন তালাক দেয়ার শর্তে বিয়ে করার হিলা বা বাহানা ইত্যাদি। আল্লাহ্ আমাদেরকে এ প্রকারের বাহানা অনুসরণ করার মাধ্যমে তাঁর লা’নতে পতিত হওয়া থেকে হেফাযত করুন। আমীন।

আমরা উস্তাদজীর আলোচনায় প্রীত হলাম। অন্যান্য দিনের মত আজও চা চক্রের মাধ্যমে আসরের সমাপ্তি ঘটিয়ে যে যার বাড়ী অভিমুখে রওয়ানা হলাম।

 

মানুষ সম্পর্কে ভালো ধারনা পোষণ করা

$
0
0

মূলঃ ডঃ আলী আল-হাম্মাদী | অনুবাদ: মোঃ মুনিমুল হক   

182

অন্যান্য মহৎগুণের পাশাপাশি একজন মুসলিমকে যে বিষয়ে বিশেষ খেয়াল রাখতে হবে তা হল সে যেন তার অপর মুসলিম ভাই সম্পর্কে কোন অমূলক সন্দেহের বশবর্তী হয়ে না পড়ে। অপর মুসলিম ভাইকে সন্দেহের দৃষ্টিতে না দেখে তার সম্পর্কে সুধারনা পোষণের ব্যাপারটিকে সর্বদায় অগ্রাধিকার দিতে হবে। অপরের ভুল ধরার জন্য আমরা ওঁতপেতে বসে থাকি। কিন্তু হওয়া উচিৎ ছিল তার উল্টোটা। একজন মুসলিম সবসময় সুযোগ খুঁজবে কি করে অপর একজন মুসলিম ভাইকে তার দোষ-ত্রুটি কিংবা তার বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ থেকে তাকে অব্যাহতি দেয়া যায়। বিশেষ করে, যারা ন্যায়নিষ্ঠ মুসলিম এবং যারা আল্লাহ্‌র পথে মানুষদের ডাকে তাদের দোষ-ত্রুটি অন্বেষণ করা বা তাদের উপর একটুতেই দোষারোপ করা ইত্যাদি থেকে বেঁচে থাকতে হবে।

 

নিজের দ্বীন সম্পর্কে যত্নবান, জ্ঞানী এবং ন্যায়নিষ্ঠ মুসলিমদের সকলেরই উপরিউক্ত চারিত্রিক গুণাবলী থাকা উচিৎ যারা তাদের প্রতিপালককে ভয় করে থাকে এবং যারা আল্লাহ্‌র দ্বীনের বিজয়ের ব্যাপারে আশাবাদী।

মানুষের সম্পর্কে সুধারনা পোষণ করা যদি ন্যায়নিষ্ঠ মুসলিমদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য না হত তাহলে পৃথিবীতে একজনও নিষ্কলুষ চরিত্রের ইসলামিক বিশেষজ্ঞ খুঁজে পাওয়া যেত না, খুঁজে পাওয়া যেত না এমন কোন মহৎ ব্যক্তিকে যার চরিত্রে মানুষ কলঙ্কের ছাপ লাগাতে বাকি রাখত! ফলে যা ঘটতো তা হল, মুসলিমদের সামনে অনুকরনীয় বা অনুসরনীয় কোন ব্যক্তিত্বকেই আর খুঁজে পাওয়া যেত না। আলহামদুলিল্লাহ্‌, মানুষ সম্পর্কে অমূলক কুধারনা পোষণ করা যেমন ইসলামের পরিপন্থী ঠিক তেমনি তা আমাদের বিচার বুদ্ধিরও পরিপন্থি।

 

এই বিষয়ের একটি মূলনীতি হিসেবে আল্লাহ্‌ রাব্বুল ‘আলামীন বলেনঃ

হে মুমিনগণ! তোমরা বহুবিধ ধারনা হতে বিরত থাকো; কারণ কোন কোন ধারনা পাপ এবং তোমরা একে অপরের গোপনীয় বিষয় অনুসন্ধান করো না এবং একে অপরের পশ্চাতে নিন্দা করো না। তোমাদের মধ্যে কেউ কি তার মৃত ভাইয়ের গোশত ভক্ষণ করতে ভালবাসবে? বস্তুতঃ তোমরাও এটাকে ঘৃণাই কর। তোমরা আল্লাহ্‌কে ভয় কর। আল্লাহ্‌ তাওবা গ্রহণকারী, দয়ালু। [সূরা হুজুরাত : ৪৯ :১২]

 

মহাপরাক্রমশালী আল্লাহ্‌ রাব্বুল ‘আলামীন আমাদেরকে বহুবিধ সন্দেহ করা থেকে বিরত থাকতে বললেন এই বলে যে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা পাপ। এবং তাৎক্ষনিকভাবেই তিনি গোপনীয় বিষয় অনুসন্ধান করাকেও নিষিদ্ধ করে দিলেন কারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই গোপনীয় বিষয় অনুসন্ধানের বিষয়টি জন্মলাভ করে মনের মধ্যে অন্যদের সম্পর্কে কুধারনা পোষণ করা থেকে!

একজন মুসলিমের জন্য একটি সাধারন হুকুম হল সে অন্য মুসলিমের দোষ গোপন করবে এবং তাদের সম্পর্কে সুধারনা পোষণ করবে। এবং সে কারণেই আল্লাহ্‌ রাব্বুল ‘আলামীনের আদেশ হল কোন মুসলিম অন্য কোন মুসলিমের ব্যাপারে কোন অপবাদ শুনলেও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি সম্পর্কে সুধারনা বহল রাখতে হবে।

মু’মিনদের মাতা আ’য়েশা (রাদ্বিআল্লাহু ‘আনহা) -এর উপর মুনাফিকরা যে মিথ্যারোপ করছিল সে বিষয়টি আল্লাহ্‌ রাব্বুল ‘আলামীন নিজেই পবিত্র কুর’আন আল-কারীমে স্পষ্ট করে দিয়েছেন আমাদের মাতা আ’য়েশা (রাদ্বিআল্লাহু ‘আনহা)-কে নির্দোষ ঘোষণার মাধ্যমে। আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন বলেনঃ

যখন তোমরা একথা শুনলে, তখন মুমিন পুরুষ এবং নারীগণ কেন নিজেদের বিষয়ে সৎ ধারনা করনি এবং বলনিঃ এটা সুস্পষ্ট অপবাদ। [সূরা নূর; ২৪:১২]

 [হিশাম ইসমাইল আস-সিনি, মানহাজ আহালুস সুন্নাহ ওয়াল জাম’আত ফীন নাকাব ওয়াল হুকম্‌ ‘আলাল আখীরিন, আল মুনতাদা, লন্ডন, ১৯৯২, পৃষ্ঠাঃ ২১]

ডঃ মুস্তাফা আস সিবা’ঈ বলেনঃ

কারো সম্পর্কে কুধারনা পোষণ করে পরে অনুতপ্ত হওয়ার চেয়ে তার সম্পর্কে সুধারনা পোষণ করে পরে অনুতপ্ত হওয়া বরং শ্রেয়।” [আস সিবা’ঈ, হাকাদা আল লামান্তি আল হায়াত, আল মাক্‌তাব আল ইসলাম, বৈরুত, ১৯৮৪, ভলিউমঃ ১, পৃষ্ঠাঃ ৪২]

[ফী কাফাস আল ইত্তিহাম থেকে সংগৃহীত]

English Version


দৃষ্টি সংযত রাখার মাহাত্ম্য ও মর্যাদা

$
0
0

myosotis

ভাষান্তর : হামিদা মুবাশ্বেরা | সম্পাদনাআব্‌দ আল-আহাদ

আল্লাহ্‌ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা বলেছেন,

(হে নবী) আপনি  মু’মিন পুরুষদের বলুন, তারা তাদের দৃষ্টিকে সংযত রাখবে এবং তাদের  লজ্জাস্থানের হিফাযত করবে। এটাই তাদের জন্য অধিক পবিত্র। নিশ্চয়ই তারা যা করে, সে সম্পর্কে আল্লাহ্‌  সম্যক অবহিত

(সূরা আন-নূর; ২৪ : ৩০)

অতএব, আল্লাহ্‌ পবিত্রতা ও আত্মিক উন্নয়নকে দৃষ্টি সংযত রাখার এবং লজ্জাস্থান হিফাযত করার প্রতিদান হিসেবে উল্লেখ করেছেন। কারণ নিষিদ্ধ বস্তু থেকে নিজের দৃষ্টি সংযত করার ফলে তিনটি উপকার হয় যেগুলো ভীষণভাবে গুরুত্বপূর্ণ ও অত্যন্ত মূল্যবান।

প্রথমত : ঈমানের মধুরতা আস্বাদন করা

যে ব্যক্তি আল্লাহ্‌র ভয়ে দৃষ্টি সংযত রাখে, তার কাছে ঈমানের সুমিষ্ট মাধুর্য এবং তা থেকে পাওয়া আনন্দ, নিষিদ্ধ বস্তু দেখে পাওয়া আনন্দের চেয়ে অনেক বেশি মনোহর। বস্তুত, “কেউ যদি আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টির জন্য কোনোকিছু পরিত্যাগ করে, তবে আল্লাহ্‌ আরও উত্তম কিছুর দ্বারা সেটির প্রতিস্থাপন করেন।”

প্রবৃত্তি হলো নিষিদ্ধকাজে প্রলুব্ধকারী এবং সুন্দর অবয়ব দেখতে ভালোবাসে। আর চোখ হলো হৃদয়ের দিশারী। হৃদয় তার দিশারীকে কোথায় কি আছে, তা খুঁজে দেখার দায়িত্ব দিয়ে বলে, ‘যাও! দেখো, কোথায় কী আছে।’ চোখ যখন সুন্দর কোনো দৃশ্যের খবর দেয়, হৃদয়ে তখন তা পাওয়ার জন্য ভালোবাসার শিহরণ এবং আকাঙ্ক্ষা জাগে। হৃদয় এবং চোখের এই অভ্যন্তরীণ দোলাচল উভয়কেই অনবরত ক্লান্ত করে থাকে। যেমনটি বলা হয়েছে :

চোখকে যেদিন দিশারী বানিয়ে করালে সন্ধান

তোমার চোখের লক্ষ্যবস্তু তোমায় করল হয়রান,

এমন কিছু দেখেলে যাতে ছিল না নিয়ন্ত্রণ,

আংশিকও নয়, নয় পুরোপুরিও;

বরং তোমার জন্য উত্তম ছিল ধৈর্যধারণ।

 কাজেই দৃষ্টিকে যখন কোনোকিছু দেখা এবং নিরীক্ষণ করা থেকে সংযত রাখা হয়, হৃদয়ও তখন নিরর্থক অনুসন্ধান আর কামনার মতো ক্লান্তিকর কাজ থেকে বিশ্রাম পায়।

যে ব্যক্তি নিজের দৃষ্টিকে অবাধে বিচরণের সুযোগ দেবেন, তিনি প্রতিনিয়ত নিজেকে অবিরাম ক্ষতি এবং নিদারুণ মানসিক যন্ত্রণার মাঝে আবিষ্কার করবেন। কারণ দৃষ্টিপাত থেকেই ভালোবাসার (মুহাব্বাহ্‌) জন্ম হয়, যার সূচনা হয় চোখ যা দেখেছে তার প্রতি মোহাবিষ্ট ও নির্ভরশীল হয়ে পড়ার মাধ্যমে। এই ভালোবাসা ক্রমেই আকুল আকাঙ্ক্ষায় (সাবাবাহ্‌) পরিণত হয়, যার দ্বারা হৃদয় তার কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তি বা বস্তুর প্রতি অসংশোধনীয় মাত্রায় মোহাবিষ্ট এবং নির্ভরশীল হয়ে যায়। এর মাত্রা বেড়ে ‘আসক্তি’র (গারামাহ্‌) রূপ নেয়। এই আসক্তি এমন এক শক্তি যা আসক্ত ব্যক্তির পেছনে তেমনিভাবে লেগে থাকে, যেভাবে কোনো পাওয়াদার ঋণ পরিশোধের জন্য ঋণীর পেছনে লেগে থাকে। এই আসক্তি আরও বাড়তে থাকে এবং ‘প্রেমাসক্তি’র (ইশ্‌ক) রূপ নেয় যা সকল প্রকার সীমা ছাড়িয়ে যায়। সবশেষে এর মাত্রা বেড়ে ‘প্রেমোন্মাদনা’র (শাগাফা) জন্ম হয় যা হৃদয়ের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশকেও বেষ্টন করে ফেলে। এই প্রেমোন্মাদনা ক্রমেই ‘আনুগত্যের ভালোবাসা’য় (তাতাইয়্যুমা) রূপ নেয়। তাতাইয়্যুমা’র অর্থই হলো ইবাদত। যখন বলা হয়, ‘তাইয়্যামা আল্লাহ্‌’, তখন তার অর্থ দাঁড়ায়, ‘সে আল্লাহ্‌র ইবাদত করেছে।’

 

এভাবেই হৃদয় এমন কিছুর উপাসনা করা শুরু করে, যার উপাসনা করা সমীচীন নয়। আর এসব কিছুর পেছনে একমাত্র কারণ একটি নিষিদ্ধ দৃষ্টিপাত। যে হৃদয় পূর্বে ছিল মনিব, তা এখন শিকলাবদ্ধ; যা ছিল মুক্ত ও স্বাধীন, তা এখন কারারুদ্ধ। এই হৃদয় চোখের দ্বারা নির্যাতিত এবং চোখের আছে অভিযোগ করলে, চোখ এখন বলে : ‘আমি তোমার দিশারী এবং আজ্ঞাবাহক। প্রথমে তুমিই আমাকে পাঠিয়েছিলে।’ এখানে যাকিছু বলা হলো, তার সবই এমন সব হৃদয়ের জন্যই সত্য, যেসব হৃদয় আল্লাহ্‌র প্রতি ভালোবাসা ও একনিষ্ঠতাকে পরিত্যাগ করেছে। কারণ ভালোবাসার জন্য হৃদয়ের এমনকিছু চায়, যার প্রতি হৃদয় নিজেকে নিবেদিত রাখতে পারে। সে কারণেই, হৃদয় যখন শুধুমাত্র আল্লাহ্‌কে ভালোবাসে না এবং শুধু তাঁকেই উপাস্য হিসেবে গ্রহণ করে না, তখন নিশ্চিতভাবে সে অন্যকিছুর উপাসনায় লিপ্ত থাকে। আল্লাহ্‌ ইউসুফ (আ) সম্পর্কে বলেন :

এভাবেই যাতে আমি তার থেকে অনিষ্ট অশ্লীলতা দুর করে দেই। নিশ্চয়ই সে আমার নিষ্ঠাবান বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত

(সূরা ইউসূফ; ১২ : ২৪)

আযীযের স্ত্রী একজন বিবাহতা নারী হওয়া সত্ত্বেও তার হৃদয়ে প্রেমাসক্তি প্রবেশ করেছিল। কারণ সে ছিল মুশরিকা। অন্যদিকে, ইউসুফ (আ) যুবক, অবিবাহিত এবং চাকর হওয়া সত্ত্বেও সেই অপকর্ম থেকে তাঁকে রক্ষা করা হয়েছিল। কারণ তিনি ছিলেন আল্লাহ্‌র একনিষ্ঠ গোলাম।

দ্বিতীয়ত : আলোকিত হৃদয়, স্বচ্ছ উপলব্ধিবোধ এবং তীক্ষ্ণ অন্তর্দৃষ্টি

ইবনু সুজা‘আ আল-কিরমানি বলেছেন, “যে ব্যক্তি নিজের বাহ্যিক অবয়বকে সুন্নাহ্‌র আদলে এবং অভ্যন্তরীণ সত্ত্বাকে সর্বদা আল্লাহ্‌র চিন্তা-গবেষণা এবং তাঁর সচেতনতার আলোকে গড়ে তোলে, নিজের আত্মাকে প্রবৃত্তির অনুসরণ করা থেকে এবং নিষিদ্ধ বস্তু থেকে দৃষ্টিকে সংযত রাখে, সর্বদা হালাল রুজি ভক্ষণ করে, সেইব্যক্তির উপলব্ধি এবং অন্তর্দৃষ্টি কখনোই ভুল হবে না।”

আল্লাহ্‌ লূতের (আ) সম্প্রদায়কে কীভাবে শাস্তি দিয়েছিলেন, সে কথা উল্লেখ করে বলেছেন :

“নিশ্চয়ই এতে ‘মুতাওয়াস্‌সিমীন’দের (স্বচ্ছ উপলব্ধিবোধ এবং তীক্ষ্ণ অন্তর্দৃষ্টি সম্পন্ন) জন্য রয়েছে নিদর্শনমালা

(সূরা আল হিজ্‌র; ১৫:৭৫)

মুতাওয়াস্‌সিমীন হলেন তারাই যারা স্বচ্ছ উপলব্ধিবোধ এবং তীক্ষ্ণ অন্তর্দৃষ্টি সম্পন্ন। তারা হারাম বস্তুর প্রতি দৃষ্টিপাত করেন না এবং অশ্লীল কর্ম সম্পাদন করা থেকে বিরত থাকেন।

দৃষ্টি সংযত করা সম্পর্কিত আয়াতের পরবর্তী আয়াতেই আল্লাহ্‌ বলেছেন:

আল্লাহ্‌ আসমানসমুহ যমীনের নূ।…” (সূরা আন-নূর; ২৪:৩৫)

এর কারণ হলো, কর্ম যেমন, কর্মের প্রতিদানও তেমন হয়। অতএব, যে কেউ আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টির জন্য নিষিদ্ধ বস্তু থেকে দৃষ্টিকে সংযত রাখবে, আল্লাহ্‌, আযযা ওয়া জাল্লা, সেইব্যক্তির জন্য নিষিদ্ধ বস্তুকে অনুরূপ অথচ তার চেয়ে অধিক উত্তম বস্তু দ্বারা প্রতিস্থাপন করবেন। তাই বান্দা যেহেতু তার চোখের আলোকে নিষিদ্ধ বস্তুর উপর পড়তে দেয়নি, আল্লাহ্‌ সেই বান্দার দৃষ্টি এবং অন্তরের আলোকে অনুগ্রহ দান করেন। ফলে ব্যক্তি সেইসব বিষয় বুঝতে এবং উপলব্ধি করতে সক্ষম হবেন, দৃষ্টি সংযত না করলে যেগুলো বুঝা এবং উপলব্ধি করা তার জন্য সম্ভব হতো না।

ব্যক্তি নিজের মধ্যে এই বিষয়টি আক্ষরিক অর্থেই উপলব্ধি করতে পারেন। কারণ হৃদয় একটা আয়নার মতো এবং পাশবিক প্রবৃত্তিগুলো সেই আয়নার উপর মরিচার মতো। এই আয়না যখন সচ্ছ এবং পরিষ্কার থাকে, তখন তাতে বাস্তবতার (হাকাইক) আক্ষরিক প্রতিফলন ঘটে। কিন্তু যদি তাতে মরিচা পড়ে থাকে, তাহলে তাতে সুষম প্রতিফলন তৈরি হয় না। ফলে হৃদয়ে অনুমান এবং সন্দেহ নির্ভর জ্ঞান ও অভিব্যক্তির উন্মেষ ঘটবে।

তৃতীয়ত : হৃদয় হবে শক্তিশালী, দৃঢ় এবং সাহসী

 

দৃষ্টির আলোর জন্য আল্লাহ্‌ যেভাবে চোখকে সুস্পষ্ট প্রমাণের সহায়ক শক্তি দিয়েছেন, হৃদয়ের দৃঢ়তার জন্যও তিনি হৃদয়কে সহায়ক শক্তি দান করবেন। এভাবে হৃদয়ে দুধরণের উপাদনের সমন্বয় ঘটবে। ফলে হৃদয় থেকে শয়তান বিতাড়িত হবে। হাদীসে উল্লেখ আছে, “কেউ যদি নিজের পাশবিক প্রবৃত্তির বিরোধিতা করে, ভয়ে শয়তান তার ছায়া থেকেও পালিয়ে বেড়ায়।”

একারণেই যে ব্যক্তি নিজের প্রবৃত্তির অনুসরণ করে, সে নিজের মাঝে গ্লানিময় আত্মাকে খুঁজে পায় — যে আত্মা দুর্বল, শক্তিহীন, ঘৃণার যোগ্য। বস্তুত, যে ব্যক্তি আল্লাহ্‌কে মান্য করেন, আল্লাহ্‌ তার জন্য উচ্চমর্যাদা নির্ধারণ করেন। আর তাঁকে অমান্যকারীর জন্য আল্লাহ্‌ লাঞ্ছনা নির্ধারণ করেন:

“আর তোমরা দুর্বল হয়ো না এবং দুঃখিত  হয়ো না, আর তোমরা বিজয়ী হবে, যদি মু’মিন হয়ে থাকো

(সূরা আল–ইমরান; ৩:১৩৯)

“কেউ যদি সম্মান চায় (তবে তা যেন আল্লাহ্‌র কাছেই চায়), কেননা সকল সম্মান আল্লাহ্‌রই।”

(সূরা ফাতির; ৩৫:১০)

অর্থাৎ, যে ব্যক্তি আল্লাহ্‌র (আয্‌যা ওয়া জাল্লা) চেয়ে অবাধ্যতা এবং পাপকর্মকেই বেশি প্রাধান্য দেবে, আল্লাহ্‌ সেই বিরুদ্ধাচরণকারীকে লাঞ্ছিত করবেন। সালাফদের অনেকেই বলেছেন, “সম্মানের খোঁজে মানুষ রাজাদের দ্বারে যায়। অথচ আল্লাহ্‌র আনুগত্য ছাড়া কোনো সম্মান নেই।” কারণ যারা আল্লাহ্‌র আনুগত্য করে, তারা আল্লাহ্‌কে নিজেদের বন্ধু এবং রক্ষাকারী হিসেবে গ্রহণ করে। আর যারা আল্লাহ্‌কে তাদের রব এবং পৃষ্ঠপোষক হিসেবে গ্রহণ করে, আল্লাহ্‌ কখনোই তাদেরকে অসম্মানিত করেন না। একটি দো‘আ কুনূতে এ কথাগুলোই বলা হয়েছে: “যাকে আপনি বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করেন, সে অপমানিত হয় না আর যাকে আপনি শত্রু হিসেবে গ্রহণ করেন, সে সম্মানিত হয় না।”

(সূত্র : শায়েখ ইবনুল কায়্যিম, আল-মুন্‌তাকা মিন ইক্‌হাসাতুল লুফ্‌হান ফী মাসায়্যিদ আশ-শায়তান, পৃষ্ঠা ১০২-১০৫। পরিমার্জন : আলি হাসান।)

অমুসলিমদের প্রতি মুসলিমদের আচরণ কেমন হওয়া উচিত?

$
0
0

মূল লেখক : শায়েখ আব্দুল ‘আযীয্‌ ইবনু বাজ (রঃ) | ভাষান্তর ও সম্পাদনা : ‘আব্‌দ আল-আহাদ

প্রকাশনায় : কুরআনের আলো ওয়েবসাইট

Image Courtesy: IERA Facebook Page

Image Courtesy: IERA Facebook Page

প্রশ্ন : একজন অমুসলিম কোনো মুসলিম দেশে প্রবাসী যিম্মি (মুসলিম শাসনে বসবাসকারী অমুসলিম) হিসেবে বসবাস করতে পারে। আবার একজন মুসলিম কোনো অমুসলিম দেশে প্রবাসী হিসেবেও বসবাস করতে পারে। পরিস্থিতি দুটোর যা-ই হোক না কেন, একজন অমুসলিমের প্রতি একজন মুসলিমের কী ধরণের আচরণ করা উচিত? অমুসলিমদের সম্ভাষণ জানানো থেকে শুরু করে তাদের বিভিন্ন উৎসব-অনুষ্ঠান পালন করা সহ, তাদের সাথে মসুলিমদের চালচলন কেমন হওয়া উচিত, সে ব্যাপারে আমি একটা সচ্ছ ধারণা পেতে চাই। শুধু কর্মক্ষেত্রে কোনো অমুসলিমকে কি বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করার অনুমতি আছে? দয়া করে জানাবেন।

 

উত্তর : প্রশংসা একমাত্র আল্লাহ্‌র জন্য। অমুসলিমদের প্রতি মুসলিমদের কর্তব্যের মধ্যে অনেকগুলো বিষয় অন্তর্ভুক্ত।

প্রথমত :

একজন অমুসলিমের প্রতি একজন মুসলিমের প্রথম কর্তব্য হলো, তাকে আল্লাহ্‌র দ্বীন, ইসলামের দা‘ওয়াত দিতে হবে। ইসলামের দা‘ওয়াত দেওয়ার পাশাপাশি যতদূর সম্ভব, জ্ঞান নিজের বিশুদ্ধ অনুযায়ী বাস্তবিক অর্থে ইসলাম কী, সে ব্যাপারে অমুসলিম ব্যক্তিকে বুঝাতে হবে। কারণ অন্যান্য মুসলিমদের পাশাপাশি কোনো ইহুদী, খ্রিস্টান কিংবা মুশরিকের প্রতি একজন মুসলিমের সর্বোচ্চ পরিমাণ অনুগ্রহ দেখানো উপায় হলো, তাদেরকে আল্লাহ্‌র দ্বীনের দা‘ওয়াত দেওয়া। নবী (সা) বলেছেন :

“যে ব্যাক্তি অন্যদেরকে কল্যাণের দিকে আহ্বান করবে, সে ‘আমলকারীর সমপরিমান সওয়াব পাবে” [সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১৮৯৩]

‘আলীকে (রা) খায়বারে প্রেরণের সময় রাসূল (সা) নির্দেশ দিয়েছিলেন যে, তিনি যেন ইহুদীদেরকে ইসলামের দা‘ওয়াত দেন। রাসূল (সা) বলেছিলেন :

“আল্লাহ্‌র কসম! আল্লাহ্‌ যদি তোমার মাধ্যমে একজন মাত্র ব্যক্তিকে হিদায়াত দান করেন, তাহলে তোমার জন্য তা হবে লাল উট (সেরা প্রজাতির উট) থাকার চেয়েও অধিক উত্তম।”

তিনি (সা) আরও বলেছিলেন :

“যে ব্যক্তি অন্যদেরকে সঠিক পথের দিকে আহ্বান করে, সে তাদের সমপরিমান সওয়াব লাভ করবে, যারা সে পথের অনুসরণ করবে। অথচ তাদের কারও সওয়াব থেকে বিন্দুমাত্র কম করা হবে না।” [সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৪৮৩২]

কাজেই, আন্তরিকতার সাথে একজন অমুসলিমকে ইসলামের দা‘ওয়াত দেওয়া এবং তার কাছে ইসলামের বাণী পৌঁছে দেওয়া আল্লাহ্‌র নৈকট্য লাভের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপায়।

দ্বিতীয়ত :

কোনো মুসলিম শারীরিক, আর্থিক কিংবা সম্মান-মর্যাদার দিক থেকে অমুসলিম ব্যাক্তির প্রতি কোনোরূপ অন্যায় করতে পারবে না। অমুসলিম ব্যক্তি যদি যিম্মি (মুসলিম শাসনাধীনে বসবাসকারী), মুস্তা’মান (মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় নিরাপত্তাপ্রাপ্ত) কিংবা মু‘আহিদ (যার দেশের সাথে মুসলিমদের শান্তিচুক্তিতে আবন্ধ) হয়, তাহলে তাকে তার প্রাপ্য অধিকার দিতে হবে এবং  চুরি, বিশ্বাসঘাতকতা বা প্রতারণার মাধ্যমে তার ধনসম্পদের ক্ষয়ক্ষতি করা যাবে না। তাকে হত্যা করা যাবে না এবং আঘাত করে শারীরিকভাবে কষ্ট দেওয়া যাবে না। কারণ সে মু‘আহিদ, যিম্মি কিংবা মুস্তা’মান হওয়ায় ইসলামী শারী‘আহ্‌ কর্তৃক তার নিরাপত্তা সুরক্ষিত।

তৃতীয়ত :

এমন কোনো কারণ নেই যার ফলে আমরা অমুসলিম সাথে ব্যবসা-বাণিজ্য, তাদের কাছে জিনিসপত্র ভাড়া দেওয়া বা তাদের কাছ থেকে ভাড়া নেওয়া ইত্যাদি কাজগুলো করতে পারবো না। সহীহ হাদীসের বর্ণনা অনুযায়ী, আল্লাহ্‌র রাসূল (সা) কাফের এবং মুশরিকদের থেকে জিনিসপত্র কিনেছেন। আর তাদের থেকে জিনিসপত্র কেনা মূলত তাদের সাথে সম্পর্ক রাখা। তাঁর (সা) মৃত্যুর সময়েও তাঁর একটি বর্ম একজন ইহুদীর কাছে বন্ধক ছিল। ইহুদীর কাছে একসময় বর্মটি বন্ধক রেখে রাসূল (সা) তাঁর পরিবারের জন্য খাবার কিনেছিলেন।

চতুর্থত :

অমুসলিমদেরকে প্রথমে সম্ভাষণ জানানো মুসলিম ব্যক্তির উচিত নয়। নবী (সা) বলেছেন,

“ইহুদী কিংবা খ্রিস্টানদের প্রথমে তোমরা সালাম জানাবে না।” [সহীহ মুসলিম, সালাম অধ্যায়, হাদীস নং ২১৬৭]

তিনি (সা) আরও বলেছেন,

“যদি আহলে কিতাবদের কেউ সালামের (আস্‌সালামু ‘আলাইকুম) মাধ্যমে তোমাদের অভিবাদন জানায়, তাহলে বোলো, ‘ওয়া ‘আলাইকুম।’” [আল-বুখারি, হাদীস নং ৫৯০১; মুসলিম, হাদীস নং ২১৬৫]

অতএব, নিজে থেকে প্রথমেই কোনো কাফিরকে সালাম জানানো মুসলিমের উচিত নয়। তবে কোন কাফের, ইহুদী বা খ্রিস্টান যদি কোনো মুসলিমকে সালাম জানায়, তাহলে রাসূলের (সা) নির্দেশ অনুযায়ী, “ওয়া ‘আলাইকুম” বলে উত্তর দিতে হবে।

ভালো প্রতিবেশী হওয়া মুসলিমদের উপর অমুসলিমদের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অধিকার। কাজেই কোনো অমুসলিম  আপনার প্রতিবেশী হলে তার প্রতি সদয় হউন। তাকে কোনোভাবে হয়রানি করবেন না। অসচ্ছল হলে তাকে সাহায্য করুন। উপহার দিয়ে, সুপরামর্শ দিয়ে তাকে সহায়তা করুন। এতে করে সে ইসলামের সৌন্দর্যে আকৃষ্ট হবে এবং মুসলমান হওয়ার জন্য আগ্রহী হয়ে উঠবে। অধিকিন্তু, প্রতিবেশী হিসেবে আপনার উপর তার অধিকার রয়েছে। রাসূল (সা) বলেছেন,

“জিব্‌রীল (আ) প্রতিবেশীর প্রতি সদয় হওয়ার জন্য আমাকে এতটাই তাগিদ দিতে থাকলেন যে, আমি ভাবলাম, তিনি হয়তো প্রতিবেশীকে আমার উত্তরাধিকারী বানিয়ে ফেলবেন।” [আল-বুখারি ও মুসলিম]

প্রতিবেশী কাফির হলেও প্রতিবেশী হিসেবে তার অধিকার রয়েছে। প্রতিবেশী যদি কাফির হওয়ার পাশাপাশি আত্মীয়ও হয়, তাহলে তার অধিকার দ্বিগুন: প্রতিবেশী হিসেবে এবং আত্মীয় হিসেবে।

প্রতিবেশী দরিদ্র হলে তাকে যাকাত না দিয়ে আর্থিকভাবে সাহায্য করুন। কারণ প্রতিবেশী হিসেবে এই সাহায্য পাওয়ার অধিকার তার আছে। এই সম্পর্কে আল্লাহ্‌ বলেন (অর্থের ব্যাখ্যা),

দ্বীনের ব্যাপারে যারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেনি এবং তোমাদেরকে স্বদেশ হতে বহিষ্কার করেনি, তাদের প্রতি সদ্ব্যবহার ও ন্যায় বিচার করতে আল্লাহ্‌ তোমাদেরকে নিষেধ করেন না। আল্লাহ্‌ তো ন্যায়-পরায়ণদেরকে  ভালোবাসেন।” [সূরা মুমতাহিনাহ্‌, আয়াত-৮]

আস্‌মা বিন্‌তে আবি বাক্‌র (রা) থেকে বর্ণিত একটি বিশুদ্ধ বর্ণনানুযায়ী, মক্কার মুশরিক এবং রাসূলের (সা) মধ্যে যুদ্ধবিরতি চলাকালীন তার মা — যে তখনও মুশরিকা ছিল — তার সাথে দেখা করে সাহায্য চাইলো। মায়ের সাথে তার সম্পর্কের বন্ধনকে বহাল রাখবে কি না, সে বিষয়ে আস্‌মা রাসূলের (সা) কাছে অনুমতি চাইলেন। উত্তরে রাসূল (সা) বলেছিলেন,

“তার সাথে রক্তের বন্ধনকে বহাল রাখো।”

অমুসলিমদের উৎসব-অনুষ্ঠান উদ্‌যাপনের ক্ষেত্রে বিধান হলো, কোনো মুসলিম সেগুলোতে অংশগ্রহণ করতে পারবে না। তবে তাদের কোনো প্রিয়জন মারা গেলে, সমবেদনা জ্ঞাপন করাতে দোষের কিছু নেই। যেমন: ‘আল্লাহ্‌ আপনার ক্ষতিপূরণ করুন’ বা এই জাতীয় সহানুভূতিপূর্ণ কথা বলা যেতে পারে। তবে মৃত ব্যক্তি কাফির হলে “আল্লাহ্‌ তাকে ক্ষমা করে দিন” বা ‘আল্লাহ্‌ তার উপর দয়া করুন’ ইত্যাদি বলা যাবে না এবং মৃতের জন্য কোনো দো‘আও করা যাবে না। কিন্তু মৃত ব্যক্তির জীবিত আত্মীয়স্বজনদের ক্ষতিপূরণের জন্য এবং তাদের হিদায়াতের জন্য দো‘আ করা যাবে।

ফাতাওয়া নূর ‘আলা আদ্‌-দার্‌ব, ১/২৮৯-২৯১

ফজরের সালাতের জন্য জেগে উঠার কিছু কার্যকরী কৌশল

$
0
0

মুল প্রবন্ধঃ ProductiveMuslim.com | অনুবাদঃ মুসাফির শহীদ

Morning-Alarm

আমরা যারা নিয়মিত সালাত আদায় করার চেষ্টা করি, আমাদের সবগুলো সালাত ঠিক থাকলেও ‘ফজরের সালাত’ নিয়ে কিছুটা সমস্যায় পড়তে হয়। অনেকেই অনেক চেষ্টা করেও পারি না ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠতে। কীভাবে করা যায় এ সমস্যার সমাধান? আমি শুধু দু’ একদিনের কথা বলছি না, বলছি প্রতিদিনকার কথা। আসুন জেনে নেই এ ব্যাপারে কিছু কার্যকরী কৌশল।

প্রিয় ভাই ও বোনেরা, আমরা যখন প্রতিদিন সূরা আল-ফাতিহা তিলাওয়াত করি, দিনে কমপক্ষে ১৭ বার, আমরা এই আয়াতটিও তিলাওয়াত করিঃ

আমরা একমাত্র তোমারি ইবাদত করি এবং শুধুমাত্র তোমারি সাহায্য প্রার্থনা করি।” [সূরা আল-ফাতিহাঃ ০৫]

আমরা কি সত্যিই আল্লাহর ইবাদত করতে চাই? “অবশ্যই!” তাহলে আল্লাহর সাহায্যও চাই? “হুম!” আবার ফজরের সালাতের জন্যও জেগে উঠতে চাই? “জ্বী, ভাই!” কিন্তু তারপরও আমরা পারি না কেন? কারণ, আমাদের চাওয়ায় আন্তরিকতার অভাব।

আপনার কি কখনও ঘুমাতে যাওয়ার মুহূর্তে এমন অনুভূতি হয়েছে যে, আপনি অবশ্যই ফজরের সালাতের জন্য উঠবেন কিংবা আগে থেকেই আপনি জানতেন সেদিন বেশি ঘুমাবেন? নিচের দৃশ্যপট দুটি কল্পনা করার চেষ্টা করুন। আমি মনে করি, আমরা প্রায় সকলেই এই ধরনের ঘটনার সম্মুখীন হয়েছি।

দৃশ্যপটঃ ১

আপনার হৃদয় ঈমানে পরিপূর্ণ, আপনি বিতির পড়েছেন, কিছুটা কুর’আন তিলাওয়াত-ও করেছেন এবং যদিও আপনার হাতে ফজর পর্যন্ত ঘুমানোর জন্য মাত্র দু’ ঘণ্টা সময় আছে, তারপরও জেগে উঠার ব্যাপারে আপনি নিশ্চিত। কারণ, আপনি আপনার মন, হৃদয় ও দেহকে প্রস্তুত করে নিয়েছেন। এমনকি মাঝে মাঝে ওয়াক্ত পার হয়ে গিয়ে সালাত মিস করার ভয়ে মাঝ রাতেও ঘুম থেকে জেগে উঠেছেন। যদি আপনি এ ধরনের কোন ঘটনার সম্মুখীন না হয়ে থাকেন, তবে এমন সময়ের কথা ভাবুন যেদিন আপনাকে খুব ভোরে বাস কিংবা ট্রেন ধরতে হয়েছিল। আর ভাবুন, কীভাবে আপনার মন, হৃদয় ও দেহ সজাগ ছিল। হয়তো অনেক দেরিতে ঘুমিয়েও জেগে উঠেছিলেন বাস কিংবা ট্রেনের জন্য।

দৃশ্যপটঃ ২

আপনার জীবনে হয়তো এমন অনেক দিন আছে যেগুলোতে আপনি প্রকৃতপক্ষেই বেশি ঘুমাতে চান। যার জন্য আপনি আগে থেকেই ‘অতিরিক্ত ঘুমানোর’ পরিকল্পনা করেন। তারপরও আপনি জেগে উঠেছেন, আর তখনই শুরু হয়েছে ‘Snooze Alarm’ এর সাথে যুদ্ধ এবং আধুনিক শয়তানের কৌশল, “আর মাত্র পাঁচ মিনিট…”

এই দুটি দৃশ্যপটের মধ্যে একটি দৃশ্যপট বর্ণনা করে ‘আপনি অবশ্যই ঘুম থেকে জেগে উঠবেন’ আপনার এ ধরনের গভীর মানসিকতার কথা, আর অন্য দৃশ্যপটটি বর্ণনা করে ‘আপনি ঘুম থেকে উঠতে পারবেন না’ এ ধরনের মানসিকতার কথা। কারণ, আপনার অন্তর এটা চায় না, আর আপনিও শয়তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে সকালে ঘুম থেকে জেগে উঠার চ্যালেঞ্জটি গ্রহণ করার জন্য প্রস্তুত নন। নিচে আমি কিছু কৌশলের কথা বর্ণনা করছি যেগুলো আপনাকে সব সময় দৃশ্যপটঃ ১ এর মত সফলতা অর্জনে সাহায্য করবে ইনশা আল্লাহ্‌।

 

আধ্যাত্মিক কৌশল

১. আল্লাহকে চেনাঃ এটা ফজরের সালাতের জন্য জেগে উঠার চাবিকাঠি এবং এক নম্বর কৌশল। আপনি যদি জানেন আপনি কার ইবাদত করছেন, আর এ-ও জানেন যে, তিনি চান আপনি প্রতিদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে তাঁর ইবাদত করুন, তাহলে আপনি জেগে উঠবেনই! ‘আল্লাহ’ কে- এ ব্যাপারে আমাদের জ্ঞানের কমতিই আমাদেরকে দৃশ্যপট-২ এর দিকে ধাবিত করে। তাই আপনার প্রভুকে জানুন, আর এটাই আপনার চাবিকাঠি।

২. আন্তরিকতাঃ ফজরের সালাতের জন্য জেগে উঠার ব্যাপারে আন্তরিক হোন। নিজেকে শুধু এটুকু বলবেন না যে, ‘যদি আমি ফজরের ওয়াক্তে উঠতে পারি তবে ভালো হবে’, বরং আন্তরিকতার সাথে বলুন, ‘আমি ফজরের ওয়াক্তে জেগে উঠবোই ইনশা আল্লাহ!’

৩. ঘুমাতে যাওয়ার আগে ওযু করাঃ

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বারা ইবনে আযেব রা.-কে বলেছিলেন―
«إذا أخذت مضجعك فتوضأ وضوءك للصلاة». مسلم (৪৮৮৪)
যখন তুমি বিছানায় যাবে তখন নামাযের ওযুর মত ওযু করবে। [মুসলিম : ৪৮৮৪]

৪. বিতিরের সালাত ও দু’আঃ বিতিরের সালাত আদায় না করে ঘুমাবেন না, আর বিতিরের সালাত আদায়ের সময় আল্লাহর কাছে অনুনয়-বিনয় করুন যাতে তিনি আপনাকে ঘুম থেকে জেগে উঠতে সাহায্য করেন।

৫. সামান্য কুর’আন তিলাওয়াত করুনঃ মহা গ্রন্থ আল-কুর’আনের মাধ্যমে দিনের সমাপ্তি অবশ্যই আপনার মনোযোগকে ফজরের সালাতের জন্য জেগে উঠার দিকে নিবন্ধিত করবে। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঘুমাতে যাওয়ার আগে সূরা আল-সাজদাহ ও সূরা আল-মূলক (৩২ ও ৬৭ নম্বর সূরা) তিলাওয়াত করার পরামর্শ দিতেন।

. ঘুমাতে যাওয়ার আগে আল্লাহকে স্মরণ করুনঃ এটা আমার বর্ণনাকৃত প্রথম পয়েন্টেরই অংশ। আর এখানেই আপনি আপনার সকল অনুনয়-বিনয় আল্লাহর কাছে জানাবেন। প্রথম প্রথম দু’আগুলো পড়ার জন্য আপনি ছাপিয়ে নিতে পারেন কিংবা দু’আর বই ব্যবহার করতে পারেন। কিন্তু এক বা দু’ সপ্তাহের মধ্যেই দু’আগুলো আপনার মুখস্থ হয়ে যাবে ইনশা আল্লাহ। আর ঠিক ঘুমিয়ে পড়ার আগেই সেগুলো নিয়মিত পড়বেন।

৭. ফজরের সালাত আদায়কারীদের জন্য ঘোষণাকৃত পুরস্কারগুলোর কথা স্মরণ করুনঃ মুনাফিকের হাত থেকে বেঁচে থাকা, শেষ বিচারের দিন আলোকিত হওয়া, সারাদিন আল্লাহর নিরাপত্তায় থাকা, জীবন থেকে অলসতা কেটে যাওয়া, কর্মঠ হওয়া- এই পুরস্কারগুলোর কথা স্মরণ করুন, ইনশা আল্লাহ আপনি জেগে উঠতে পারবেন।

এছাড়া অন্যান্য যে সব কৌশল আপনাকে ফজরের সালাতের জন্য জেগে উঠতে সাহায্য করবে, সেগুলো হলঃ

  • জাগিয়ে দেয়ার জন্য বন্ধু বা পরিবারের সদস্যদের বলাঃ পরিবারের অন্যান্য সদস্য কিংবা বন্ধুদের বলুন আপনাকে জাগিয়ে দিতে। আর পরস্পরকে সাহায্য করুন। যদি আপনি আগে জেগে উঠেন তবে স্বার্থপর না হয়ে অন্যদেরও জাগিয়ে তুলুন।
  • দেড় (১.৫) ঘন্টা ঘুমানোর নিয়মঃ একটি গোপন কৌশল জানিয়ে দিচ্ছি, ঘুম বিজ্ঞানে একটি তত্ত্ব আছে যাতে বলা হয়েছে, প্রত্যেক মানুষ তার ঘুমের একটি পূর্ণ চক্র সম্পন্ন করে দেড় ঘন্টায়। কাজেই আপনি যদি দেড় (১.৫ ঘন্টা) এর গুণীতকে (যেমনঃ ১.৫ ঘন্টা, ৩ ঘন্টা কিংবা ৪.৫ ঘন্টা ইত্যাদি) জেগে উঠতে পারেন, তবে আপনি থাকবেন সতেজ ও পুনরিজ্জ্বীবিত। তা নাহলে আপনার মাঝে আলসেমি থেকে যাবে। তাই ফজরের সালাত যদি ভোর পাঁচটায় হয়, আর আপনি বারোটা বাজে ঘুমান, তবে অবশ্যই আপনার এলার্ম সাড়ে চারটায় দিন। কারণ, এতে আপনি সাড়ে চার ঘন্টা ঘুমাতে পারবেন (অবশ্য ঘুম আসতে আপনার যদি সময়ের প্রয়োজন হয় তবে তা যোগ-বিয়গ করে নিবেন)।
  • দুপুরে সামান্য ভাত ঘুম দিনঃ আরেকটি কৌশল, যা নেয়া হয়েছে সুন্নাহ ও অনেকের পরামর্শ থেকে, আর তা হল দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর সামান্য ভাত ঘুম দেয়া। মাত্র আধ ঘন্টার ঘুমই আপনাকে করে তুলবে উজ্জীবিত।

কৌশলগুলো মেনে চলার চেষ্টা করুন, ইনশা আল্লাহ আপনি সফল হবেনই।

Read External link Disclaimer

Read External link Disclaimer

এ ওয়েব সাইটের সাথে সম্পৃক্ত অন্য ওয়েব সাইট অথবা অন্য ওয়েব সাইটে প্রদত্ত বিষয়-বস্তুর সাথে এ ওয়েব সাইটে প্রদত্ত বিষয়-বস্তুর সম্পৃক্ততা এবং এর সাথে সম্পৃক্ত অন্য ওয়েব সাইটে প্রবেশ করার ব্যাপারে কোনো দায়-দায়িত্ব কুরআনের আলো বহন করে না। তাতে প্রবেশ করবেন নিজ দায়িত্বেই। কারণ, সে সকল ওয়েব সাইট আমাদের দখলে নেই এবং তার বিষয়-বস্তু কিংবা ওয়েব সংক্রান্ত অন্যান্য প্রযুক্তিও আমাদের আয়ত্বে নেই। এবং এটাও মনে করা যাবে না যে, কুরআনের আলোর সাথে সম্পৃক্ত অন্যান্য ওয়েব সাইটে উপস্থাপিত জ্ঞান ও তথ্যের ব্যাপারে কুরআনের আলো একমত। কুরআনের আলো সে সব ওয়েবের লিংক দিয়ে শুধু কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে চায়। তাছাড়া সে সব ওয়েব সাইটে প্রদত্ত তথ্যের কোনো দায়-দায়িত্ব কুরআনের আলো কখনও বহন করে না।

(সংগ্রহ করা হয়েছে এই ব্লগ থেকে )

উদ্যমহীনতা কারণ ও এর প্রতিকার

$
0
0

প্রশ্ন: জনৈক ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করতেন। কিন্তু কিছুদিন পর তিনি নিরুদ্যম হয়ে পড়েন। এখন তিনি আগের মত কুরআন তেলাওয়াত করেন না। দ্বীনদারির ক্ষেত্রে উদ্যমহীনতা দূর করার উত্তম উপায় কী?

উত্তর: 
আল্‌হামদু লিল্লাহ।

4866644859_227edf2bfa_mউদ্যমহীনতা সৃষ্টির বেশ কিছু কারণ রয়েছে। প্রতিকার জানার আগে নিরুদ্যম হয়ে পড়ার কারণগুলো জেনে নেয়া জরুরী। কারণগুলো জানা গেলে প্রতিরোধ করার উপায়ও জানা যাবে।

উদ্যমহীনতার কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে- আল্লাহর সাথে সম্পর্কের দুর্বলতা, আনুগত্য ও ইবাদত পালনে অলসতা, দুর্বল আকাঙ্ক্ষার ব্যক্তিদের সাথে চলাফেরা, দুনিয়া ও দুনিয়ার ভোগ নিয়ে মেতে থাকা, দুনিয়ার শেষ পরিণতি নিয়ে না ভাবা এবং যার ফলে আল্লাহর সাথে সাক্ষাতের প্রস্তুতির মধ্যেও দুর্বলতা এসে পড়ে।

কোন মুসলিম উদ্যমহীনতার রোগে দ্বারা আক্রান্ত হলে সেটা প্রতিরোধ করার বেশ কিছু পন্থা রয়েছে-

. স্বীয় প্রতিপালকের সাথে সম্পর্ক মজবুত করা। এটি অর্জিত হবে কুরআনে কারীম বুঝে বুঝে, চিন্তাভাবনার সাথে অধ্যয়ন করার মাধ্যমে। আল্লাহর কিতাবের মাহাত্ম্য দিয়ে আল্লাহর মাহাত্ম্য অনুধাবন করার মাধ্যমে, আল্লাহ তাআলার মহান নাম ও গুণাবলী নিয়ে চিন্তাভাবনা করার মাধ্যমে।

২. পরিমাণে কম হলেও নিয়মিত ও বিরতিহীনভাবে নফল আমল আদায় করা। কোন মুসলিম উদ্যমহীনতায় আক্রান্ত হওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ হলো- খুব আবেগপ্রবণ হয়ে প্রথম ধাপে অতি বেশি নেক আমল করা। এটি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদর্শ নয় এবং উম্মতের প্রতি তাঁর ওসিয়ত নয়। আয়েশা (রাঃ) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আমলকে বিশেষিত করতে গিয়ে বলেন: “তাঁর আমল ছিল নিয়মিত”। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে আমাদেরকে জানিয়েছেন যে, “আল্লাহর নিকট সবচেয়ে প্রিয় আমল হল- নিয়মিত আমল; যদিও সেটা পরিমাণে কম হোক না কেন”। অতএব, কোন মুসলিম যদি উদ্যমহীনতা থেকে নিষ্কৃতি পেতে চায় তাহলে সে যেন নিয়মিতভাবে অল্প অল্প আমল করার চেষ্টা করে। অনিয়মিত বেশি আমলের চেয়ে নিয়মিত কম আমল ভাল।

৩. নেককার ও উদ্যমীদের সাহচর্যে থাকার চেষ্টা করা। উচ্চাকাঙ্ক্ষী ব্যক্তি আপনার মাঝেও উদ্যম সৃষ্টি করবে। অলস ব্যক্তি উচ্চাকাঙ্ক্ষী ব্যক্তির সাহচর্যে থাকতে রাজি হয় না। অতএব, আপনি উচ্চাকাঙ্ক্ষী বন্ধুবান্ধবের সাহচর্যে থাকার চেষ্টা করুন। যাদের মধ্যে মুখস্থ করা, ইলম অর্জন করা, দাওয়াতি কাজ করা ইত্যাদি করার মত উচ্চাকাঙ্ক্ষা আছে। এ ধরনের লোক আপনাকে ইবাদতের প্রতি, ভাল কাজের প্রতি উদ্বুদ্ধ করবে।

. জীবনে যারা উচ্চাকাঙ্ক্ষী ছিলেন এমন ব্যক্তিবর্গের জীবনীগ্রন্থ অধ্যয়ন করা। যাতে আল্লাহর রাস্তায় চলার ক্ষেত্রে আপনার সামনে কিছু উত্তম আদর্শ থাকে। এ ধরনের বইয়ের মধ্যে রয়েছে- উলুউল হিম্মাহ; লেখক: শাইখ মুহাম্মদ বিন ঈসমাইল আল-মুকাদ্দাম এবং সালাহুল উম্মাহ ফি উলুইল হিম্মাহ; লেখক: শাইখ সৈয়দ আফানি।

৫. আমরা আপনাকে দোয়া করার পরামর্শ দিচ্ছি; বিশেষতঃ শেষ রাতে। যে ব্যক্তি সঠিকভাবে নেক আমল করতে পারার জন্য তাঁর রবের আশ্রয় ও সাহায্য প্রার্থনা করে সে বিফল হয় না।

আমরা দোয়া করছি- আল্লাহ আপনাকে তাঁর সন্তোষজনক আমল করতে পারার তাওফিক দিন। আপনাকে উত্তম কথা, কাজ ও আচরণের তাওফিক দিন।

আর আল্লাহই ভাল জানেন।

লেখকঃ শেইখ সালিহ আল-মুনাজ্জিদ

গীবত ও গীবতকারীর পরিণতি

$
0
0

অনুলিখন : মুহাম্মাদ আলী শান্ত

gossipইসলাম ঐক্যবদ্ধ থাকার গুরুত্বারোপ করেছে। ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ব বিনষ্টকারী সমুদয় কর্ম হতে বিরত থাকতে সকলকে তাগীদ দিয়েছে। সমাজে যেসব বিষয়ে ফাটল ধরাতে এবং ঐক্যের সুরম্য প্রাসাদকে ভেঙ্গে তছনছ করে দিতে সক্ষম এমন বিষয়গুলির অন্যতম হল পরনিন্দা বা গীবত। এর মাধ্যমেই শয়তান সমাজে ফাটল ধরিয়ে থাকে। আল্লাহ্‌ তা’আলা বলেনঃ পশ্চাতে ও সম্মুখে পরনিন্দাকারীর জন্য দুর্ভোগ। [সূরা হুমাযাহ – ০১] কুরআন ও হাদিসে এই আচরণ সম্পর্কে বিভিন্নভাবে সতর্ক করা হয়েছে।

গীবত-এর সংজ্ঞাঃ ‘গীবত’ অর্থ বিনা প্রয়োজনে কোন ব্যক্তির দোষ অপরের নিকটে উল্লেখ করা। ইবনুল আছীর বলেনঃ “গীবত হল কোন মানুষের এমন কিছু বিষয় যা তার অনুপস্থিতিতে উল্লেখ করা, যা সে অপছন্দ করে, যদিও তা তার মধ্যে বিদ্যমান থাকে”। এসব সংজ্ঞা মূলত হাদিস হতে নেয়া হয়েছে। রাসূলুল্লাহ্‌ (সা) গীবতের পরিচয় দিয়ে বলেনঃ “গীবত হল তোমার ভাইয়ের এমন আচরণ বর্ণনা করা, যা সে খারাপ জানে”।[1]

গীবত করার পরিণামঃ গীবত কবীরা গুনাহ্‌র অন্তর্ভুক্ত। গীবতের পাপ সুদ অপেক্ষা বড়; বরং হাদিসে গীবতকে বড় সুদ বলা হয়েছে (সহীহ আত্‌ তারগীব) রাসূলুল্লাহ্‌ (সা)-এর নিকটে আয়েশা (রা) ছাফিইয়া (রা)-এর সমালোচনা করতে গিয়ে বলেনঃ হে আল্লাহ্‌র রাসূল (সা)! আপনার জন্য ছাফিইয়ার এরকম এরকম হওয়াই যথেষ্ট। এর দ্বারা তিনি ছাফিইয়ার বেঁটে সাইজ বুঝাতে চেয়েছিলেন। এতদশ্রবণে নাবী কারীম (সা) বললেনঃ “হে আয়েশা! তুমি এমন কথা বললে, যদি তা সাগরের পানির সঙ্গে মিশানো যেত তবে তার রং তা বদলে দিত”।[2]

১. গীবত জাহান্নামে শাস্তি ভোগের কারণঃ রাসূলুল্লাহ্‌ (সা) বলেনঃ “মিরাজ কালে আমি এমন কিছু লোকের নিকট দিয়ে অতিক্রম করলাম, যাদের নখগুলি পিতলের তৈরি, তারা তা দিয়ে তাদের মুখমণ্ডল ও বক্ষগুলিকে ছিঁড়ছিল। আমি জিজ্ঞাস করলাম, এরা কারা হে জিবরীল? তিনি বললেনঃ এরা তারাই যারা মানুষের গোশত খেত এবং তাদের ইজ্জত-আবরু বিনষ্ট করত”।[3]

২. গীবত মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়ার শামিলঃ আল্লাহ্‌ তা’আলা বলেনঃ ‘তোমাদের কেউ যেন কারো গীবত না করে, তোমাদের কেউ কি চায় যে, সে তার মৃত ভাইয়ের গোশত ভক্ষণ করবে? তোমরা তো এটাকে ঘৃণাই করে থাকো’। [সূরা হুজুরাত – ১২] অত্র আয়াত প্রমাণ করে যে, গীবত করা মৃত ব্যক্তির গোশত ভক্ষণ করার শামিল।

আনাস ইবন মালেক (রা) বলেনঃ আরবরা সফরে বের হলে একে অপরের খেদমত করত। আবু বকর ও ওমর (রা)-এর সাথে একজন খাদেম ছিল। (একবার সফর অবস্থায়) ঘুম থেকে তারা উভয়ে জাগ্রত হয়ে দেখেন যে, তাদের খাদেম তাদের জন্য খানা প্রস্তুত করেনি, তখন তারা পরস্পরকে বললেন, দেখ এই ব্যক্তিটি বাড়ির ঘুমের ন্যায় ঘুমাচ্ছে (অর্থাৎ এমনভাবে নিদ্রায় বিভোর যে, মনে হচ্ছে সে বাড়িতেই রয়েছে, সফরে নয়)। অতঃপর তারা তাকে জাগিয়ে দিয়ে বললেনঃ রাসূলুল্লাহ্‌ (সা)-এর কাছে যাও এবং বল আবু বকর ও ওমর আপনাকে সালাম দিয়েছেন এবং আপনার কাছে তরকারী চেয়ে পাঠিয়েছেন (নাস্তা খাওয়ার জন্য)। লোকটি রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকটে গেলে তিনি [রাসূলুল্লাহ্‌ (সা)] বললেনঃ তারাতো তরকারী খেয়েছে, তখন তারা বিস্মিত হলেন এবং নাবী কারীম (সা)-এর নিকটে এসে বললেনঃ হে আল্লাহ্‌র রাসূল (সা)! আমরা আপনার নিকটে এসে লোক পাঠালাম তরকারী তলব করে, অথচ আপনি বলেছেন, আমরা তরকারী খেয়েছি? তখন নাবী কারীম (সা) বললেনঃ তোমরা তোমাদের ভাইয়ের (খাদেমের) গোশত খেয়েছ। কসম ঐ সত্তার! যার হাতে আমার প্রাণ, নিশ্চয়ই আমি ঐ খাদেমটির গোশত তোমাদের সামনের দাঁতের ফাঁক দিয়ে দেখতে পাচ্ছি। তারা বললেনঃ [ইয়া রাসূলুল্লাহ্‌ (সা)] আপনি আমাদের জন্য ক্ষমা তলব করুন। আলবানী হাদিসটিকে সহিহ্‌ বলেছেন।[4]

আব্দুল্লাহ্‌ ইবন মাসউদ (রা) বলেনঃ (একদা) আমরা নাবী কারীম (সা)-এর নিকটে ছিলাম। এমতাবস্থায় একজন ব্যক্তি উঠে চলে গেল। তার প্রস্থানের পর একজন তার সমালোচনা করল। তখন রাসূলুল্লাহ্‌ (সা) তাকে বললেনঃ তোমার দাঁত খিলাল কর। লোকটি বললঃ কি কারণে দাঁত খিলাল করব? আমিতো কোন গোশত ভক্ষণ করিনি। তখন তিনি বললেনঃ নিশ্চয়ই তুমি তোমার ভাইয়ের গোশত ভক্ষণ করেছ অর্থাৎ ‘গীবত’ করেছ।[5]

গীবত কবরে শাস্তি ভোগের অন্যতম কারণঃ

একদা রাসূলুল্লাহ্‌ (সা) দু’টি কবরের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ তিনি থমকে দাঁড়ালেন এবং বললেনঃ ‘এই দুই কবরবাসীকে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। তবে তাদেরকে তেমন বড় কোন অপরাধে শাস্তি দেওয়া হচ্ছেনা (যা পালন করা তাদের পক্ষে কষ্টকর ছিল)। এদের একজনকে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে, চুগলখোরী করার কারণে এবং অন্যজনকে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে পেশাবের ব্যাপারে অসতর্কতার কারনে।[6] অপর হাদিসে চুগলখোরীর পরিবর্তে গীবত করার কথা উল্লেখ রয়েছে।[7]

 


[1] মুসলিম #১৮০৩
[2] আবূ দাউদ, তিরমিযী, হাদিস সহীহ্‌, সহীহুল জামে #৫১৪০; মিশকাত #৪৮৪৩
[3] আবূ দাউদ, মুসনাদে আহমাদ, হাদিস সহীহ্‌।
[4] দ্রষ্টব্য আমাসিক আলায়কা লিসানাকা (কুয়েত ১ম সংস্করণ ১৯৯৭ইং)
[5] ত্বাবারানী, ইবন আবী শায়বা, হাদিস সহীহ্‌ দ্রষ্টব্য গায়াতুল মারাম #৪২৮
[6] বুখারী, মুসলিম, সহিহ্‌ আত-তারগীব #১৫৭
[7] আহমাদ প্রভৃতি, সহিহ্‌ আত-তারগীব #১৬০ ‘পবিত্রতা’ অধ্যায়।
Viewing all 452 articles
Browse latest View live


<script src="https://jsc.adskeeper.com/r/s/rssing.com.1596347.js" async> </script>